বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের টানাপোড়েনের প্রভাব বাণিজ্যেখাতে

দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের টানপোড়েনের মধ্যে পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপ নিয়েছে ভারত ও বাংলাদেশ। এতে উদ্বেগের মধ্যে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। দুই দেশের উত্তেজনার মধ্যে পাল্টাপাল্টি বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।

শুক্রবার (০২ মে) বিবিসির এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত এপ্রিলে বাংলাদেশ ভারত থেকে স্থলপথে তুলার সুতা (ইয়ার্ন) আমদানি সীমিত করে, স্থানীয় শিল্পকে সস্তা আমদানির প্রতিযোগিতা থেকে রক্ষার জন্য এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় ভারত হঠাৎ করেই বাংলাদেশকে দেওয়া ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করে দেয়। এ ট্রান্সশিপমেন্টে বাংলাদেশি পণ্য ভারতের বন্দর ও বিমানবন্দর ব্যবহার করে তৃতীয় দেশে রপ্তানি হতো। ভারত এ পদক্ষেপের কারণ হিসেবে বন্দরে যানজটের কথা বলেছে।

দুই দেশের এ উত্তেজনার পেছনে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটও রয়েছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছরের আগস্টে গণবিক্ষোভের মুখে ক্ষমতাচ্যুত হন। বর্তমানে তিনি ভারতে নির্বাসিত। এখন অন্তর্বর্তী সরকার হিসেবে দেশ পরিচালনা করছেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এ সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর মানবতাবিরোধী অপরাধ, অর্থপাচার ও দুর্নীতির অভিযোগে ঢাকা থেকে শেখ হাসিনাকে ফেরত চাওয়া হয়েছে। হাসিনা এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। এখনও দিল্লি আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি।

এর মধ্যেই ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশে হিন্দু সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। ভারত বলছে, সম্প্রতি একজন হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতাকে হত্যা ‘একটি পদ্ধতিগত নিপীড়নের প্রতিফলন’। তবে বাংলাদেশ সরকার এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, ঘটনাগুলো রাজনৈতিকভাবে প্ররোচিত বা সাধারণ অপরাধ।

বাণিজ্যিক দিক থেকে এ উত্তেজনা বড় ধাক্কা হয়ে এসেছে। বাংলাদেশের পোশাকশিল্প সুতার ওপর নির্ভরশীল। শিল্পটি এখন ব্যয়বহুল ও ধীরগতির সমুদ্র ও আকাশপথে আমদানির বিকল্প খুঁজছে। ২০২৪ সালে ভারত বাংলাদেশে ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারের সুতা রপ্তানি করেছিল, যার এক-তৃতীয়াংশই স্থলপথে এসেছে।

মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে দ্রুত পণ্য পৌঁছাতে ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট রুট এখন বন্ধ।এমজিএইচ গ্রুপের প্রধান আনিস আহমেদ বলেন, এ রুটে সাতদিনের মধ্যেই পণ্য পৌঁছানো যেত, এখন আট সপ্তাহ পর্যন্ত লাগতে পারে।

চীনের পর বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক বাংলাদেশ। গত বছর দেশটি ৩৮ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে। এর মধ্যে ১ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি পণ্য ভারতে স্থল-বিমান রুট দিয়ে পাঠানো হয়েছিল।

বাংলাদেশে কঠোর ভারতীয় ভিসা নিয়মের কারণে ক্ষোভ বাড়ছে। আগে পর্যটন, ব্যবসা, শিক্ষা ও চিকিৎসার জন্য প্রতি বছর ২০ লাখ বাংলাদেশি ভারতে আসত। গত কয়েক মাসে ভিসার সংখ্যা ৮০ শতাংশেরও বেশি কমেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতে হাসিনার অবস্থান ও প্রত্যর্পণের দাবি এখনও একটি বড় বিরক্তিকর বিষয়। ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শ্যাম স্মরণ বলেন, তাদের বুঝতে হবে যে হাসিনাকে তাদের হাতে তুলে দেওয়ার কোনও উপায় নেই। আমরা জানি যদি তাকে হস্তান্তর করা হয় তবে তার কী হবে। আমি মনে করি, ভারতের জনমত এতে সাড়া দেবে না।

এদিকে ভারতের পোশাক প্রস্তুতকারক সমিতি স্থলপথে বাংলাদেশি পোশাক আমদানি নিষিদ্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সিনিয়র অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, আমি মনে করি আজকাল বাংলাদেশে একটি দৃঢ় দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। হাসিনা সরকারের ভারতকে দেওয়া অন্যান্য ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধাগুলোও পুনর্মূল্যায়ন করা উচিত।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারত স্থলবেষ্টিত উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পণ্য পরিবহনের জন্য বাংলাদেশি বন্দর, সড়ক এবং জলপথ ব্যবহার করে। ফলে দূরত্ব, সময় ও খরচ কম হয়। তবে কর্মকর্তারা বলছেন, ট্রানজিটের পরিমাণ প্রত্যাশিত পর্যায়ে পৌঁছায়নি।

ড. ইউনূসের সাম্প্রতিক চীন সফরের সময় কিছু মন্তব্য ভারতকে ক্ষুব্ধ করেছে। তিনি বলেন, ‘ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের একমাত্র সমুদ্র অভিভাবক বাংলাদেশ’ এবং এ অঞ্চল চীনের অর্থনীতির সম্প্রসারণ হতে পারে।

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ ‘চিকেন নেক’ নামক শিলিগুড়ি করিডরের মাধ্যমে যুক্ত। এলাকাটি সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত সংবেদনশীল।

এ ছাড়া বাংলাদেশে চীনের ১ বিলিয়ন ডলারের তিস্তা প্রকল্পে আগ্রহও ভারতকে উদ্বিগ্ন করেছে, যেহেতু প্রকল্পটি শিলিগুড়ি করিডরের কাছেই।

আরআর/টিএ

Share this news on:

সর্বশেষ

জামায়াত মওদুদীবাদে বিশ্বাস করে, ইসলামে বিশ্বাস করে: মির্জা আব্বাস Dec 04, 2025
যুদ্ধের ক্ষত নিয়েও নতুন জীবনের স্বপ্ন, গাজায় ৫৪ দম্পতির গণবিয়ে Dec 04, 2025
সোমালিয়ার অভিবাসীদের আবর্জনা আখ্যা দিলেন ট্রাম্প Dec 04, 2025
পুঁজিবাদ নয় নারীর পরিচয় ও মর্যাদা নিয়ে কুরআনের নির্দেশনা সর্বোত্তম: খামেনি Dec 04, 2025
ট্রাইব্যুনালে লিখিতভাবে ক্ষমা চাইলেন ফজলুর রহমান Dec 04, 2025
খালেদা জিয়া মৃত্যুবরন করলে আখিরাতেও একই ধরনের সম্মান পাবে-ভাইস চেয়ারম্যান শাহজাহান Dec 04, 2025
শেখ হাসিনার চুক্তি এই আমলেও বহাল কেন? প্রশ্ন বন্দর আন্দোলনের নেতাদের Dec 04, 2025
জনগণের সিদ্ধান্তকে আমরা চূড়ান্ত মেনে নিব; হাসনাত আবদুল্লাহ Dec 04, 2025
খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের খোঁজ নিতে এভারকেয়ারে প্রধান উপদেষ্টা Dec 04, 2025
এইডস দিবসে সানির ব্যতিক্রমী বার্তা Dec 04, 2025
img
লাইফ সাপোর্টে অভিনেতা তিনু করিম Dec 04, 2025
img
মাগুরায় ২ মোটরসাইকেলের মুখোমুখি সংঘর্ষে প্রাণ গেল যুবকের Dec 04, 2025
img
রংপুরের সমাবেশ শেষে ফেরার পথে পিকআপ উল্টে প্রাণ গেল ১ জনের, আহত ৮ Dec 04, 2025
img
বাইসাইকেল কিকে গোল করে মেসিকে কৃতিত্ব দিলেন রোমেরো Dec 04, 2025
img
সংকট নিরস‌নে জরুরি সাহায্যের আহ্বান শ্রীলঙ্কান কমিউনিটির Dec 04, 2025
img
লিডস ইউনাইটেডের কাছে ৩-১ গোলে হারাল চেলসি Dec 04, 2025
img
কিমের কাছে ক্ষমা চাওয়ার কথা ‘ভাবছেন’ দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট Dec 04, 2025
img

ইউএনওডিসি'র প্রতিবেদন

১০ বছরে মিয়ানমারে আফিমের চাষ সর্বোচ্চে Dec 04, 2025
img
গুজবে কান না দিয়ে খালেদা জিয়ার সুস্থতায় দোয়া করুন : ইশরাক হোসেন Dec 04, 2025
img
কুমারখালীতে ৩ ব্যবসায়ীকে জরিমানা Dec 04, 2025