‘লজ্জা ২’ প্রশ্ন তুলল—‘ভারবাল অ্যাবিউজ’ নিয়ে ভদ্র সমাজের এত সংকোচ কেন?

অদিতি রায় পরিচালিত ‘লজ্জা টু’ নিয়ে যখন অভিনেত্রী প্রিয়াঙ্কা সরকারের সঙ্গে কথা বলছিলাম তখন একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তিনি আলোকপাত করেন- সেই সব অ্যাবিউজ, যা চট করে বোঝা যায় না। এবং দিনের পর দিন সেটার শিকার হলে একটা গ্লানি তৈরি হয়, নিজেকে নিয়ে ডাউট তৈরি হয়, মনের ওপর গাঢ় কালশিটে পড়ে। এই সিরিজের একেবারে শেষে কোর্ট রুম দৃশ্যে এই ‘কালশিটে’র কথা বলে ‘জয়া সিনহা’। সেখান থেকেই শব্দটা ধার করলাম। এই সময়ে দাঁড়িয়ে ‘লজ্জা টু’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সিরিজ এই বিষয়ে দ্বিমত নেই। কিন্তু ৬টি পর্বে এত স্বল্প সময়ে সব দিক সূক্ষ্মভাবে ছুঁয়ে যাওয়া সম্ভব না। যেমন নির্যাতিতার বাপের বাড়ি ও শ্বশুরবাড়ির পরিস্থিতি, তার মেয়ের ক্রাইসিস, সূর্যর সঙ্গে জয়ার সম্পর্কের সূক্ষ্মতা, বিপক্ষের আইনজীবীর সঙ্গে ‘সূর্য’র সম্পর্কের ফ্ল্যাশব্যাক, কোর্টরুম দৃশ্য, স্বামীর এই অ্যাবিউজিভ হয়ে ওঠার পিছনের একটা সম্ভাব্য কার্যকারণের ইঙ্গিত রেখে যাওয়া, সমাজে ব‌্যবহৃত হওয়া যাবতীয় স্ল‌্যাংয়ের নিশানা– এই সব কিছুর মধ্যে জয়ার লড়াই এবং সবটা এক তারে বাঁধা তাও আবার ২০ মিনিটের একেকটি এপিসোডে, সত্যিই অসম্ভবকে সম্ভব করা।

সম্রাজ্ঞী বন্দোপাধ্যায়ের সংলাপ ও চিত্রনাট্য পুরোটা না পারলেও অনেকটাই পেরেছে। তবু দেখতে দেখতে মনে হয়েছে, সবটা এই ভাবে না বোঝালেও চলত। আর কিছু শব্দের ক্রমাগত ব্যবহার না করলেও চলত যেমন অনুজয়ের সংলাপে ক্রমাগত অ্যাবিউসিভ শব্দ বা ‘ভারবাল অ্যাবিউজ’ শব্দটার ব‌্যবহার- মনে হয় যেন দর্শককে বারবার বুঝিয়ে দেওয়া যে এটাই সাবজেক্ট। আসলে এই শব্দগুলো এমনিতেই এত ভারী, অন্তত আমাদের অর্থাৎ মেয়েদের কাছে যে, আলাদা করে তাৎপর্যপূর্ণ করে তোলার জন্য আন্ডারলাইন করার প্রয়োজন পড়ে না। আমাদের জীবন দিয়ে আমরা প্রতিনিয়ত এই ‘অ্যাবিউজ’ ব্লটিং পেপারের মতো শুষে নিই। তাহলে কি এই সিরিজের দরকার ছিল না? অবশ‌্যই ছিল, একশোবার ছিল। কারণ ‘লজ্জা টু’ একটা জরুরি সংলাপ চালু করেছে যেটা নিয়ে ভদ্র সমাজ একেবারেই কথা বলতে চায় না। ভারবাল অ্যাবিউজ আসলে নানা ধরনের হয়। স্থান কাল পাত্র হিসেবে ডিগ্রির কমবেশি এই যা। প্রথম সিজনে পুরোটাই গার্হস্থ‌্য হিংসা, এই সিজনে তা খানিকটা নিজের বাড়ির গণ্ডির বাইরেও বেরিয়েছে। যেমন শুরুর দৃশ্যে থানায় জিজ্ঞাসাবাদ (যদিও আরও সূক্ষ্মভাবে দেখানো যেত), জয়ার নতুন বাড়ি এসে বিপক্ষ আইনজীবীর স্লাটশেমিং, পাড়ার ছেলেদের ইভটিজিং। দেখতে দেখতে যেটা মনে হল, সেইসব অ্যাবিউজের কী হবে যা আরও সূক্ষ্ম, যেখানে গালাগালি ব্যবহার হয় না। আমার এক মহিলা সহকর্মীর প্রতি অন্যান্য পুরুষ সহকর্মীদের দেখি ক্রমাগত ঠাট্টা ইয়ার্কি ছুড়ে দিতে। সেটা প্রথমদিকে মজা করার জন্যই শুরু হয়েছিল, এখন সেটা অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। প্রথম দিকে যাকে নিয়ে মজা করা হচ্ছে, তিনিও মজা পেতেন (আসলে তাঁর দিকে ধেয়ে আসা ঠাট্টা তিনি হাসি দিয়ে ঠেকিয়ে রাখার চেষ্টা করতেন)। কিন্তু দীর্ঘ দীর্ঘ সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর এখন তিনি আর মজা পান না। কারণ, তিনি কোনও দিনই মজা পেতেন না।

এই সূক্ষ্ম অ্যাবিউজের প্রতিকার কীভাবে হবে? এই যে একটা মানুষের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করা, তার মননকে অদৃশ্য করে দেওয়ার এই প্র‌্যাক্টিস পিতৃতান্ত্রিক সমাজ এমনভাবে নরমালাইজ করেছে যে সেটাকে অ্যাবিউজ বলে গণ্য করা হয় না। মহামারীর আকার ধারণ করেছে। ঘরে, বাইরে, অফিসে, রাস্তায়, বন্ধু মহলে, পাবলিক প্লেসে, সর্বত্র। এই অদৃশ্য অ্যাবিউজকে রুখে দেওয়ার প্রথম ধাপ হল সেটাকে চিহ্নিত করা। ‘লজ্জা টু’-এর শেষে কোর্টরুম দৃশ্যটি আমার কাছে খুব খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই দৃশ্যটি লেখার জন্য সম্রাজ্ঞী বন্দ্যোপাধ্যায়কে ধন্যবাদ দেব। কেন? জয়া মনে মনে জানে তার প্রতি অন্যায় হচ্ছে, আমার সহকর্মী মনে মনে জানে তাকে বুলি করা হচ্ছে, আমি মনে মনে জানি আমি আমাকে ক্ষুদ্রতর, অযোগ্য মনে করানো হয়েছে এবং আমাদের মতো হাজার হাজার মানুষ এই মনে হওয়া নিয়ে বসে আছে। এই বোধ আমরা দীর্ঘ দীর্ঘদিন মনের ভিতর পুষে রেখে কালশিটে তৈরি করেছি। তা হলে আর কী করতে পারি? ফাইট ব্যাক হল একমাত্র উত্তর। এই দৃশ্যে আমরা দেখি জয়া সকলের সামনে দাঁড়িয়ে দৃঢ় অথচ শান্ত কণ্ঠে সেই সব কালশিটের কথা উচ্চারণ করে। জোরে জোরে উচ্চারণ করে। এই উচ্চারণ করাটাই আসলে অর্ধেকের বেশি লড়াই জিতিয়ে দেয়। আমাকে যে অ্যাবিউজ করছে, বুলি করছে, তা যতই সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর হোক না কেন, অ‌্যাবিউজারকে স্পষ্ট করে বলতে হবে– এই আচরণ আমার অস্তিত্বকে আঘাত করছে। নিজের কানে নিজের উচ্চারণ শোনার একটা কাথার্টিক এফেক্ট আছে। এরপর অ্যাবিউজার যাই করুক না কেন আমি আমার অস্ত্র পেয়ে গিয়েছি। একবার ‘না’ বলতে পারলেই, দমনের বিরুদ্ধে ‘না বলার’ নেশা পেয়ে বসে। এতে আছে মুক্তির স্বাদ। সেটা যেমন জীবন শেখায়, তেমনই এই সিরিজ দেখতে গিয়ে আরও একবার টের পেলাম। ধন্যবাদ অদিতি রায় এবং সম্রাজ্ঞী বন্দ্যোপাধ্যায়কে। অনুজয় চট্টোপাধ্যায় এবং প্রিয়াঙ্কা সরকারের অভিনয় এই সব কিছুকে আরও অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছে। বাড়তি চমক দীপঙ্কর দে-র উপস্থিতি। 

এসএন 

Share this news on:

সর্বশেষ

img
তিন দফা দাবিতে কাঁথা-বালিশ নিয়ে জবি শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসে অবস্থান Apr 20, 2025
img
ফিফা চাইলে ৬৪ দলের বিশ্বকাপ আয়োজন করতে রাজি সৌদি আরব Apr 20, 2025
img
সিরাজগঞ্জে মামা-মামি-বোনকে হত্যার দায়ে যুবকের মৃত্যুদণ্ড Apr 20, 2025
img
নববধূ রেখাকে জুতাপেটা করে বরণ করেছিল শাশুড়ি Apr 20, 2025
img
নগরীর যানজট নিরসনে হকার ব্যবস্থাপনা জরুরি : চসিক মেয়র Apr 20, 2025
img
আজ খারাপ খেলেছি তাই বলা যাবে না তারা চেষ্টা করছে না : সালাউদ্দিন Apr 20, 2025
img
নারীর মরদেহের ময়নাতদন্ত নারী চিকিৎসক দিয়ে কেন নয় প্রশ্নে হাইকোর্টের রুল জারি Apr 20, 2025
img
সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বিপুর ৪৫ ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ, গাড়ি-এ্যাপার্টমেন্ট জব্দ Apr 20, 2025
img
চীনের সঙ্গে ঐতিহাসিক সম্পর্ক ২ হাজার বছরের পুরোনো : ঢাবি উপাচার্য Apr 20, 2025
img
নৌপরিবহন অধিদপ্তরের নতুন ডিজি শফিউল বারী Apr 20, 2025