প্লাস্টিক বর্জ্য সংকট উত্তরণে ছয় বিশেষজ্ঞের মতামত

প্লাস্টিক বর্জ্য বর্তমান বিশ্বের জন্য একটি দুঃশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্লাস্টিকের বর্জ্য সংকটকে কীভাবে সমাধান করা যায় সেই বিষয়ে বিভিন্ন মতামত তুলে ধরেছেন একদল বিশেষজ্ঞ।

তারা মনে করেন, প্লাস্টিকের প্রকৃত মূল্য বুঝতে একসঙ্গে কাজ করতে হবে, যাতে করে এটি সমস্যা থেকে সমাধানে রূপ নিতে পারে।

প্রতি বছর প্রায় ৮০ লাখ প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে ফেলা হয়, যা কুইন্সল্যান্ডের আকারের সমান এলাকা ভরে যাচ্ছে। বিজ্ঞানীরা এটিকে ‘গ্রেট প্যাসিফিক গারবেজ প্যাচ’ নামে অভিহিত করেছেন।  তবে প্লাস্টিক বর্জ্য সঠিক স্থানে ফেলা ও তার পূর্ণ ব্যবহারযোগ্য করে তুলতে বিশ্ব ব্যর্থ হয়েছে।

প্লাস্টিক বর্জ্য সমস্যা নিয়ন্ত্রণে ভোক্তাদের অবদান

 জেফ এঞ্জেল

প্রতিষ্ঠাতা, সিটিজেন ব্লু

নির্বাহী পরিচালক, টোটাল এনভায়রনমেন্ট সেন্টার

প্লাস্টিক বর্জ্য একটি সমস্যা এবং এটি বর্তমানে স্বীকৃত। এক্ষেত্রে বলতে হবে আমরা প্রথম বাধাটি অতিক্রম করেছি। সামনে আমাদের অনেক কাজ করতে হবে, যা প্লাস্টিক সমস্যাকে অনেকখানি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসবে। স্বল্পমেয়াদী ব্যবহারের জন্য দীর্ঘমেয়াদী এই উপাদান ব্যবহারের হাস্যকর প্রয়োজন থেকে আমাদের বের হয়ে আসা প্রয়োজন।

কনটেইনার ডিপোজিটগুলি (জমা করা পাত্র) অবশ্যই পুনর্ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের বোতলগুলো ফিরিয়ে আনতে উদ্দীপনা তৈরি করে এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপাদানগুলোর একটি পরিচ্ছন্ন প্রবাহ।

ভোক্তা নিজ উদ্যোগে এর ক্ষতিকর ব্যবহার বন্ধ করতে পারেন। তাছাড়া সুপারশপগুলোতে প্লাস্টিক প্যাকেজিং পদ্ধতি নিয়ে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে উদ্বেগ প্রকাশ করে তাদের আওয়াজ তুলতে পারেন।

এই আন্দোলনে যোগ হতে পারে- সরকারকে এ বিষয়ে নতুন আইন তৈরির জন্য চাপ প্রয়োগ করা, প্লাস্টিকমুক্ত আন্দোলনে যোগ দেওয়া, বিভিন্ন স্থানীয় মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলা যে কিভাবে প্লাস্টিক পরিবেশের ক্ষতি  করে এবং স্থানীয় পরিষ্কার ও প্রণয়ন দলকে সমর্থন করা।

একসঙ্গে কাজ করলেই বর্জ্য সমস্যা কমবে

লুইস হার্ডম্যান

প্রতিষ্ঠাতা

প্লাস্টিক কালেক্টিভ

এখন সময় এসেছে প্লাস্টিককে বাস্তববাদী ও প্রয়োজনীয় সম্পদ হিসেবে ভাবার। বর্তমানে আমাদের সমাজে এমন অনেক ব্যক্তি রয়েছেন যারা প্লাস্টিক তৈরি, গ্রহণ ও এটি নিষ্পত্তি করার ব্যাপারে ভূমিকা রেখেছেন। আমাদের এমন মূল্যায়ন করতে হবে কোন প্লাস্টিকের ইতিবাচক মান রয়েছে যা খুব সহজে আবার ব্যবহার করা  যেতে পারে।

প্লাস্টিক সমস্যা উত্তোরণের জন্য বিশ্বব্যাপী অংশীদারিত্ব অপরিহার্য। প্লাস্টিক নির্মাতা, পণ্য ডিজাইন, ব্র্যান্ড মালিক, খুচরো দোকানদার, আমদানিকারক, রপ্তানিকারক ও ভোক্তাসহ সকল স্তরে অংশীদারি প্রয়োজন। দেশের সরকারগণ ও পরিষদসমূহ দীর্ঘমেয়াদী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে প্রাথমিক পদক্ষেপগুলো নিতে পারে। তবে বেশির ভাগ সময়েই তা শীর্ষস্থানীয় [বিশ্বব্যাপী কর্পোরেশন] এবং নিচ পর্যন্ত [ভোক্তাদের] থেকে আসে। মোট কথা কোম্পানি ও ব্র্যান্ডগুলোর প্রতি ভোক্তাদের গঠনমূলক প্রতিক্রিয়া সবচেয়ে শক্তিশালী উপকরণ, যা বিশ্বনাগরিক হিসেবে আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে।

টেকসই উদ্যোগ ব্যবসার জন্য ভালো

ড. ড্যানিয়েল টেরিল

পার্টনার

ডেলোয়েট অস্ট্রেলিয়ার(এটি অস্ট্রেলিয়ার কৃষি অর্থনীতি এবং প্রাকৃতিক সম্পদ অর্থনীতির একটি শীর্ষ দল)

একক কোনো পদ্ধতিতে এই সমস্যার সমাধান নেই। এর সমগ্র সরবরাহ চেইন ধরে এর সমাধান করতে হবে। প্লাস্টিকের অর্থনীতির জন্য এটা আগে নিশ্চিত করতে হবে যে, উচ্চ গুণমান সম্পন্ন পুনর্ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক ভোক্তা ও ব্যবসার কাছ থেকে এর প্রাপ্যতা সহজলভ্য। আর এটিও নিশ্চিত করতে হবে যে, পুনর্ব্যবহৃত পণ্যটির চাহিদা রয়েছে। পুনর্ব্যবহৃত প্লাস্টিকে বিনিয়োগ ব্যবসার মূলধনে কম চাপ ফেলবে যদিও সবুজ উদ্যোগের জন্য তা সহজলভ্য। এছাড়াও একটি প্রতিষ্ঠানের পরিবেশগত প্রশংসা কর্মীদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ, তাই দীর্ঘমেয়াদী উদ্যোগ কর্মীদের উৎসাহিত করে এমনকি উৎপাদনশীলতাও বাড়িয়ে তুলতে পারে।

প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহার প্রক্রিয়ার খরচ কমিয়ে আনতে, যাতে অবৈধভাবে প্লাস্টিক বর্জ্য নিষ্পত্তি না হয় এবং প্রকৃতিতে আরো কার্যকরভাবে যাতে বর্জ্য অপসারিত হয় তার জন্য প্রযুক্তিকে ব্যবহার করা কিছুটা ঝামেলাযুক্ত হবে।

প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহার পথ তৈরিতে বড় ব্যবসাগুলোকে নেতৃত্ব দিতে হবে

 ভামসি মোহন থাতি

প্রেসিডেন্ট

কোকা কোলা সাউথ প্যাসিফিক

২০১৮ সালে কোকা কোলা বিশ্বব্যাপী গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গীকার করে  তা হলো ২০৩০ সাল নাগাদ বোতল সংগ্রহ  অথবা বোতলের পুনর্ব্যবহার অথবা বিক্রি নিশ্চিতকরণ। প্যাকেজিং পুনর্ব্যবহারই যথেষ্ট নয়, যদিও এটিকে ভালো একটি শুরু বলা যেতে পারে। আমাদের আরো অনেক দূর যেতে হবে আর এটি নিশ্চিত করতে হবে, যে প্লাস্টিকটি আমরা ব্যবহার করছি তা আগেও ব্যবহৃত হয়েছে।

এই বছরের শেষের দিকে ৭০ শতাংশ কোকা কোলা, মাউন্ট ফ্র্যাংলিন এবং পাওয়ারয়েডসহ আরো কিছু ব্র্যান্ড পুরোপুরি পুনর্ব্যবহৃত প্লাস্টিক থেকে তৈরি করা হবে। নতুন বোতল তৈরিতে নতুন প্লাস্টিকের ব্যবহার কমাতে হবে, অস্ট্রেলিয়াতে পুনর্ব্যবহার করা বোতলই বেশি ব্যবহার করা হয়। প্লাস্টিকের পুনর্ব্যবহার বৃদ্ধি মানে প্রায় ১৬ হাজার টন নতুন প্লাস্টিক ব্যবহার করা বন্ধ হবে ২০২০ সাল নাগাদ।

পুনর্ব্যবহৃত প্লাস্টিকের বর্ধিত চাহিদা পানীয় শিল্পের জন্য একটি নতুন বেঞ্চমার্ক তৈরি করবে এবং আশা করা যায় প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহার শিল্পে স্থানীয় বিনিয়োগের সংখ্যা বাড়বে।

আমরা জানি যে, আমাদের আরো অনেক কিছুই করতে হবে। অস্ট্রেলিয়া জুড়ে প্লাস্টিক বর্জ্য অপসারণ, পরিষ্কার ও পুনর্ব্যবহারের জন্য সকল অংশীদার মিলে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে।

নবায়নযোগ্য সম্পদ হিসেবে প্লাস্টিকের মূল্য আমাদের বুঝতে হবে

প্রফেসর ভিনা সাহাজওয়ালা

পরিচালক

সেন্টার ফর সাসটেইনেবল মেটেরিয়ালস রিসার্চ অ্যান্ড টেকনোলজি, ইউএনএসডব্লিউ সিডনি

দীর্ঘ সময় ধরে বেশির ভাগ পণ্যই ডিজাইন করা হয়েছে, পরিবেশে এর নিষ্পত্তি কিভাবে হবে সে বিবেচনা না করেই। ময়লার ভাগাড়ে যাওয়ার আগেই বর্জ্যগুলো নতুন কিছু মূল্যবান উপাদান যোগ, উৎপাদন গুণ নির্মাণ করে ব্যবহার করা যেতে পারে। এমন ব্যবসাতে অনেকেরই অল্প আগ্রহ রয়েছে।

বাস্তবতা হলো ভাগাড়ে যাওয়ার পরও প্রতিটি বর্জ্যই আসলে নতুন করে ব্যবহার উপযোগী করা যায়। আমরা যদি একটি চলমান অর্থনীতি চাই তাহলে বর্জ্যতে মূল্যবান সম্পদগুলো রেখে তা বহু দিন যাতে ব্যবহার করতে পারি। বর্জ্য কম হবে এমন ব্যবহার আমাদের নিশ্চিত করতে হবে।

অনেক স্টেকহোল্ডার রয়েছে এই সরবরাহ চেইন জুড়ে। এখন বিষয়টি হচ্ছে এই চ্যালেঞ্জটি গ্রহণ করে একত্রে কাজ করতে হবে সুযোগের ব্যবহার করে পরিবর্তন আনতে হবে। আমাদের এমন সমাধান দরকার যা বর্জ্য কমাতে শুধু সাহায্য করবে না, বরং এটি নিশ্চিত করবে যে প্লাস্টিক বর্জ্য গুরুত্বপূর্ণ এবং এটি গুণ ব্যবহার একবার নয় বার বার করা যাবে।

উদ্ভাবনী সমাধান টেকসই বিকল্প তৈরি করতে পারে

ডা. সেন নরিশ

সিইও- ল্যান্ডকেয়ার অস্ট্রেলিয়া

গত অর্ধ শতাব্দী ধরে প্লাস্টিকের স্থিতিশলীতা ও দীর্ঘস্থায়ীতা তাদের পরিবেশের প্রধান দূষণকারী হিসেবে তৈরি করেছে। পরিবেশের প্রতিটি দিককে এই সমস্যাটি আক্রান্ত করেছে যার মধ্যে মানুষের স্বাস্থ্যগত সমস্যার ব্যাপারটিও রয়েছে।

ল্যান্ডকেয়ার অস্ট্রেলিয়া ৩০ বছর ধরেই কর্পোরেট অংশীদারদের সঙ্গে উন্নত পরিবেশর সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। অনেক সংস্থার সঙ্গে আমাদের অর্থপূর্ণ অংশীদারিত্ব রয়েছে আমরা একটি ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি করব আমাদের প্রকৃতিতে। কর্পোরেট অংশীদারদের সহযোগিতায় আমরা সুবিধাজনক মান, হ্যান্ডস অন ল্যান্ড কেয়ার প্রকল্প ও বিভিন্ন প্রোগ্রাম করব যা সমগ্র অস্ট্রেলিয়ার জন্য সুফল বয়ে আনবে।

এই প্লাস্টিক সমস্যা একা সমাধানের বিষয় নয়। আমাদের সকলকে এই কাজে এগিয়ে আসতে হবে। যদি সকলে একত্রিত হই এবং সমাজে কিভাবে এই সমস্যাকে গ্রহণ করে ও প্লাস্টিকের যথাযথ পুনর্ব্যবাহার করে তবেই সমাজে দীর্ঘমেয়াদী একটি পরিবর্তন আসতে পারে।

 

যুক্তরাজ্যভিত্তিক দ্য গার্ডিয়ান থেকে লেখাটি অনুবাদ করেছেন ফাতেমা ইয়াসমিন

 

টাইমস/এসআই

Share this news on: