বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো বিদ্যুৎচালিত দ্রুতগতির ট্রেন চালুর উদ্যোগ নেওয়া হলেও, দীর্ঘ পাঁচ বছরেও প্রকল্পটি এগোয়নি কাঙ্ক্ষিত গতিতে। শুধুমাত্র সম্ভাব্যতা যাচাই বা সমীক্ষার কাজেই কেটে গেছে এই সময়। নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকা হয়ে চট্টগ্রাম এবং টঙ্গী থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত রুটে চালু করার লক্ষ্য নিয়ে এ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছিল।
২০২১ সালে ‘বাংলাদেশ রেলওয়ের ইলেকট্রিক ট্র্যাকশন’ চালুর লক্ষ্যে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা শুরু হয়। তবে দুবার সময় ও ব্যয় বাড়িয়েও এখনও সেই কাজ শেষ করতে পারেনি রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। সর্বশেষ, প্রকল্পে আবারও অতিরিক্ত সময় ও বাজেট বৃদ্ধির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
এই বিদ্যুৎচালিত ট্রেন চালু হলে দেশে যাত্রী পরিবহন ও পণ্য পরিবহনে এক নতুন দিগন্তের সূচনা হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে বাস্তবায়নের গতি নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্র জানায়, সমীক্ষা প্রকল্পটি ২১ অক্টোবর ২০২১ সালে অনুমোদিত হয়। দু্ই দফা মেয়াদ বাড়িয়ে জুন ২০২৫ নাগাদ প্রকল্পের কাজ শতভাগ সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত ছিল। সেই বর্ধিত সময়েও অবশিষ্ট কাজ শেষ করা সম্ভব হচ্ছে না। বর্তমানে প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি ৮০ শতাংশ এবং আর্থিক অগ্রগতি ৩৬ দশমিক ৪৯ শতাংশ। সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ও বিশদ ডিজাইন শেষে লাভজনক বিবেচিত হলে বিনিয়োগ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে।
নতুন করে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর জন্য পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাব করা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জ থেকে কমলাপুর হয়ে চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিদ্যমান রেলপথটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৩৩৭ কিলোমিটার। এর সঙ্গে টঙ্গী-জয়দেবপুর সেকশনের আরও প্রায় ১১ কিলোমিটার রেলপথ বিদ্যুৎচালিত ট্রেন চলাচলের উপযোগী করে গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে রেলওয়ের। পরামর্শক প্রতিষ্ঠানটি নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা-চট্টগ্রাম এবং টঙ্গী-জয়দেবপুরের মধ্যে বিদ্যমান রেলপথটি বিদ্যুৎচালিত ব্যবস্থায় রূপান্তরের সম্ভাবনা অনুসন্ধান করবে। পাশাপাশি প্রকল্পটি প্রযুক্তিগত, অর্থনৈতিক ও আর্থিক এবং পরিবেশ ও সামাজিকভাবে কতটা কার্যকর তা নিয়ে সমীক্ষা চালাবে।
সমীক্ষা প্রকল্পটি সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে মোট ১৫ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে অনুমোদিত হয়। প্রকল্পটি প্রথম সংশোধনীতে ব্যয় ও সময় এক বছর বাড়িয়ে এপ্রিল ২০২৪ পর্যন্ত করা হয়। দ্বিতীয় দফায় মেয়াদ-ব্যয় বাড়িয়ে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাড়ার কারণে অতিরিক্ত জিওবি অর্থের সংস্থান এবং চলমান প্রকল্পের কার্যপরিধিতে ধীরাশ্রম-পূবাইল ও ফৌজদারহাট-সিজিপিওয়াই সেকশন অন্তর্ভুক্ত করায় প্রকল্পটির দ্বিতীয় সংশোধিত পিএফএস (প্রজেক্ট প্রপোজাল ফর ফিজিবিলিটি স্টাডি) প্রণয়ন করা হয়েছে।
প্রকল্প সংশোধনের যৌক্তিকতা প্রসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক ও বাংলাদেশ রেলওয়ের বৈদ্যুতিক প্রকৌশলী (পশ্চিম) মো. হাবিবুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘প্রকল্পটির অনুমোদিত প্রাক্কলিত ব্যয় ১৫ কোটি ৬ লাখ টাকা। ২০২১ সালে মার্কিন ডলারের বিনিময় হার ৮৪ টাকা ৮০ পয়সা ছিল। পরবর্তীসময়ে দরপত্র চূড়ান্তকরণ ও মার্কিন ডলারের বিনিময় হার ১১৮ টাকা, ১২০ টাকা ও ১২২ টাকা হয়েছে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে বিল ৯৫ টাকা, ১১০ টাকা, ১৬০ পরিশোধ করতে হয়েছে। এতে প্রকল্পের বৈদেশিক মুদ্রা, আয়কর ও মূল্য সংযোজন কর বাবদ ব্যয় বেড়েছে।’
পণ্য পরিবহন সহজ হবে
প্রকল্প পরিচালক জানান, অনুমোদিত প্রকল্পটির কার্যপরিধি হিসেবে নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকা হয়ে চট্টগ্রামে বিদ্যমান রেলপথে বৈদ্যুতিক ট্রেন পরিচালনার জন্য সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ও টঙ্গী থেকে ড্রয়িং এবং ডিজাইন পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ রেলওয়ে বর্তমানে পণ্য পরিবহনের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে গাজীপুর জেলার ধীরাশ্রমে একটি আইসিডি নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আইসিডি নির্মিত হলে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে রেলওয়েতে কনটেইনার পরিবহন উল্লেখযোগ্য হারে বাড়বে।
কনটেইনারগুলো ইলেকট্রিক লোকোমোটিভের মাধ্যমে পরিবহন করা হলে তুলনামূলক কম সময়ে অধিক পরিমাণে, স্বল্প ব্যয়ে পরিবেশবান্ধব উপায়ে পরিবহন করা সম্ভব হবে। এটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি ও বাংলাদেশ রেলওয়ের রাজস্ব আয় বৃদ্ধিসহ পরিবেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চলমান প্রকল্পের কার্যপরিধিতে ধীরাশ্রম-পূবাইল ও ফৌজদারহাট-সিজিপিওয়াই সেকশন অন্তর্ভুক্ত করলে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে রেলওয়েতে ইলেকট্রিক লোকোমোটিভের মাধ্যমে কনটেইনার পরিবহন সম্ভব। এতে প্রকল্পের কার্যপরিধি ১৭ দশমিক ৪ কিলোমিটার বাড়বে।
চলমান প্রকল্পের কার্যপরিধি বাড়িয়ে এতে পূবাইল-ধীরাশ্রম ও সিজিপিওয়াই-ফৌজদারহাট অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। প্রকল্পের কার্যপরিধি বাড়ার ফলে পরামর্শক সেবার পরিধি ১০১ জনমাস বাড়িয়ে ১১৪ দশমিক ৫ জনমাস করার প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রস্তাবিত সংশোধনীতে প্রকল্পের পরামর্শক সেবা বাবদ ১৫ কোটি ৫৫ লাখ ৪৯ হাজার টাকাসহ মোট ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে ১৬ কোটি টাকা।
প্রকল্পের পরিচালক বলেন, ‘অবশিষ্ট ভৌত কাজ অল্প সময়ের মধ্যে শেষ হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। তবে কার্যপরিধি বাড়ার কারণে চুক্তির ভেরিয়েশন অনুমোদন, সে অনুযায়ী বর্ধিত কার্য সম্পাদন ও অন্য কাজ শেষে ৩০ জুন ২০২৫ এর মধ্যে প্রকল্প শেষ করা সম্ভব হবে না। প্রকল্পের কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য মেয়াদ ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫ পর্যন্ত বাড়ানো প্রয়োজন।’
ধীরগতির সমীক্ষার কারণে নেওয়া হচ্ছে না মূল প্রকল্প
রেলপথে গতি আনতে ও যাত্রী সুবিধার কথা চিন্তা করে বাংলাদেশে দুইশ কিলোমিটার গতিবেগের ইলেকট্রিক ট্রেন পরিচালনার উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০১৬ সালে। লোডশেডিংয়ের কথা মাথায় রেখে বিদ্যুতের পাশাপাশি ডিজেলে চলাচলেরও ব্যবস্থা রাখা হয়। প্রাথমিকভাবে ইলেকট্রিক ট্রেন চালু করতে প্রস্তাবিত ব্যয় নির্ধারণ করা হয় ৯৫৮ কোটি টাকা। তবে পরিকল্পনা নিলেও সেসময় সমীক্ষাই হয়নি। এরপর সমীক্ষা শুরু করতেই লাতে আরও পাঁচ বছর, যেটা ২০২১ সালে শুরু হয়।
ওই সময়ের পরিকল্পনা ছিল, নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা-চট্টগ্রাম সেকশনে রেলওয়ে ইলেকট্রিফিকেশন করা হলে ঘণ্টায় ২শ কিলোমিটার রাস্তা অনায়াসে পাড়ি দেওয়া যাবে, যা রেলওয়ের জন্য একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। ফলে সেকশনে হাইস্পিড ইলেকট্রিক ট্রেনের পাশাপাশি ভ্রমণ সময় ও অপারেশনাল কস্ট কমে আসবে।
নারায়ণগঞ্জ দেশের অন্যতম প্রধান শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্য কেন্দ্র। চট্টগ্রামের প্রধান সমুদ্র বন্দরের মাধ্যমে বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ আমদানি-রপ্তানি হয়। বাংলাদেশের ৩০ শতাংশ জনসংখ্যা নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে বসবাস করে। এছাড়া এ অঞ্চলে সহজেই বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। যে কারণে এ অঞ্চল দিয়ে চালু হতে যাচ্ছে দেশের প্রথম ইলেকট্রিক ট্রেন। কিন্তু সমীক্ষার কারণে এক দশক অধরাই রয়েছে মূল প্রকল্পটি।
আরএ/এসএন