সাধারণত মসজিদের কথা বললে অমাদের চোখে ভেসে উঠে গম্বুজ, উঁচু মিনার আর চকচকে সাদা মার্বেলের চিত্র। কিন্তু কাশ্মিরের কিছু মসজিদ আমাদের প্রচলিত মসজিদের ধারণা থেকে একেবারেই ভিন্ন। কাশ্মিরের কিছু অঞ্চলের মসজিদ, খানকাহ ও দরগাগুলোর স্থাপত্যশৈলী অনেকটাই আলাদা।
এখানে গম্বুজের বদলে দেখা যায় পিরামিড আকৃতির ছাদ, আর মার্বেল বা পাথরের পরিবর্তে ব্যবহৃত হয় সুন্দর নকশাকৃত কাঠ।
এই মসজিদগুলো শুধু নামাজ পড়ার জায়গা নয়, কাশ্মির অঞ্চলের সংস্কৃতি, নির্মাণশৈলী আর আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি।
কাশ্মীরের মসজিদ, খানকাহ এবং দরগাগুলোর স্থাপত্যশৈলী কেন অন্য মুসলিম ধর্মীয় স্থাপনাগুলোর থেকে আলাদা কেন?— এই প্রশ্ন যে কারোর মনেই জাগতে পারে।
এর উত্তর হতে পারে, কাশ্মীরের ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের ভিত্তিতে। কাশ্মীরের স্থাপত্যে ইসলামপূর্ব হিন্দু ও বৌদ্ধ স্থাপত্যের প্রভাব, স্থানীয় কাঠ ও আবহাওয়ার উপযোগী নির্মাণশৈলী, আর মধ্য এশিয়ার সুফি সংস্কৃতির সংমিশ্রণ দেখা যায়।
এই ভিন্ন ধাঁচের নির্মাণশৈলী কাশ্মীরি মুসলিম পরিচয়ের এক অনন্য রূপ, যা স্থানীয় ঐতিহ্য ও ইসলামি রুচির এক সুদৃঢ় মেলবন্ধন।
চতুর্দশ শতকে কাশ্মীরে ইসলামের আগমন। এর আগে অঞ্চলটিতে প্রথমে বৌদ্ধ ধর্ম এবং পরে হিন্দু ধর্মের প্রাধান্য ছিল। কাশ্মীরের মসজিদগুলো দেখতে হিন্দু মন্দিরের মতো নয়, এবং নির্মাণে ব্যবহৃত উপকরণও ভিন্ন—তবুও এর স্থাপত্যশৈলীতে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব রয়েছে বলে মনে করা হয়।
ইতিহাসবিদদের মতে— কাশ্মীরের মসজিদগুলোর ছাদ পিরামিড আকারের, কাঠ ব্যবহৃত হয় প্রচুর, যা বৌদ্ধ গুম্বজ বা প্যাগোডা আকৃতির স্থাপত্যের সঙ্গে কিছটা মিলে যায়। এই ধরনের ছাদ কাঠামো বৌদ্ধ ও তিব্বতি প্রভাব বহন করে।
এছাড়া স্থানীয় জলবায়ু ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে সুরক্ষার জন্য উপযোগী নির্মাণশৈলীর কারণে কাঠের ব্যবহার হয়েছে বেশি। ফলে বলা যায়, কাশ্মীরি মসজিদগুলোর স্থাপত্যশৈলীতে ইসলামি ভাবনার পাশাপাশি বৌদ্ধ ও স্থানীয় ঐতিহ্যেরও একটি ছাপ রয়েছে।
ভারতের নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ট্রাস্ট ফর আর্ট অ্যান্ড কালচারাল হেরিটেজ -এর পরিচালক হাকিম সামির হামদানি যিনি কাশ্মীরের ধর্মীয় স্থাপত্য নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি বলেন, ‘কাশ্মীরের মুসলিম ধর্মীয় স্থাপনাগুলোর দিকে তাকালে এক ধরনের বিবর্তন প্রক্রিয়া চোখে পড়ে, যেখানে হিন্দু মন্দিরের ছাপ যেমন দেখা যায়, তেমনি বৌদ্ধ স্থাপত্যশৈলীর প্রভাবও রয়েছে।’
হামদানির মতে, স্থাপত্যশৈলীর দৃষ্টিকোণ থেকে বৌদ্ধধর্ম, হিন্দুধর্ম এবং ইসলাম—এই তিনটি ধর্মেই এক ধরনের ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করা যায়।
‘কাশ্মীরের মসজিদ, খানকাহ ও দরগাহগুলোর কথা বলতে গেলে দেখা যায়, এগুলোর গড়ন সেই ধরনের, যেমনটা আগে এখানকার মন্দিরগুলোর ছিল। পার্থক্যটা কেবল নির্মাণ উপকরণে। কাশ্মীরে আজও মধ্যযুগীয় যুগের মন্দির রয়েছে, যেগুলো মূলত পাথরের তৈরি।
‘অন্যদিকে, আমরা আজ যেসব মসজিদ বা আস্থানাগুলো দেখি, সেগুলো অধিকাংশই কাঠের তৈরি। অর্থাৎ নির্মাণসামগ্রীর দিক থেকে পার্থক্য রয়েছে, কিন্তু আইকনোগ্রাফি, স্থাপত্যশৈলী ও নান্দনিকতায় একটি ঐতিহ্যগত ধারাবাহিকতা বিদ্যমান।’
তিনি আরও বলেন, ‘এসব স্থাপনায় যে মোটিফ বা নকশাগুলো দেখা যায়, সেগুলো ইরানি সংস্কৃতির দ্বারা যথেষ্ট প্রভাবিত—যেমন খতম বন্ধ (জ্যামিতিক নকশা), নকশিকাজ ইত্যাদি। তবে স্থাপনাগুলোর সামগ্রিক গড়ন অনেকটাই হিন্দু মন্দিরের মতো।’
এই কথাগুলো থেকে এটাই বোঝা যায় যে, কাশ্মীরের প্রাচীন মন্দির ও মুসলিম উপাসনালয়গুলোর স্থাপত্যশৈলীতে একটি ধারাবাহিকতা বা ঐতিহাসিক যোগসূত্র রয়েছে।
মদিন সিবুন (মাদিন সাহেব মসজিদ)
প্রাচীন কাশ্মীরি মসজিদগুলোর অন্যতম মদিন সাহিব মসজিদ। যা আজও সেভাবেই সংরক্ষিত রয়েছে, যেভাবে নির্মাণ করা হয়েছিল।
এই মসজিদটি ১৪৪০ সালে নির্মাণ করেন সৈয়দ মুহাম্মদ মাদানী। তিনি একজন ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন এবং তৎকালীন তিমূরীয় সাম্রাজ্যের অধীনে কাশ্মীরের সুলতান সুলতান সিকান্দার ও সুলতান জাইনুল আবেদীনের দরবারে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেন।
সমীর হামদানির ভাষ্যমতে, ‘এই মসজিদটির গঠন পুরোদস্তুর একটি মন্দিরের মতো। এটি একেবারে চতুষ্কোণ। এর প্রবেশপথে দুটি স্তম্ভ রয়েছে, এবং সেখানে যে ধরনের মিহরাব দেখা যায় তা মুসলিম স্থাপত্যে সচরাচর দেখা যায় না। এটি “ট্রাইফয়েল আর্চ” নামে পরিচিত—এটি এমন এক ধরনের মেহরাব যেটি তিনটি খণ্ডে বিভক্ত হয়ে গঠিত হয়। আপনি যদি কাশ্মীরের পুরোনো কোনো মন্দির যেমন—মারতান্ড বা আওন্তীপোরা দেখেন, তাহলে দেখতে পাবেন সেখানেও হুবহু এমন মেহরাব রয়েছে। এমনকি কোণার দিকে থাকা প্লাস্টারগুলিও মন্দিরগুলোর মতোই।’
এতে বোঝা যায়, কাশ্মীরি মসজিদগুলোর স্থাপত্যে হিন্দু মন্দিরের প্রভাব ঐতিহাসিকভাবেই সুস্পষ্ট।
তিনি বলেন, এই মসজিদের উপরের ছাদের স্থাপত্যশৈলী আমরা দশম শতকে নির্মিত “আলচি” নামক স্থানে এক বৌদ্ধ উপাসনালয়ে দেখতে পাই, যেটি কাশ্মীরি কারিগরদের মাধ্যমে নির্মিত হয়েছিল। দুইটি স্থাপনার মধ্যে পার্থক্য হলো—আলচির বৌদ্ধ মন্দিরে বিভিন্ন আকার-আকৃতির মূর্তি বা অলঙ্করণ দেখা যায়, কিন্তু এই মসজিদে কোনো ধরনের মূর্তি নেই।
‘এর ছাদটি ঐতিহ্যবাহী কাশ্মীরি ছাদ, যাকে আমরা “বর্জ পুশ” বলে থাকি। ছাদের উপরে একটি পিরামিড-আকৃতির অংশ নির্মাণ করা হয়েছে, যাকে বলা হয় “বরং”। এই অংশটি আপনি প্রতিটি প্রাচীন কাশ্মীরি মন্দিরেই দেখতে পাবেন। পার্থক্য শুধু এটুকু যে, মসজিদটি আকারে অনেক বড়।’
তার দাবি অনুযায়ী, এই মসজিদের আয়তন খানায়ে কাবার আয়তনের সাথে প্রায় মিল রয়েছে।
এই বিবরণগুলো স্পষ্ট করে দেয় যে কাশ্মীরি মুসলিম স্থাপত্যে প্রাচীন হিন্দু ও বৌদ্ধ ঐতিহ্যের গভীর ছাপ রয়েছে, কিন্তু সেই ছাপ ধর্মীয় উপস্থাপনায় নয়, বরং নকশা, কাঠামো ও উপাদানে সীমাবদ্ধ।
খানকাহ-ই-মোয়াল্লা, শ্রীনগর
এটি প্রাচীন কাশ্মীরি স্থাপত্যশৈলীর এক অপূর্ব নিদর্শন। এই খানকাহ (ধর্মীয় আধ্যাত্মিক কেন্দ্র) চতুর্দশ শতকের শেষ দিকে মীর মুহাম্মদ হামাদানী প্রতিষ্ঠা করেন সুলতান সিকান্দর শাহের শাসনামলে।
এখানে আগে মীর সাইয়্যেদ আলী হামাদানীর আবাস ছিল, যাঁকে কাশ্মীরে “শাহে হামাদান” নামে ডাকা হয়।
হামাদানী বলেন, ‘আপনি যদি এর স্থাপত্যশৈলী লক্ষ্য করেন, তাহলে দেখবেন এখানেও সেই পিরামিড-আকৃতির ছাদ রয়েছে, যেটিকে আমরা "বরং" বলি। তার উপরে একটি ছাতা-আকৃতির উপাদান আছে, যেটাকে কাশ্মীরি ভাষায় “দস্তার” বলা হয়। কাশ্মীরি মন্দিরগুলোতেও এই উপাদান থাকে এবং সেখানে একে “কলশ” বলা হয়।’
এই বিবরণ থেকে বোঝা যায়, কাশ্মীরি ইসলামী স্থাপত্য কেবল ধর্মীয় পরিমণ্ডলেই নয়, বরং আঞ্চলিক ঐতিহ্য ও নান্দনিকতায়ও গভীরভাবে শিকড় গেড়েছে।
খানকাহও চতুষ্কোণ আকৃতির, ঠিক যেমনটি একটি মন্দিরের আকার হয়ে থাকে। পার্থক্য কেবল এটুকু যে, এটি কাঠের তৈরি, এবং এটি কাশ্মীরের কাঠের নির্মাণশৈলীর একটি শ্রেষ্ঠ উদাহরণ।
আরেকটি পার্থক্য হলো, এর আকার মন্দিরের চেয়ে বড়। এর কারণ হলো, মসজিদে মুসলমানরা যৌথভাবে উপাসনা করে, বা জামাতে নামাজ পড়েন, তাই বড় জায়গার প্রয়োজন হয়। তবে মন্দিরে সাধারনত এককভাবে উপাসনা করা হয়, তাই তার আকার ছোট হয়।
‘অর্থাৎ, আকার এবং নির্মাণ উপকরণ পরিবর্তিত হয়েছে, কিন্তু মৌলিক উপাদানগুলো মোটামুটি মন্দিরের মতোই রয়েছে।’
এই কথাগুলো কাশ্মীরের ধর্মীয় স্থাপত্যের বিশেষত্ব এবং তার ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা পরিষ্কারভাবে তুলে ধরে।
ইয়াল মসজিদ (উঁচু মসজিদ)
জামে মসজিদের পর, কাশ্মীরের ঐতিহ্যবাহী মসজিদগুলির মধ্যে এটি সবচেয়ে বড় মসজিদ। এটি ১৪৭০ সালের সুলতান হাসান শাহের শাসনামলে নির্মিত হয়েছিল।
হামাদানী বলেন, "ইয়াল মসজিদে আপনি দেখতে পাবেন যে কাশ্মীরি স্থাপত্যশৈলীতে ধীরে ধীরে ইরানি স্থাপত্যের প্রভাব যুক্ত হচ্ছে।"
তাঁর মতে, এই মসজিদটি দুইবার ধ্বংস হয়েছে। প্রথমবার এটি পুনঃনির্মাণ করা হয় মোগল শাসক জাহাঙ্গীরের শাসনকালে এবং দ্বিতীয়বার এটি পুনঃনির্মাণ করা হয় ১৮ শতকে আফগান শাসনের সময়, সর্দার গোল আহমদের শাসনামলে।
হামাদানী একটি আকর্ষণীয় বিষয় উল্লেখ করেন যে, এই মসজিদটি একটি ঈদগাহে অবস্থিত, যদিও সাধারণত ঈদগাহে মসজিদ নির্মাণ করা হয় না। সেখানে সাধারণত শুধু নামাজগাহ, কিবলামুখী স্থান বা মেহরাব তৈরি করা হয়।
এই মসজিদ কেবল কাশ্মীরি স্থাপত্যের একটি অসাধারণ উদাহরণ নয়, বরং এর ঐতিহাসিক গুরুত্বও অত্যন্ত ব্যাপক।
জামে মসজিদ (গ্র্যান্ড মসজিদ)
কাশ্মীরের ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলির মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং সুন্দর হিসেবে গণ্য করা হয় জামে মসজিদকে।
এই মসজিদটি ১৪০২ সালে নির্মিত হয়েছিল। এর নির্মাণে শাহি হামদান (রহ.) এর পুত্র মীর মোহাম্মদ আলী হামদানি ছিলেন সহকারী।
এই মসজিদের স্থাপত্যশৈলী ও নকশা ইরানি মসজিদগুলোর সঙ্গে মিলে যায়। পার্থক্য এতোটুকু যে এই মসজিদে পাথরের বদলে কাঠের স্তম্ভ এবং ছাদ ব্যবহৃত হয়েছে।
এই ধরনের নকশার প্রথম উদাহরণ ছিল সেলজুক যুগে ইরানের ইসফাহান শহরে। এরপর যেসব স্থানে ইরানি সংস্কৃতির প্রভাব বিস্তার হয়েছিল সেখানে এ ধরনের মসজিদ নির্মিত হয়েছে ।
কাশ্মিরিদের ইতিহাসে বড় গর্বের সঙ্গে লেখা হয়— এই ধরনের এবং আকারের মসজিদ পৃথিবীতে আর কোথাও নেই। না ভারতবর্ষে, না খোরাসানে, না ইরানে। তবে হয়তো মিসর বা সিরিয়াতে এই ধরনের কোন মসজিদ পাওয়া যেতে পারে।"
এই মসজিদের মৌলিক গঠন ইরানি হলেও, এর স্থাপত্যশৈলী সম্পূর্ণ কাশ্মিরি, যেখানে মিনার এবং গম্বুজের পরিবর্তে "বরং" (এক ধরনের কাঠামো) রয়েছে।
এসএম/টিএ