ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনায় কাশ্মীরের সীমান্তবর্তী নিয়ন্ত্রণ রেখার দুই পাশের মানুষের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। দুই পাশের সাধারণ মানুষ সুরক্ষা পেতে বাংকার সংস্কারে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। পেহেলগামে হামলাকে কেন্দ্র করে ভারত এবং পাকিস্তান একে অপরের বিরুদ্ধে বেসামরিক নানা বিধি-নিষেধ ঘোষণার পরও কাশ্মীরের মানুষ কিছুটা স্বস্তি পেয়েছিল।তারা ভেবেছিল, পরিস্থিতি হয়ত এর চেয়ে খারাপ হবে না।
কিন্তু গত সপ্তাহে নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর গুলি বিনিময়ের কারণে বিনিদ্র রাত কাটিয়েছে এর কাছে বসবাসকারী মানুষ।ভারতশাসিত কাশ্মীরের উরি সেক্টরের তুতমার গলি পোস্ট এবং পাকিস্তানশাসিত লিপা সেক্টরের নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর গত সপ্তাহে গুলি বিনিময়ের ঘটনা ঘটে। তবে এখন পর্যন্ত ওই ঘটনায় কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।
এহসান-উল-হক শামি পাকিস্তানশাসিত লিপা উপত্যকার বাসিন্দা।ওই অঞ্চলের জনসংখ্যা প্রায় ৪০ হাজার এবং সেখানকার বেশির ভাগ মানুষই আইন অনুশীলন করে।নিয়ন্ত্রণ রেখা থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত শামির বাড়ি। ভারতীয় এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মধ্যে ব্যাপক গুলি বিনিময়ে ২০১৯ সালে তার বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তিনি সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে জানিয়েছেন, একইভাবে ২০০২ ও ১৯৯৮ সালে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তার বাড়ি।
পেশায় আইনজীবী শামি বলেছেন, ভারতশাসিত কাশ্মীরের পেহেলগামের ঘটনার পর শুক্রবার ও শনিবার (৩ মে) পাকিস্তান ও ভারতের সেনাবাহিনীর মধ্যে গুলি বিনিময় হয়েছে।শামি জানিয়েছেন, শুক্রবার ও শনিবারের মধ্যবর্তী রাত সাড়ে ১২টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত দুই সেনাবাহিনীর মধ্যে গুলি বিনিময় চলে। এরপর শনিবার রাতে ফের গুলি বিনিময় শুরু হয়। ওই দিন রাত ১০টায় গুলি বিনিময় শুরু হয়ে ভোর ৫টা পর্যন্ত চললেও সাধারণ মানুষকে কিন্তু নিশানা হতে হয়নি।
প্রসঙ্গত, ভারতশাসিত কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর সবচেয়ে স্পর্শকাতর এলাকা উত্তর কাশ্মীরের কুপওয়ারা ও বারামুল্লা জেলায় অবস্থিত।শুক্রবার কুপওয়ারার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট একটা নির্দেশ জারি করে জানিয়েছিলেন, কুপওয়ারার নিয়ন্ত্রণরেখা সংলগ্ন অঞ্চলে যেতে হলে আগাম অনুমতি নিতে হবে।কুপওয়ারায় এখনো পর্যন্ত সীমান্তে গুলি বিনিময়ের কোনো ঘটনা ঘটেনি। তবে নিয়ন্ত্রণ রেখার খুব কাছাকাছি যারা বাস করেন, তাদের মধ্যে একটা আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে।কুপওয়ারার কারনাহ সেক্টরের বাসিন্দারা ব্যক্তিগত ব্যয়ে ভূগর্ভস্থ বাংকার তৈরির কাজ শুরু করেছেন বা সেগুলো পুনর্নির্মাণ করছেন।
পেহেলগামের ঘটনার পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সামরিক উত্তেজনা সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গেই বাড়ির নিচে বাংকার তৈরির কাজ যারা শুরু করেছেন, তাদেরই একজন পীরজাদা সৈয়দ।
তিনি বলেন, সীমান্তে গোলাগুলির পরিণতি আমরা ইতিমধ্যে দেখেছি। জীবনহানি হয়েছে, অতীতে কৃষিকাজের অভাবের কারণে মানুষও অনাহারে মারা গেছে।
‘আল্লাহ মাফ করুন, যেন কিছু না হয়। কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে, কোনো সময় কিছু একটা ঘটে যেতে পারে। সে কারণেই আমরা ভূগর্ভস্থ বাংকার বানাচ্ছি যাতে কিছু হলে আমরা সেখানে আশ্রয় নিতে পারি।’কুপওয়ারার একাধিক বাসিন্দা বিবিসিকে বলেছেন, অতিরিক্ত সামরিক তৎপরতা এবং রাতের আকাশে জেট বোমারু বিমানের আওয়াজ তাদের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে।
কুপওয়ারার নিয়ন্ত্রণ রেখার জিরো লাইনে অবস্থিত টোড গ্রামের এক বাসিন্দা জানান, ২০১৭ সালে যখন গোলাবর্ষণ হচ্ছিল, তখন আমাদের এক আত্মীয়ের বাড়িতে একটা শেল এসে পড়েছিল এবং তার মৃত্যু হয়।
‘কিন্তু ২০২১ সালে যখন ভারত ও পাকিস্তানের সেনাবাহিনী কঠোরভাবে সিজ ফায়ার মেনে চলতে রাজি হয়। তারপর গত চার বছর ধরে জীবন শান্তিপূর্ণ ছিল। এখানে কৃষিকাজ হয়েছে, বাচ্চারা স্কুলে গিয়েছে, ব্যবসা হয়েছে। কিন্তু এখন আশঙ্কা হচ্ছে যে, আগের মতো পরিস্থিতি হয়ত ফিরে আসতে পারে।’
পীরজাদা সৈয়দ বলেন, দুই দিন আগে নামবরদার এসে এখানকার বাসিন্দাদের বাংকার পরিষ্কার করতে এবং তার চারপাশের আগাছা বা কাঠের জিনিসপত্র সরিয়ে ফেলতে বলেছিলেন। এই ঘোষণার কারণে সবাই হতবাক হয়েছে। কিন্তু বাঁচতে হবে তাই সকলে বাংকার পরিষ্কার করতে বা সেগুলো পুনর্নির্মাণ করতে শুরু করে দিয়েছে।
এহসান-উল-হক শামি বলেছেন, যখনই পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়, তখনই নিয়ন্ত্রণ রেখার কাছে বসবাসকারী মানুষের মনে আশঙ্কা তৈরি হয় যে, দুই দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে গোলাগুলি চলতে পারে। এতে সাধারণত নিশানা হতে হয় সাধারণ মানুষকে।
তিনি বলেন, সাম্প্রতিক উত্তেজনার পরও প্রতি রাতেই আমরা ভাবতাম, এই হয়তো গোলাগুলি শুরু হবে। যেমনটা শুক্রবার ও শনিবার রাতে দেখা গিয়েছে।সেই রাতের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে শামি বলেন, শুক্রবার ও শনিবারের মধ্যবর্তী রাতে শুরু হওয়া গোলাগুলিকে আমরা আকস্মিকই বলতে পারি। তখন তার বারোটা বেজে গেছে, বাড়িতে ছেলেমেয়েরা ঘুমিয়ে ছিল। প্রথমে আমি আমার বৃদ্ধ মাকে বাঙ্কারে সরিয়ে নিয়ে যাই। তার বয়স হয়েছে এবং তিনি হাঁটাচলা করতে অক্ষম।
তিনি জানিয়েছেন, ওই এলাকায় প্রায় প্রতিটা বাড়িতেই ভূগর্ভস্থ বাঙ্কার রয়েছে। বাড়ির কাজে এই বাঙ্কার ব্যবহার করা হয়।‘কিন্তু সাম্প্রতিক উত্তেজনার পর আমি বিশেষ মনোযোগ দিয়ে বাঙ্কার পরিষ্কার করেছি যাতে গোলাগুলি চললে এটা (বাঙ্কার) ব্যবহারের উপযোগী থাকে।’
শামি আরও জানিয়েছেন, এই বাঙ্কারগুলো এমনিতে মজবুত কিন্তু সমস্ত ধরনের বিপদ এড়াতে তা সক্ষম নয়। তিনি বলেছেন, এই বাঙ্কারগুলো বেশ মজবুত। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, যে এটা বুলেট বা গোলা থেকে রক্ষা করতে পারলেও ভারী অস্ত্রের শেল সরাসরি বাঙ্কারে পড়লে সেটা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
‘আমরা যে বাড়িতে থাকি সেটা ২০০২ এবং ১৯৯৯ সালেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। আমরা নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর আছি। এই কারণে আশঙ্কা থেকে যায় যে, আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হতেই পারি। অবশ্য এমনিতেই গুলি চললে কারও পক্ষে ঘুমানো সম্ভব নয়।’
শামির মতো ওই অঞ্চলের অন্য বাসিন্দারাও বিনিদ্র রাতই কাটিয়েছেন। তার কথায়, প্রায় পুরো এলাকার মানুষই গোটা রাত জেগে ছিল। তারা একে অপরের মঙ্গল কামনা করেছেন। তবে আমাদের কাছে তথ্য আছে যে এখন পর্যন্ত এই গোলাগুলিতে বেসামরিক জনগণের কোনও ক্ষতি হয়নি।
বাঙ্কারগুলো অবস্থান করার মতো যোগ্য নয়
উরি সেক্টরেও নিরাপত্তা নিয়ে আশঙ্কায় ভুগছেন মানুষ। ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে এই সেক্টরের ভাটগ্রান ও চরন্দা এলাকায় ১৬টা বাঙ্কার নির্মাণ করা হলেও স্থানীয়দের অভিযোগ, সেখানে বিদ্যুৎ সংযোগ ও জলের ব্যবস্থা নেই।
ভাটগ্রানের বাসিন্দা মহম্মদ কুদ্দুস বলেন, কেউ কেউ নিজের খরচে বাঙ্কার তৈরি করেছেন, কিন্তু দরিদ্র মানুষরা যাবে কোথায়। এখন আমরা এই একই বাঙ্কারগুলোই পরিষ্কার করব।
‘আল্লাহ দয়া করুন, যাতে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সমস্ত কিছু ঠিক থাকে আর গুলিবিনিময় বন্ধ হওয়ার পর জীবনযাত্রা আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়।’
প্রসঙ্গত, ২০০৩ সালের নভেম্বর মাসে নিয়ন্ত্রণ রেখায় সিজফায়ার সংক্রান্ত একটা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু দুই পক্ষের সেনাবাহিনী তা পুরোপুরিভাবে বাস্তবায়ন করতে পারেনি বলে অভিযোগ।
এরপর ২০২০ সালে লাদাখ সীমান্তে চীন ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর মধ্যে উত্তেজনা দেখা দিলে কাশ্মীর উপত্যকা থেকে বিপুল সংখ্যক সেনা সরিয়ে লাদাখে স্থানান্তরিত করে ভারত।এর কয়েক মাস পর ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভারত ও পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর মধ্যে পূর্ব সম্মত সিজ ফায়ার সংক্রান্ত চুক্তি কঠোরভাবে মেনে চলার জন্য আরও একটা চুক্তি হয়।
পেহেলগামের ঘটনার পর ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সেই চুক্তি আবার ভাঙ্গা হয়েছে বলে অভিযোগ।
এলাকা ছাড়েননি লিপা সেক্টরের বাসিন্দারা
বশির আলম আওয়ান ঝিলাম জেলা পরিসদের সদস্য। তিনি জানিয়েছেন, ওই সেক্টরে ভাল কৃষিকাজ হওয়ার কারণে সেখানে শস্য মজুত রয়েছে এবং বাকি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের যোগানও রয়েছে। তাই চূড়ান্ত খারাপ পরিস্থিতিতেও তাদের খাদ্যশস্যের অভাব দেখা যায়নি।
তার দাবি, অতীতে গোলাগুলি চলার কারণে লিপা সেক্টরে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সর্বশেষ গুলি চলেছিল ২০১৯ সালে। সেই সময় ব্যাপক গোলাগুলি চলেছিল, বেসামরিক নাগরিকরা নিশানা হয়েছিল। কিন্তু গত সপ্তাহে দুই রাতে যে গুলি বিনিময় হয়েছে, সেখানে সাধারণ মানুষ নিশানা হয়নি।
বশির আলম আওয়ান বলেন, অতীতে প্রাণহানির পাশাপাশি অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ওই এলাকা থেকে অভিবাসন হয়নি। নারী এবং বাড়ির অসুস্থ সদস্যদের অন্যত্র স্থানান্তরিত করা হলেও পুরুষরা কিন্তু এখানে থেকে গিয়েছে।
তিনি বলেন, লিপা উপত্যকায় সরকারি প্রকল্পের আওতায় প্রায় প্রতিটা বাড়িতে বা দু-তিনটি বাড়ি মিলিয়ে একটা বাঙ্কার বানানো হয়েছে।বশীর আলম আওয়ান জানিয়েছেন, লিপা ভ্যালির বাসিন্দাদের অনেকেরই আত্মীয় ভারত শাসিত কাশ্মীরের কুপওয়ারা সেক্টরে বাস করেন।তার মতে, দুই দেশের মধ্যে গুলি বিনিময়ের ঘটনা না ঘটলে, লিপা সেক্টরে পরিস্থিতি সাধারণত শান্তই থাকে।
বশির আলম আওয়ান বলেন, লিপা ভ্যালির রাস্তা আগে ভাল ছিল না। কিন্তু ২০২২ সালে রাস্তা মেরামতের পর ওই এলাকায় পর্যটনের প্রবণতা দেখা গিয়েছে।স্থানীয়রাও পর্যটন ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছেন। ওই এলাকায় অন্তত ৩০টা নতুন হোটেল, রেস্তোরাঁ ও গেস্ট হাউস তৈরি করা হয়েছে। বিপুল পরিমাণে পর্যটক আসাও শুরু হয়েছিল।
তিনি বলেন, বহু মানুষ পর্যটনকে তাদের কর্মসংস্থানের উৎস বানিয়েছে। এখন এসব গোলাগুলির ঘটনা ঘটায় পর্যটকরা ওই এলাকায় বেড়াতে যাবেন না বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। মানুষের কর্মসংস্থানের উপর এর খুব খারাপ প্রভাব পড়বে।
এমআর/এসএন