আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল সুইফট চ্যানেল ব্যবহার করে রিজার্ভ চুরির ঘটনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনেকে জড়িত আছে উল্লেখ করে বলেছেন, জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বাংলাদশ ব্যাংককে বলেছেন তিনি।
রোববার (১৩ এপ্রিল) রিজার্ভ চুরির ঘটনা বিশ্লেষনে গঠিত পর্যালোচনা কমিটির প্রথম বৈঠক শেষে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, “এটা তদন্ত করতে গিয়ে আগের সরকারের সময় সীমাহীন গাফিলতি দেখা গেছে। তদন্তের আগেই সিআইডিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের যারা ইনভলব আছে তাদের নাম যেন অভিযোগপত্রে না দেওয়া হয়।
“ফরাসউদ্দিন সাহেবের মাধ্যমে যে প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে সেটা দেখেছি। সিআইডি রিপোর্টে প্রাথমিকভাবে যাদের নাম এসেছে তাদের ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক কী ব্যবস্থা নিয়েছে কমিটি তা জানতে চেয়েছে। কী ব্যবস্থা নিতে হবে সেটাও আমরা বলে এসেছি।”
আসিফ নজরুল পর্যালোচনা কমিটির সভাপতি হিসাবে আছেন। সদস্য সচিব হিসাবে আছেন তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের জন্য প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমেদ তৈয়্যব।
আর কমিটির সদস্যরা হলেন- জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর, বেসরকারি সদস্য ব্যাংকার আলী আশফাক ও নজরুল হুদা।
সবাই এদিন বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
২০১৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি জালিয়াতি করে সুইফট কোডের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি হয়। স্থানান্তরিত এসব টাকা পাঠানো হয়েছিল ফিলিপিন্সে তিনটি ক্যাসিনোতে।
এর মধ্যে একটি ক্যাসিনোর মালিকের কাছ থেকে দেড় কোটি ডলার উদ্ধার করে ফিলিপিন্স সরকার বাংলাদেশ সরকারকে বুঝিয়ে দিলেও বাকি ৬ কোটি ৬৪ লাখ ডলার আর পাওয়া যায়নি।
উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংকে ২ বিলিয়ন ডলার চুরি বা লুট করার পরিকল্পনা ছিল। শেষ পর্যন্ত ৮৮ মিলিয়ন ডলার চুরি হয়েছে। এর মধ্যে ৬৬ মিলিয়ন এখনও উদ্ধার করা যায়নি। পুরো বাংলাদেশকে লুট করার পারিকল্পনা ছিল। ২ বিলিয়ন ডলার চলে গেলে আজকে প্রায় দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতির মধ্যে পড়তাম।”
রিজার্ভ চুরির তিন বছর পর ২০১৯ সালে ওই অর্থ উদ্ধারের আশায় নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটন সাদার্ন ডিস্ট্রিক্ট কোর্টে একটি মামলা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই মামলা খারিজে আবেদন করে আরসিবিসি।
২০২২ সালের এপ্রিলে নিউ ইয়র্কের আদালতে আরসিবিসির বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংকের মামলাটি খারিজ করে দেয়। রায়ে বলা হয়, ওই মামলা বিচারের ‘পর্যাপ্ত এখতিয়ার’ ওই আদালতের নেই।
এরপর বাংলাদেশ বাংকের পক্ষ থেকে নিউ ইয়র্কের ‘এখতিয়ারভুক্ত’ আদালতে মামলা করা হয় বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তরফ থেকে জানানো হয়েছিল।
দেশের অভ্যন্তরেরই কোনো একটি চক্রের সহায়তায় এই অর্থ পাচার হয়েছে বলে তখন ধারণা করেছিলেন সংশ্লিষ্টরা।
পরে সিআইডির তদন্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমানসহ মোট ১৩ জন সরকারি কর্মকর্তাকে ওই ঘটনায় অভিযুক্ত হিসেবে শনাক্ত করার কথা বলা হয়।
ওই বছরের ১৫ মার্চ রাজধানীর মতিঝিল থানায় মামলা করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং বিভাগের যুগ্ম পরিচালক জুবায়ের বিন হুদা; অর্থপাচার প্রতিরোধ আইনের ওই মামলায় সরাসরি কাউকে আসামি করা হয়নি।
মামলাটি তদন্ত করছে সিআইডি। কিন্তু দফায় দফায় সময় নিয়ে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে পারেনি সংস্থাটি। আদালতে বারবার প্রতিবেদন জমা দিতে তারা সময় চাওয়ায় একের পর এক শুনানি পেছাচ্ছে। এরইমধ্যে তদন্ত কর্মকর্তাও বদল হয়েছে।
এমন প্রেক্ষাপটে সরকারের পালাবদলের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দুদক গত ৩১ ডিসেম্বর সিআইডিতে চিঠি দিয়ে মামলার তদন্তের দায়িত্ব চেয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত সিআইডির তরফে কিছু জানানো হয়নি।
রিজার্ভ চুরির ঘটনায় বাংলাদেশ অংশে যারা জড়িত ছিল তাদের বিচারের মুখোমুখি করার জন্য সিআইডির তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে জানিয়ে আসিফ নজরুল বলেন, “দায়ীদের নাম এখনই ডিসক্লোজ করছি না। এ ধরনের অপরাধের পুনরাবৃত্তি রোধে বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিয়েছে কি না দেখা হচ্ছে।”
রিজার্ভ উদ্ধারে বিদেশে যে লিগ্যাল ফার্ম নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল সেখানেও অনিয়ম থাকতে পারে বলে সন্দেহ করছেন পর্যালোচনা কমিটির প্রধান।
“তখনকার সরকার কিছু লিগ্যাল ফার্মকে রিজার্ভ উদ্ধারের কাজ দিয়েছিল। ওই ফার্মের সঙ্গে গত সরকারের ঘনিষ্ট একজন আইনজীবী জড়িত ছিলেন। এই ফার্মকে লাখ লাখ ডলার পরিশোধ করা হয়েছে। তাদের সঙ্গে ইমেইল আদানপ্রদান করলেও টাকা দিতে হয়।
“এত বেশি টাকার বিনিময়ে ফার্মটাকে বাছাইয়ের পেছনে ওই সরকারঘনিষ্ট আইনজীবীর কী সংশ্লিষ্টতা, সেটাও আমরা দেখতে বলেছি। কোনো আর্থিক অনিয়ম হয়েছিল কি না দেখব।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনা পর্যালোচনা করতে গত ১২ মার্চ আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলকে সভাপতি করে উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটি করেছে সরকার। কমিটিকে তিন মাসের মধ্যে সুপারিশ দিতে বলা হয়েছে।
এসএম/টিএ