ভারতে হিজাব খুলে মুসলিম তরুণীকে হয়রানি, কেন এমন মনোভাব?

ভারতের উত্তরপ্রদেশের মুজাফফরনগরে এক মুসলিম তরুণীকে জনসম্মুখে হিজাব খুলে হয়রানির ঘটনায় চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। ঘটনাস্থলের একটি ভিডিও সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হলে তা ঘিরে শুরু হয় দেশজুড়ে বিতর্ক।

ঘটনাটি ঘটে মুজাফফরনগরের দর্জিওয়ালা গলিতে। ভিডিওতে দেখা যায়, এক তরুণীকে ঘিরে ধরে রেখেছে কয়েকজন ব্যক্তি। তারা তাকে উদ্দেশ করে আপত্তিকর মন্তব্য করছে, ধাক্কাধাক্কি চলার মধ্যেই এক ব্যক্তি তার মাথা থেকে হিজাব খুলে নেয়। আশপাশে উপস্থিত লোকজন কেউ প্রতিবাদ না করে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেন।

এই ঘটনার পর সামাজিক মাধ্যমে প্রশ্ন উঠেছে—এর পেছনে কেমন মনোভাব কাজ করছে? ধর্মীয় পোশাকের প্রতি এমন আচরণে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অনেকে। বিষয়টি নিয়ে এখনো প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিস্তারিত কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

খবর পেয়ে পুলিশ দ্রুত সেই এলাকায় আসে। থানায় তরুণীর দায়ের করা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সেখান থেকে ছয় জনকে গ্রেফতার করা হয়।

গ্রেফতারকৃতদের নাম সরতাজ, শাদাব, উমর, আর্শ, শোয়েব ও শামি। তরুণী অভিযোগ জানানোর পরে সকলের পরিচয় সামনে আসে। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ২০ বছর বয়সী ওই তরুণী স্থানীয় খালপাড় এলাকার বাসিন্দা। শচীন নামে এক যুবকের সঙ্গে তিনি সেখান দিয়ে যাচ্ছিলেন।

তরুণীর মা একটি ব্যাংকে কাজ করেন। যুবক সেই ব্যাংকেরই কর্মী। ঋণ সংক্রান্ত কোনো একটি কাজে শচীনের সঙ্গে তার মেয়েকে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন ওই নারী। শচীন তরুণীকে মোটর বাইকে চাপিয়ে নিয়ে আসেন। এরপরই তাদের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার মুখে পড়তে হয়। পুলিশ এই ঘটনার তদন্ত করছে।

ভারতের উত্তরপ্রদেশ রাজ্যে কট্টর হিন্দুত্ববাদী মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার ক্ষমতায় রয়েছে। ২০১৭ সালে তিনি মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার আগেও এ রাজ্যে মুসলমানদের ওপর আক্রমণের ঘটনা সামনে এসেছে।

২০১৫ সালে দাদরিতে মোহাম্মদ আখলাকের হত্যা দেশকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। আখলাকের কাছে গোমাংস আছে, এই অভিযোগ তুলে একদল দুষ্কৃতি বাড়িতে হামলা চালিয়ে তাকে হত্যা করে। পরে দেখা যায় আখলাকের বাড়িতে আদৌ গোমাংস ছিল না। যোগী ক্ষমতায় আসার পর বার বার সংখ্যালঘু নিপীড়নের অভিযোগ উঠেছে।

তবে মুজাফফরনগরের ঘটনায় সকলে বিস্মিত এই কারণে, এক্ষেত্রে সংখ্যালঘু তরুণী নিজ সম্প্রদায়ের মানুষের হাতে নিগৃহীত হয়েছেন।

বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ তনভীর নাসরিন বলেন, এই ঘটনায় নিগৃহীতা ও নিগ্রহকারী উভয়ই মুসলমান ধর্মাবলম্বী। যারা নিগ্রহ করেছে তারা অন্য সম্প্রদায়ের মানুষ হলে আমরাই ঘটনার একটা ভিন্ন অর্থ খোঁজার চেষ্টা করতাম। এর দুটি দিক আছে। এর মধ্যে একটি অবশ্যই সাম্প্রদায়িক। নিগ্রহকারীরা ওই তরুণীর প্রতিবেশী। অন্য ধর্মের তরুণ সঙ্গে থাকায় তারা কোন প্রণয়ঘটিত সম্পর্কের কথা অনুমান করেছে। তাই মেয়েটির ওপর চড়াও হয়েছে। এটা খুবই ঘৃণ্য ব্যাপার।

তার মতে, এতে শুধু সম্প্রদায় নয়, সার্বিকভাবে নারীর প্রতি হীন মানসিকতা প্রকাশিত হয়েছে। এখানে মেয়েটিকে নিশানা করা হয়েছে। তার সম্প্রদায় মনে করছে, তরুণী কী করবেন, আচরণ কী হবে, সেটা তার সম্প্রদায়ের পিতৃতান্ত্রিক কর্তারা নির্ধারণ করে দেবে। তরুণী কোন প্রয়োজনে, কার সঙ্গে কোথায় গিয়েছিলেন, সেজন্য অন্য কারো কাছে জবাব দিতে তিনি বাধ্য নন।

ভারতে আইন আছে, সমাজে শৃঙ্খলা রয়েছে। সে সবকিছুকে অতিক্রম করে কয়েকজন পুরুষ একটি নিরাপরাধ মেয়েকে প্রকাশ্যে আক্রমণ করছে, এটা অত্যন্ত নিন্দাজনক।

আইএসএফ বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকী বলেন, বোরখা, হিজাব পরে অনেক নারী এখন কর্মক্ষেত্রে যান। তাদের ওপরে আক্রমণ নেমে আসছে। এর আগে গোমাংস খাওয়ার অভিযোগে উত্তরপ্রদেশে পিটিয়ে খুন করা হয়েছিল আখলাককে। যোগী সরকারের কাছে আমার অনুরোধ, যারা নারী নিগ্রহ করেছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হোক, যাতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি না হয়। নাগরিক যাতে তার অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে, সেটা সরকারকে দেখতে হবে। এসব ঘটনায় আন্তর্জাতিক স্তরে দেশের সম্মান ক্ষুণ্ন হচ্ছে। তাই যুদ্ধবিধ্বস্ত ফিলিস্তিনের তুলনায় ভারতের মানুষ কম সুখে আছে, এটা সমীক্ষায় উঠে এসেছে।

• ধর্ম নিয়ে উন্মাদনা উসকে দিচ্ছে এমন ঘটনা?

অতীতেও হিজাবকে কেন্দ্র করে বিতর্ক হয়েছিল ভারতে। ২০২২ সালে দক্ষিণ ভারতীয় রাজ্য কর্নাটকের স্কুলে হিজাব পরে আসা নিষিদ্ধ করা হয়। হিজাব আদৌ ইসলাম ধর্ম–সংস্কৃতির কোনও অংশ কি না, এ নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে ওঠে। হিজাব বাতিলের সেই সিদ্ধান্তের নেপথ্যে ছিল বিজেপি নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকার। অর্থাৎ এ সব অভিযোগ ছিল মূলত হিন্দু জাতীয়তাবাদী শক্তির বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে যারা সংখ্যালঘুদের ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিল বলে অনেকেরই মত। সেদিক থেকে মুজাফফরনগরের ঘটনা ব্যতিক্রমী।

নারী অধিকার আন্দোলনের কর্মী অধ্যাপক শাশ্বতী ঘোষ বলেন, ‘‘পরিস্থিতি এমন হয়েছে, জীবিকার প্রয়োজনে অন্য ধর্মের কারো সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন বা বন্ধুত্ব করা যাবে না!

মুজফফরনগরের ক্ষেত্রে অভিযুক্তরা মুসলমান সম্প্রদায়ের। তারা সংখ্যালঘু বলেই হয়তো নিজেদের সুরক্ষার ব্যাপারে বেশি আতঙ্কিত থাকেন। তাই এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। মেয়েটির প্রতি অসহিষ্ণুতা দেখানো হয়েছে। যাতে তরুণী যদি তার ধর্মের বাইরে গিয়ে কিছু করে ফেলেন। অর্থাৎ এক্ষেত্রে লাভ জিহাদের উল্টোটা। অন্য সম্প্রদায়ের মানুষ নয়, নিজের সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা নারীর হিজাব খুলে তাকে বেআব্রু করে দিচ্ছে, এটাই সবচেয়ে আশ্চর্যের।’’

তার বক্তব্য, ‘‘মেয়েদের যে উপার্জন দরকার, সব নারীকে বসিয়ে খাওয়ানোর মতো মাথার উপরে পুরুষ নেই, এটা এই সমাজ মানতে চাইছে না। যারা নীতিপুলিশি চালায়, তারা মেয়েদের ওপর শাস্তির খাঁড়া নামিয়ে আনছে, যদি তারা জীবিকার প্রয়োজনে কোনো পুরুষের সঙ্গে যোগাযোগ করে। কিছুদিন আগে ট্রেনে এক পুরুষের সঙ্গে কথা বলার জন্য নারীর গ্রামে সালিশি সভা বসানো হয়েছিল, তিনি কেন কথা বলেছেন! এই মেয়েরা সংখ্যালঘু হলে তাদের উপর শাস্তির খাঁড়া আরও নিষ্ঠুরভাবে নেমে আসছে।’’

মানবাধিকার কর্মী রঞ্জিত শূর বলেন, ‘‘ধর্ম ধর্ম করে দেশে একটা উন্মাদনা তৈরি করেছেন ধর্মগুরু থেকে রাজনীতিকরা। এর শিকার হচ্ছে কমবয়েসী ছেলেমেয়েরা। ফলে একজন নারী ভিন্ন ধর্মাবলম্বী কোনো পুরুষের সঙ্গে কাজের সূত্রে যুক্ত হলেও অনেকে সেটা সহ্য করতে পারছে না। যদি কোনো নারী ভিন্ন সম্প্রদায়ের কোনো পুরুষের সঙ্গে ঘুরতেও যান, তাহলেও এভাবে লাঞ্ছনা করার অধিকার জন্মায় না। এটা ধর্মীয় উন্মাদনা থেকে তৈরি হয়েছে। হিন্দুদের ক্ষেত্রে মনুবাদী সংস্কৃতি আর মুসলমানদের ক্ষেত্রে মৌলবাদী ভাবনার ফলে এমন ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটছে।

এরা মানবাধিকার কেন, নারীর অধিকার, জীবনের অধিকার, কোনো কিছুর তোয়াক্কা করছে না।

• কিন্তু নারীরা কীভাবে তাহলে সুরক্ষিত থাকতে পারবেন?

তনভীর বলেন, ‘‘এই ভিডিওটা অত্যন্ত আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে আমার মধ্যে। নিরাপদ কীভাবে থাকা সম্ভব, সে প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। কারাতে বা জুডো শিখে, হাতে লঙ্কার গুঁড়ো নিয়ে ঘুরে বেড়িয়ে আসলে কিছু হবে না। লঙ্কার গুঁড়ো নিয়ে যদি ঘুরতে হয়, তাহলে ধরে নিতে হবে সমাজ নারীর জন্য অসুরক্ষিত। এর প্রতিকার প্রশাসনকে করতে হবে। যেখানে এমন নিগ্রহ ঘটবে, সেখানে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।’’

আরএ

Share this news on:

সর্বশেষ

img
আধুনিক যুদ্ধের নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে মনুষ্যবিহীন ড্রোন Jul 01, 2025
img
‘হেরা ফেরি ৩’-এ পারিশ্রমিক নিয়ে কাড়াকাড়ি, পিছিয়ে সুনীল শেট্টি Jul 01, 2025
img
ছাত্র আন্দোলনের অগ্রদূত হাসনাতের জুলাই নিয়ে কিছু কথা Jul 01, 2025
img
একদিনে দুই জনপ্রিয় অভিনেত্রীর বিবাহবিচ্ছেদ Jul 01, 2025
img
যেকোনো মূল্যে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে হবে : খালেদা জিয়া Jul 01, 2025
img
পিআর নির্বাচনব্যবস্থা কতটা উপযোগী, ভেবে দেখতে বললেন তারেক রহমান Jul 01, 2025
img
বরগুনায় বিএনপির দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত ১৪ Jul 01, 2025
img
জনগণের শক্তি ফিরিয়ে দিতে দ্রুত নির্বাচন দিতে হবে: অধ্যাপক নার্গিস Jul 01, 2025
img
পিরোজপুরে পরীক্ষার হল থেকে উত্তরপত্র নিয়ে পালালেন শিক্ষার্থী Jul 01, 2025
img
বিডিআর হত্যাকাণ্ড তদন্তে কমিশনের মেয়াদ আরো বাড়ল Jul 01, 2025
img
শহীদের চেতনায় দেশকে উপলব্ধি করার আহ্বান তারেক রহমানের Jul 01, 2025
img
জুলাই শহীদদের তালিকায় যুক্ত হলো আরো ১০ শহীদের নাম Jul 01, 2025
img
স্ক্রিপ্ট নয়, স্ক্রিন ভাগাভাগি নিয়েই এখন চলছে রাজনীতি Jul 01, 2025
গোপনে ট্রিপ প্ল্যান করলেন তিন খান Jul 01, 2025
তিন প্রজন্মের দেওলদের দেখা যাবে ‘আপনে ২’ সিনেমায় Jul 01, 2025
সরকারি ভর্তুকি বন্ধে ট্রাম্পের হুঁশিয়ারি, মাস্কের জবাব, ‘সবই তুলে দিন’ Jul 01, 2025
ইন্টেরিমের কাছে জুলাই কে ছেড়ে দেয়া যাবে না: হাদি Jul 01, 2025
জুলাই শুধু সরকার পতনের নয়,ছিল নতুন বন্দোবস্তের আন্দোলন Jul 01, 2025
img
আলোচিত সেই কাজলের সঙ্গে আরিফিন শুভ Jul 01, 2025
img
বিএনপিকে দোষারোপ করে কোনো ঐক্যের ডাক সহায়ক হবে না: মির্জা ফখরুল Jul 01, 2025