যে কারণে সৌদি আরবে অবৈধ হচ্ছেন বাংলাদেশি প্রবাসীরা

দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে কার্যকরী ভূমিকা রাখছেন প্রবাসীরা। বিশ্বের ১৬৮টি দেশে অবস্থারত প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স দেশকে এগিয়ে নিচ্ছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসও বিষয়টি স্বীকার করেছেন।

গতকাল বৃহস্পতিবার (২৪ এপ্রিল) প্রধান উপদেষ্টা কাতারে প্রবাসীদের এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘প্রবাসীদের সহযোগিতার কারণে বাংলাদেশের ভঙ্গুর অর্থনীতি আবার ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে।

আমরা আজ যে শক্ত হয়ে দাঁড়াতে পেরেছি তার মূলে প্রবাসীরা। প্রবাসীরা সহযোগিতা না করলে আমরা আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারতাম না।’

দেশের অর্থনীতিতে প্রবাসীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকলেও সময়ের সঙ্গে বাড়ছে প্রবাসীদের সমস্যা। দালাল ও অসাধু চক্রের খপ্পরে প্রবাসীরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গিয়ে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন।

বিশেষ করে সৌদি শ্রমবাজারে প্রবাসী বাংলাদেশিরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটিতে বাংলাদেশ থেকে সর্বোচ্চ সংখ্যক প্রবাসীর বসবাস। এই ধারা সময়ের সঙ্গে বাড়ছে। দেশটিতে প্রবাসী শ্রমিকের সংখ্যা বাড়লেও কমছে রেমিট্যান্স প্রবাহ।

যার প্রধান কারণ ‘ওয়ার্ক পারমিট ও আকামা’ সমস্যা।

দিনাজপুরের ইয়াসিন আলী দালালকে ধরে গতবছরে সৌদি আরবে যান। দালাল সৌদি আরবে পাঠানোর সময় ভালো কম্পানিতে কাজ ও এক বছরের আকামা দেওয়ার নিশ্চয়তা দেয়। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পর তিনি দেখেন আকামার মেয়াদ মাত্র তিন মাসের। তারপর তাকে ফের আকামা নবায়ন করতে হয়।

তিনি কালের গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আকামার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর আমি অবৈধ হয়ে যাই। বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে আমি আকামা নবায়ন করেছি। যেটা আমার জন্য অনেক কষ্টের। কারণ সৌদি আরবে আসার সময় দালালকে ৪ লাখ ৩০ হাজার দেই। পরে আকামা নবায়নে আরো দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা লেগেছে।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সৌদি আরব শ্রমবাজারে বাংলাদেশি প্রবাসী কর্মীদের সবথেকে বড় সমস্যা ওয়ার্ক পারমিট। দালালরা কাজের কথা বলে দেশটিতে নিলেও কাজ দিতে ব্যর্থ হয় বা ভুক্তভোগী প্রবাসীকে কাজ খোঁজার জন্য বলে থাকে। এ ছাড়াও এক বছরের আকামার কথা মুখে বললেও দিয়ে থাকেন তিন মাস। ফলে নির্ষিষ্ট সময় পর প্রবাসীরা অবৈধ হয়ে যান। অনেকে বাড়ি থেকে আকামা করতে পারলেও অধিকাংশ প্রবাসী অর্থের অভাবে আকামা করতে ব্যর্থ হোন। পরে সৌদি আরবের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে অনেকে কাজ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু একসময় তারা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হয়ে দেশে ফিরতে বাধ্য হন। এ ছাড়া অনেকে নিজ উদ্যোগে দেশে ফিরে আসেন।

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্যমতে, চলতি বছরে এখন পর্যন্ত সৌদি আরবে গেছেন ১ লাখ ২০ হাজার ৮৭৬ জন, গত বছর দেশটিতে গেছেন ৬ লাখ ২৮ হাজার ৫৬৪ জন এবং ২০১৩ সালে গেছেন ৪ লাখ ৯৭ হাজার ৬৭৪ জন বাংলাদেশি। দেশটিতে বিপুল সংখ্যক প্রবাসী গেলেও ফিরে আসার হারটাও অনেক বেশি। ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের তথ্যমতে, সৌদি আরব থেকে ২০২৪ সালে আউটপাসে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে ৫০ হাজার ২৩১ জনকে। আর ২০২৩ সালে ফেরত আসেন ৫৮ হাজার ৮৯৭ প্রবাসী। এই প্রবাসীদের অধিকাংশই অবৈধ হয়ে দেশটিতে ছিলেন।

সৌদি আরবে কেন বাংলাদেশি প্রবাসীরা অবৈধ হচ্ছেন বিষয়টি সম্পর্কে সৌদি আরবের জাজান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও প্রবাসী এবং অভিবাসীবিষয়ক গবেষক ড. হোসাইন আহমেদ লিটন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রতিদিন শত শত প্রবাসী আকামা-সংকটের সমাধানে সৌদি আরবে বাংলাদেশের দূতাবাসে ভিড় করেন। কিন্তু দূতাবাস থেকে পর্যাপ্ত সহযোগিতা মিলেনা এমনটি অভিযোগ করেন। শ্রমিকদের প্রধান অভিযোগ, ঢাকা থেকে রিক্রুটিং এজেন্সি ও তাদের দালালরা প্রতারণা করে শ্রমিকদের সৌদিতে পাঠান। এখানে ১ হাজার বা তারও বেশি রিয়ালের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও দেওয়া হয় ৫০০ কিংবা ৭০০ রিয়াল। সৌদি আরবের প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিকদের বড় একটি অংশ এখন অবৈধ। এ দেশের পুলিশের অভিযানে প্রায়শই বাংলাদেশি গ্রেপ্তার হচ্ছেন।’

সৌদি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মোতাবেক আবাসন, শ্রম ও সীমান্ত আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে দেশটিতে প্রতিনিয়ত গ্রেফাতর অভিযান চালানো হয়। এসব অভিযানে বাংলাদেশিরা নিয়মিত আটক হচ্ছেন। আকামা মেয়াদ না থাকা, শ্রম আইন লঙ্ঘনের জন্য বাংলাদেশিদের গ্রেফতার করা হয়। পরে সাজা শেষে অনেককে দেশে পাঠানো হয়।

অভিবাসন বিশেষজ্ঞদের মতে, সৌদি শ্রমবাজার অবৈধ শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ছে। একইসঙ্গে বাড়ছে জেলে যাওয়া শ্রমিকের সংখ্যা। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে শ্রমবাজারটিতে। দেশটি থেকে বাংলাদেশিদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে। আকামা না থাকা, প্রতারিত হয়ে জেল খেটে প্রবাসীরা দেশে ফিরছেন। এই অবস্থা থেকে উত্তোরণে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে। প্রবাসীদের স্বার্থ সুরক্ষায় আরো বেশি যত্নশীল হওয়া প্রয়োজন।’ 

এসএম/টিএ

Share this news on:

সর্বশেষ

img
প্রথম দেখায় ধর্মেন্দ্রর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছিলেন হেমা মালিনী Nov 26, 2025
img
দেশের মানুষ খালেদা জিয়াকে নেতৃত্বের আসনে দেখতে চায় : রিজভী Nov 26, 2025
img
লটারিতে ৬৪ জেলার এসপি পদায়ন করলো সরকার Nov 26, 2025
img
দক্ষতা অর্জনের প্রধান উপায় হলো প্রশিক্ষণ : সালেহ আহমেদ Nov 26, 2025
img
কর্ণফুলী টানেলের মেইনটেন্যান্স কাজের জন্য রাতভর ট্রাফিক ডাইভারসন Nov 26, 2025
img
অপরিচিতদের সচিবালয়ে প্রবেশ পাস না দিতে চিঠি Nov 26, 2025
img
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামার ‘ফটোশ্যুট’ ঘিরে তোলপাড় Nov 26, 2025
img
লটারির মাধ্যমে এসপি নিয়োগে মেধাবী কেউ বাদ পড়েনি : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা Nov 26, 2025
img
ব্যাংক ও কোম্পানির কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ নিয়ে নতুন নির্দেশনা Nov 26, 2025
img
সড়কে চাঁদাবাজি বন্ধ না হলেও নিয়ন্ত্রণে এসেছে : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা Nov 26, 2025
img
শিগগির গঠিত হচ্ছে এনসিপির উপদেষ্টা পরিষদ, শুরু ১০ জন দিয়ে Nov 26, 2025
img
না ফেরার দেশে ‘হাই কিক’ খ্যাত অভিনেতা লি সুন Nov 26, 2025
img
উত্তর বঙ্গোপসাগরে নৌকা ও ট্রলার বিচরণে সতর্কতা Nov 26, 2025
img
৪৭তম বিসিএস: লিখিত পরীক্ষা পেছানোর দাবিতে ফের যমুনা অভিমুখে মিছিলের ডাক Nov 26, 2025
img
কী আছে হোয়াটসঅ্যাপের ‘অ্যাবাউট’ ফিচারে! Nov 26, 2025
img
ভবিষ্যতে শ্রদ্ধা ও আলিয়া ভাটের বড় পর্দায় জুটি বাঁধার সম্ভাবনা Nov 26, 2025
img
আশুলিয়ায় ঘটনায় চলছে ২০তম দিনের সাক্ষ্য Nov 26, 2025
img
বিএনপি নেতা ফজলুর বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আদালত অবমাননার অভিযোগ Nov 26, 2025
img
বিশ্বব্যাপী ৪ হাজার থেকে ৬ হাজার কর্মী ছাঁটাই করবে এইচপি, আস্থা এআইতে! Nov 26, 2025
img
রিমেক নয়, নতুন কাহিনী নিয়ে হাজির মেগা স্টার পবন কল্যাণ Nov 26, 2025