ব্যাংকিং খাতে সংকট: ২০ ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি পৌনে দুই লাখ কোটি টাকা

দেশের ব্যাংকিং খাতে দীর্ঘদিনের অনিয়ম, খেলাপি ঋণের লাগামহীন বৃদ্ধি এবং প্রভিশন ঘাটতির চাপে মূলধনের স্থিতিশীল কাঠামো ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে ২০টি ব্যাংকের সম্মিলিত মূলধন ঘাটতি প্রায় তিন গুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৭১ হাজার ৭৮৯ কোটি টাকায়, যা দেশের ব্যাংকিং ইতিহাসে এক নজিরবিহীন পর্যায়ে পৌঁছেছে।

গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এসব ব্যাংকের ঘাটতি ছিল ৫৩ হাজার ২৫৩ কোটি টাকা। কিন্তু ডিসেম্বর শেষে এই অঙ্ক বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় পৌনে দুই লাখ কোটিতে, অর্থাৎ বাড়তি ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৮ হাজার ৫৩৬ কোটি টাকা।

রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক এককভাবে সর্বোচ্চ মূলধন ঘাটতির মুখে পড়েছে। ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকটির ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫২ হাজার ৮৯০ কোটি টাকা। এরপরেই রয়েছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, যাদের মূলধন ঘাটতির পরিমাণ যথাক্রমে ১৮ হাজার ১৮৮ কোটি ও ১৩ হাজার ৯৯১ কোটি টাকা।

ব্যাসেল-৩ অনুযায়ী, প্রতিটি ব্যাংকের ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের কমপক্ষে ১০ শতাংশ বা ৫০০ কোটি টাকার মধ্যে যেটি বেশি, সে পরিমাণ মূলধন সংরক্ষণ বাধ্যতামূলক। অথচ, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে দেশের ব্যাংক খাতের গড় মূলধন পর্যাপ্ততার হার (সিআরএআর) নেমে এসেছে মাত্র ৩.০৮ শতাংশে, যা আন্তর্জাতিক মানের চেয়ে অনেক নিচে। মাত্র তিন মাস আগেও এ হার ছিল ৬.৮৬ শতাংশ।

এবিবি’র সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নুরুল আমিন এ সংকটের মূল কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন খেলাপি ঋণের ব্যাপকতা এবং প্রভিশন সংরক্ষণের ব্যর্থতা। তার ভাষায়, ‘অনেক ব্যাংক তাদের প্রকৃত লোকসান গোপন রেখেছিল, যা এখন সামনে আসছে। দীর্ঘদিন ধরে লোকসানে থাকা এসব ব্যাংক সরকারের একাংশের আশ্রয়ে ভুল তথ্য দিয়ে টিকে ছিল। এখন পরিস্থিতি খোলাসা হচ্ছে, ফলে মূলধন ঘাটতির পরিমাণ হঠাৎ রেকর্ড ছাড়িয়েছে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৪ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। অথচ এক বছর আগেও এ পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ মাত্র এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২ লাখ কোটি টাকা। ছয় মাসে বেড়েছে ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক শীর্ষ কর্মকর্তা আশঙ্কা প্রকাশ করে জানান, মূলধন ঘাটতি সম্ভবত এখানেই শেষ নয়। মার্চ প্রান্তিকে তা আরও বাড়তে পারে। কারণ মার্চ থেকে স্পেশাল মেনশন অ্যাকাউন্ট (SMA) ঋণের জন্য প্রভিশন হার ১ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে, যা ব্যাংকগুলোর ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করবে।

ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে ব্যাংকগুলোকে একদিকে যেমন খেলাপি ঋণ আদায়ে জোর দিতে হবে, অন্যদিকে নতুন মূলধন সংস্থানেও উদ্যোগ নিতে হবে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি প্রভিশন সংরক্ষণের বাধ্যবাধকতা সাময়িক শিথিল করে, তাহলে সাময়িকভাবে কিছুটা ভার লাঘব হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।

আরআর/এসএন

Share this news on:

সর্বশেষ

img
ট্রেন থেকে ‘নিখোঁজ’ কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, অভিযানে আহত অবস্থায় উদ্ধার May 06, 2025
img
স্পষ্ট উচ্চারণ আয়ত্ত করতে যা করেছিলেন হৃতিক May 06, 2025
img
শিশুশিল্পী থেকে নায়িকা: বলিউডে ওয়ামিকা গাব্বির নতুন যাত্রা ‘ভুল চুক মাফ’ দিয়ে May 06, 2025
img
সেরা ফিল্ডারের পুরস্কার পেলেন সোহানঃ যা বললেন কোচ May 06, 2025
রুক্মিণীর হাতে সেরা অভিনেত্রীর মুকুট! May 06, 2025
img
ভিরাট কোহলির ‘অজান্তে লাইক’ রাতারাতি পাল্টে দিল অবনীত কৌরের ভাগ্য May 06, 2025
img
ইতিহাস বদলানোর মিশনে মিলানে বার্সা May 06, 2025
img
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধে ‘জুলাই ঐক্য’ প্লাটফর্মের আত্মপ্রকাশ May 06, 2025
img
বাংলাদেশের শাকিব খানকে অনুকরণ করলেন শাহরুখ! May 06, 2025
img
প্রতিটি ভবন হতে হবে নিরাপদ, পরিবেশবান্ধব ও দুর্যোগসহনশীলঃআদিলুর রহমান May 06, 2025