বেতন বকেয়ার প্রতিবাদে দুই সপ্তাহ ধরে কর্মবিরতি শ্রমিকদের

শ্রমিক নির্যাতন, অব্যবস্থাপনা ও অর্থ লোপাটে ডুবতে বসেছে দেশের অন্যতম জনপ্রিয় খাদ্যপণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ফু-ওয়াং ফুডস।শ্রমিকদের অভিযোগ, তিন মাস ধরে তাঁরা বেতন পাচ্ছেন না। বেতন না দিয়ে উল্টো চাকরিচ্যুত করা হচ্ছে। মামলাও দেওয়া হচ্ছে।

বছরের পর বছর ঘুরেও গ্র্যাচুইটি ও প্রভিডেন্ট ফান্ডের (পিএফ) টাকা পাচ্ছেন না শ্রমিকরা।

কারখানার একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, প্রভিডেন্ট ফান্ডের ১২ কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিয়া মামুন। এমন পরিস্থিতিতে ১৫ দিন ধরে লাগাতার কর্মবিরতি পালন করছেন শ্রমিকরা। তবে মালিকপক্ষ সমস্যার সমাধান না করে উল্টো হুমকি-ধমকি দিচ্ছে শ্রমিকদের।

শ্রমিকরা গতকাল জানান, বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিয়া মামুন দায়িত্ব নেওয়ার পর তিন বছর ধরে এই দুরবস্থা তৈরি হয়েছে। এমারেল্ড অয়েল ও ফু-ওয়াং ফুডসের শেয়ার কারসাজির জন্য বিভিন্ন সময়ে বিতর্কিত হন তিনি। ছিলেন পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের ঘনিষ্ঠজন। অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর পুলিশ মিয়া মামুনকে গ্রেফতার করে।

আদালত থেকে জামিন পেয়ে অনেকটাই আত্মগোপনে আছেন এই মামুন।

গতকাল দুপুরে গাজীপুর সদর উপজেলার হোতাপাড়ায় অবস্থিত ফু-ওয়াং ফুডসে গিয়ে দেখা গেছে. কারখানার সামনে অবস্থান ধর্মঘট করছেন শ্রমিকরা। পাশেই পুলিশের সতর্ক অবস্থান। সুপারভাইজার নাহিদসহ একাধিক শ্রমিক জানান, ফেব্রুয়ারি ও মার্চের বেতন এবং ঈদ বোনাস না পেয়ে গত রোজায় আন্দোলনে নামেন তাঁরা। ওই সময় পুলিশ ও প্রশাসনের মধ্যস্থতায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল, ঈদ বোনাস ও ফেব্রুয়ারি মাসের বেতন ঈদের ছুটির আগেই পরিশোধ করবে কর্তৃপক্ষ।

২০ এপ্রিল দেওয়া হয় মার্চের বেতন। কিন্তু ঈদের আগে অনেক শ্রমিক ফেব্রুয়ারির বেতন ও ঈদ বোনাস পাননি। এপ্রিল মাস শেষ হতে চললেও এখনো দেওয়া হয়নি মার্চের বেতন। পিএফের টাকা চাওয়ায় তিন মাস আগে ১২ জন এবং ঈদের আগে ২৪২ জনকে ছাঁটাই করা হয়। ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফোন করে আরো অনেককে ছাঁটাই ও মামলার হুমকি দিচ্ছেন। এ অবস্থায় বাধ্য হয়ে নির্যাতিত শ্রমিকরা গত ১২ এপ্রিল থেকে কর্মবিরতি পালন করছেন।

সহকারী সুপারভাইজার মো. শামীম বলেন, তিন মাস আগে এক নারী অপারেটরের গায়ে হাত তোলেন কারখানার প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. নুরুজ্জামান। প্রতিবাদ করায় লজিস্টিক ম্যানেজার নোয়াব আলী, প্রোডাকশন ম্যানেজার মুজিবুর রহমান, শিফট ইনচার্জ ইজাদুর রহমান, ফারুক হোসেন ও সিনিয়র ড্রাইভার মো. সুজনসহ ১০ জনকে বিনা নোটিশে ছাঁটাই করে মামলা দেওয়া হয়। এখনো তাঁদের গ্র্যাচুইটি, প্রভিডেন্ট ফান্ডসহ অন্যান্য পাওনা পরিশোধ করা হয়নি।

অপারেটর আপেল মাহমুদ বলেন, আগের মালিক প্রতি মাসের ৮ তারিখের মধ্যে বেতন-ভাতা পরিশোধ করতেন। এখন পরিস্থিতি উল্টো। শ্রমিকরা বেতন পাচ্ছেন না। গ্র্যাচুইটি ও পিএফের টাকা মিলছে না। ঈদের আগে বেতন-বোনাসের জন্য আন্দোলন করায় গোপনে ২৪২ জনকে ছাঁটাই করা হয়। ঈদের ছুটি শেষে কারখানায় ঢুকতে গেলে ওই ২৪২ জনকে বাধা দিয়ে ছাঁটাইয়ের কথা জানানো হয়। ছাঁটাই করলে নিয়ম অনুযায়ী বেতন-ভাতা পাওয়ার কথা। অথচ কেউ এক টাকাও পাননি। কর্মবিরতি তুলে নিতে ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিজে এবং বহিরাগত লোক দিয়ে হুমকি দিচ্ছেন। কারখানার জেনারেটরের তার কেটে শ্রমিকদের বিরুদ্ধে মামলা করার পাঁয়তারাও চলছে।

শ্রমিক সাদেকুল ইসলাম বলেন, কয়েক দিন আগে সুপারভাইজার হাসান স্ট্রোক করে ফ্লোরে পড়ে যান। তাঁর চিকিৎসায় কোনো সহায়তা করেনি কর্তৃপক্ষ।

সাবেক মিক্সচার সুপারভাইজার মো. জসিম উদ্দিন (৫২) জানান, ২৫ বছর হওয়ায় তিন বছর আগে চাকরি থেকে ইস্তফা দেন। প্রভিডেন্ট ফান্ড ও গ্র্যাচুইটি মিলিয়ে ১১ লাখ টাকা পাবেন। তিন মাসের মধ্যে পাওনা বুঝিয়ে দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা পাননি। কারখানায় গেলে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। পাঁচ সদস্যের পরিবার নিয়ে তাই চরম দুর্ভোগে আছেন।

সাবেক সুপারভাইজার আনোয়ার হোসেন বলেন, এক বছর আগে ছাঁটাইয়ের শিকার হন। কোনো পাওনা পাননি। অর্থের অভাবে ব্যাটারির রিকশা চালান তিনি।

শ্রমিক মালতি রানী, হাওয়া বেগমসহ অনেকে পাওনা টাকার জন্য বছরের পর বছর ধরে ঘুরছেন।

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে গেলে কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিয়া মামুনকে পাওয়া যায়নি। প্রতিষ্ঠানের জিএম আমির হোসেন জানান, তিনি তিন মাস ধরে যোগ দিয়েছেন। সব বিষয়ে তাঁর জানা নেই। তবে শ্রমিকদের সব অভিযোগ সত্যও নয়। ফেব্রুয়ারির বেতন ও ঈদ বোনাস পরিশোধ করা হয়েছে। গত ২০ এপ্রিল মার্চের বেতন দেওয়ার কথা ছিল। বিক্রি কমে যাওয়ায় তা দেওয়া সম্ভব হয়নি।

গাজীপুর শিল্প পুলিশের সুপার এ কে এম জহিরুল ইসলাম জানান, মার্চের বেতনের দাবিতে শ্রমিকরা প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে কর্মবিরতি পালন করছেন। মালিকপক্ষ জানিয়েছে, ঈদের পর বিক্রি কমে যাওয়ায় শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ করতে পারছেন না। দ্রুত শ্রমিকদের সমস্যা সমাধানের জন্য কারখানা কর্তৃপক্ষকে বলা হয়েছে।

আরএম/এসএন



Share this news on: