জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পেল মণিপুরী শাড়ি

জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পেল মণিপুরী শাড়ি, আর এ অর্জনে খুশি কমলগঞ্জের তাঁতিরা। দেশের বিভিন্ন জেলার আরও ২৪টি ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্যের জিআই সনদ প্রদান করেছে শিল্প মন্ত্রণালয়। তার মধ্যে মণিপুরী শাড়ি এই জিআই পণ্যের স্বীকৃতি অর্জন করে। তাঁত শিল্পের সাথে যারা জড়িয়ে আছেন সেই তাঁতিরা সহ পুরো মণিপুরী জনগোষ্ঠী আজ উচ্ছ্বসিত।

জানা যায়,সিলেট বিভাগের মণিপুরী তাঁতের শাড়ি এবং মণিপুরী নৃ-গোষ্ঠীর ইতিহাস আমাদের দেশে প্রায় ৩০০ বছরের অধিক পুরোনো। মণিপুরীরা তাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় কাপড়, শাড়ি, গামছা, শাল, বিছানার চাদর ফানেক, লাহিঙ,উড়নাসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাপড় নিজেদের জন্য বুনন করে আসছেন শত বছরেরও অধিক সময় ধরে।

বুনন শিল্পে খুবই দক্ষ মণিপুরী নারীরা প্রয়োজনীয় কাপড় নিজেরাই বুনে থাকেন। প্রায় প্রতিটি মণিপুরী ঘরেই তাঁত রয়েছে। নিজেদের প্রয়োজনীয় কাপড় বুনে চলেছে সেই সভ্যতার সময় থেকেই এমনি দাবী করে থাকেন তারা। তবে শাড়ি বুননের প্রচলন অন্য বুননের অনেকটা পরে শুরু হয়েছে। আজ এই শাড়ি ব্যাপক জনপ্রিয়তাও পেয়েছে,এর সুনাম এখন বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশে বিভিন্ন অঞ্চলের তাঁতের তৈরি শাড়ি যেমন - জামদানী,টাঙ্গাইল,বেনারসি সহ দেশীয় শাড়ি ভিন্নতা এবং বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা চোখ পড়লেই বুঝে নেয়া যায়। নকশায় রঙে অনন্যতা থাকে। প্রতিটি শাড়ির আঁচল, জমিন ও পাড়ের নকশায় দেখা যাবে মণিপুরী ভাষায় (মৈরাঙ) মন্দিরের (টেম্পল) প্রতিকৃতি থাকে। উজ্জ্বল রঙের দেশীয় সুতায় তৈরি হয় মণিপুরী শাড়ি । এক রঙের, এক থেকে দুই ইঞ্চি হয়ে থাকে শাড়ির পাড়ের চওড়ায় ।

পাড়ের রং প্রায় শাড়ির রঙের বিপরীত হতে দেখা যায়। আঁচল, জমিন ও পাড়ে মন্দিরের প্রতিকৃতির পাশাপাশি আঁচল ও জমিনে বিভিন্ন নকশা থাকে। শাড়ি তৈরি করেন তাঁতি পূণিমা সিনহা,মমতা সিনহা বলেন আমার হাতের তৈরি শাড়ির জিআই সনদ অর্জনে অনেক আনন্দ লাগছে এখন এর সুনাম আরও বৃদ্ধি পাবে।

সমাজকর্মী সংগঠক সমরজিৎ সিংহ বলেন, আমি এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ট্রেড শোতে অংশগ্রহণ করেছি মণিপুরী শাড়ি নিয়ে এর জিআই স্বীকৃতিতে অনেক ভালোলাগছে ।

বাংলা একাডেমির নাট্য সাহিত্য পুরস্কারে ভুষিত লেখক গবেষক নাট্যনির্মাতা শুভাশিস সিনহা বলেন, মণিপুরী শাড়ি এমনিতেই সমাদৃত এর জিআই সনদ,আমাদের জন্য একটি বিশাল অর্জন। অনলাইনে বিশাল বাজার সৃষ্টি করা উদ্যোক্তা চয়ন সিংহ বলেন, অনলাইনে মণিপুরী শাড়িসহ কাপড় বিক্রি করে থাকি সেখানে শাড়ির বিপুল চাহিদা রয়েছে ।

সিলেট বিভাগের কমলগঞ্জে মণিপুরী জনগোষ্ঠীর বেশি বসবাস রয়েছে । মণিপুরী শাড়িসহ অন্যান্য কাপড় এই কমলগঞ্জে উৎপাদিত হয়ে থাকে । তাই মণিপুরী জনগোষ্ঠীসহ উপজেলাবাসী এই পণ্যের জিআই সনদ অর্জনে গর্ববোধ করছেন ।

পণ্য জিআই করার আগে দীর্ঘ একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এই স্বীকৃতি দেয় শিল্প মন্ত্রণালয়ের পেটেন্ট, শিল্পনকশা ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর (ডিপিডিটি)।

কোনও দেশের পরিবেশ, আবহাওয়া ও সংস্কৃতি যদি কোনও একটি পণ্য উৎপাদনে ভূমিকা রাখে এবং ভৌগোলিকভাবে ও ঐতিহ্যগতভাবে সেই পণ্যগুলোকে ‘নিজস্ব’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা যায়, তাহলে সেটিকে ওই দেশের জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। প্রতিটি পণ্যের সঙ্গে সে স্থানের নাম যুক্ত করা হয়।

লেখক ও গবেষক মো.আব্দুস সামাদ বলেন, ভৌগোলিক নির্দেশক (GI) হল এমন একটি সনদ যা একটি পণ্যের উৎপাদন বা প্রস্তুতির ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট অঞ্চলের প্রাকৃতিক বা সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের পরিচয় দেয়। এ ধরনের সনদ পণ্যটির উৎসস্থল এবং তার বিশেষত্বকে চিহ্নিত করে, যা পণ্যের গুণগত মান নিশ্চিত করে। মণিপুরি শাড়ি বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলের একটি বিশেষ সাংস্কৃতিক নিদর্শন, যা মূলত মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলায় বেশি উৎপাদিত হয়।

এই শাড়ি শুধুমাত্র মণিপুরি জনগণের ঐতিহ্য নয়, বরং বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগণের মধ্যে একটি জনপ্রিয় পোষাক হয়ে উঠেছে। বিশেষ নকশার মাধ্যমে এই শাড়ি আলাদা হয়ে ওঠে, যা অন্যান্য শাড়ির থেকে স্বতন্ত্র। মণিপুরি শাড়ির উৎপাদন প্রক্রিয়া মৌলভীবাজারে বেশ প্রতিষ্ঠিত এবং এখানে সিলেটের তুলনায় বেশি পরিমাণ শাড়ি তৈরি হয়। সিলেটের মণিপুরি সম্প্রদায়ের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম হওয়ায়, শাড়ির উৎপাদনও সেখানে কম।

তবে বাংলাদেশ সরকারের পেটেন্ট, শিল্প নকশা ও ট্রেডমার্ক অধিদফতরের পত্রে সিলেটকে GI তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যেখানে মৌলভীবাজারকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এই সিদ্ধান্তে মৌলভীবাজার তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে।এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে, মৌলভীবাজার এবং সিলেটকে একত্রে GI পণ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হোক, যাতে উৎপাদনের বাস্তব চিত্র প্রতিফলিত হয় এবং উক্ত অঞ্চলের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষিত থাকে।

কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাখন চন্দ্র সূত্রধর বলেন, মণিপুরী অধ্যুষিত কমলগঞ্জে সর্বাধিক উৎপাদিত পণ্য মণিপুরী শাড়ী জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পাওয়ায় উৎসাহের পাশাপাশি উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে এবং তাঁতিরা আর্থীকভাবে লাভবান হবেন।এছাড়া তাদের জন্য দ্রুত সময়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে।

উল্লেখ্য গত বুধবার(৩০ এপ্রিল) বিকেলে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে বিশ্ব মেধাসম্পদ দিবস-২০২৫ উদযাপন উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় শিল্প সচিব মো. ওবায়দুর রহমানের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি ছিলেন শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান,আলোচক ছিলেন সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী।উক্ত অনুষ্ঠানে নতুন করে আরও ২৪টি দেশীয় পণ্য ভৌগোলিক নির্দেশকের (জিআই) স্বীকৃতি প্রদান করা হয়।

আরএম/এসএন


Share this news on:

সর্বশেষ

img
গরমে শরীরচর্চায় যেসব বিষয়ে খেয়াল রাখবেন May 05, 2025
img
ঘুমিয়ে পড়েন চালক, তারপর দুর্ঘটনা; কেমন আছেন পবনদীপ? May 05, 2025
img
গুচ্ছভুক্ত ১৯ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ May 05, 2025
img
সেনা কর্মকর্তা পরিচয়ে বিয়ের ঘটনায় ৪ প্রতারক গ্রেফতার May 05, 2025
img
খাদ্য সম্পর্কিত জাতীয় নীতি বাস্তবায়ন জরুরি : বাণিজ্য উপদেষ্টা May 05, 2025
img
কুয়েটে শিক্ষক লাঞ্ছনায় জড়িতদের বিচারের দাবিতে আল্টিমেটাম May 05, 2025
img
কেসিসি নির্বাচন: ফল বাতিল ও বিএনপির প্রার্থী মঞ্জুরের মামলার শুনানি ২৬ মে May 05, 2025
যারা হাসিনাকে নারী বলে তারাই নারীদের অপমান করেছে' May 05, 2025
img
হামাসের হাতে প্রাণ হারালো ৮ শতাধিক ইসরাইলি সেনা! May 05, 2025
img
অর্থের বিনিময়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নে নাগরিকত্বের সুযোগ শেষ May 05, 2025