চে গুয়েভারাঃ সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রবাদপুরুষ

এর্নেস্তো চে গুয়েভারা। একজন আর্জেন্টাইন মার্ক্সবাদী বিপ্লবী। একাধারে একজন চিকিৎসক, লেখক, কূটনীতিক, গেরিলা নেতা ও সামরিক ব্যক্তিত্ব। একই সঙ্গে তিনি কিউবান বিপ্লবের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাকে বলা হয় দক্ষিণ আমেরিকার সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রবাদপুরুষ।

১৯২৮ সালের ১৪ জুন আর্জেন্টিনার রোজারিও শহরে দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন চে গুয়েভারা।

তখন সামরিক স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের যাতাকালে পিষ্ট আর্জেন্টিনা। সামরিক সরকারের জুলুম-নির্যাতন চে গুয়েভারার কোমল হৃদয়কে প্রভাবিত করে। তাই কিশোর বয়সেই তিনি মার্ক্সবাদী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন।

সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন তিনি। ১৯৫৩ সালে আমেরিকার বুয়েন্স আয়ার্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেডিকেল ডিগ্রি শেষ করেন। সে বছরই তিনি কমিউনিস্ট বিপ্লবে অংশ নিতে গুয়েতেমালা চলে যান।

কিন্তু গুয়েতেমালায় বিপ্লব ব্যর্থ হলে পরের বছুর তিনি মেক্সিকোতে পালিয়ে যান। সেখানে তিনি কিউবার নির্বাসিত আরেক কমিউনিস্ট বিপ্লবী ফিদেল কাস্ত্রোর সান্নিধ্যে আসেন।

তিনি কাস্ত্রোর ‌‌‘জুলাই ২৬ মুভমেন্ট’ এ যোগ দেন। কিউবার সামরিক স্বৈরশাসক বাতিস্তা সরকারকে উৎখাতের উদ্দেশ্যে কাস্ত্রো ও ৮০ জন গেরিলার সঙ্গে তিনি ১৯৫৬ সালের ২ ডিসেম্বর কিউবায় প্রবেশ করেন।

কিউবার সামরিক সরকারের প্রতিরোধের মুখে তারা কিউবার দক্ষিণাঞ্চলে একটি পাহাড়ের পাদদেশে এসে ঘাঁটি গড়ে তুলেন। এখান থেকেই কাস্ত্রো ও চে গুয়েভারা বাতিস্তা সরকারকে উৎখাত করতে বেশ কিছু অভিযান পরিচালনা করেন।

অবশেষে, ১৯৫৯ সালে কিউবার ডানপন্থী বাতিস্তা সরকারকে উৎখাত করে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন করেন ফিদেলকাস্ত্রো। আর চে গুয়েভারা হয়ে যান কাস্ত্রোর একজন বিশ্বস্থ সহচর। কাস্ত্রো তাকে কৃষিমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন।

কথিত আছে, কিউবায় বিপ্লব চলাকালে একবার এক যুবককে খাদ্য চুরির অপরাধে কোন বিচার প্রক্রিয়া ছাড়াই মৃত্যুদন্ড দিয়েছিলেন তিনি। এছাড়া কিউবার কমিউনিস্ট সরকারের প্রতি আনুগত্য না করায় তার বেশ কিছু সহচরকেও তিনি মৃত্যুদন্ড দিয়েছিলেন।

বিশ্বব্যাপী কমিউনিস্ট আন্দোলনকে ছড়িয়ে দিতে ১৯৬০ সালে তিনি ‘গেরিলা ওয়ারফেয়ার’ নামে বই লিখেন।

১৯৬৫ সালে তিনি কিউবার সরকারি পদ ছেড়ে দেন। তিনি কঙ্গোসহ আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন এবং কমিউনিস্ট আন্দোলন ছড়িয়ে দিতে সরকার বিদ্রোহীদের সংগঠিত করতে ভূমিকা রাখেন।

কঙ্গোর ঔপনিবেশিক সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত বিদ্রোহীদের সামরিক প্রশিক্ষণ দেন। ১৯৬৬ সালে তিনি স্থানীয় বিদ্রোহীদের সাহায্য করতে বলিভিয়া চলে আসেন।

কিন্তু বলিভিয়ার স্থানীয় কৃষকরা ছিল অশিক্ষিত ও দরিদ্র। তাই তারা বিদেশি বিদ্রোহীদের বিশ্বাস করতে পারে নি। তারা চে গুয়েভারা ও বিদেশি বিদ্রোহীদের তথ্য সামরিক সরকারকে জানিয়ে দেয়।

ফলে বলিভিয়ার সামরিক বাহিনীর আক্রমণে বিদ্রোহীরা ধ্বংস হয়ে যায়। ১৯৬৭ সালের ৭ অক্টোবর চে গুয়েভারা ও অন্যান্য বিপ্লবীদের আটক করে বলিভিয়া সরকার।

এ সময় মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ বলিভিয়ান সৈন্যদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছিল। আটকের দুদিন পরই সিআইএর নির্দেশে বলিভিয়ান ফায়ারিং স্কোয়াডের গুলিতে মারা যান বিপ্লবী চে গুয়েভারা।

তার মৃত্যুতে চিরচেনা অদম্য সাহসী এক বিপ্লবীর জীবনাবসান ঘটেনি। সমাপ্তি ঘটে এক বিপ্লবী ইতিহাসের।

টাইম ম্যাগাজিন কর্তৃক বিংশ শতাব্দীর একশজন প্রভাবশালী ব্যক্তির তালিকায় তিনি স্থান পেয়েছেন।

বিখ্যাত আলোকচিত্রী আলবার্তো কোর্তা চে গুয়েভারার আলোকচিত্র তুলেছিলেন। মেরিল্যান্ড ইনস্টিটিউট কর্তৃক এটি বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত আলোকচিত্র হিসেবে স্বীকৃতি পায়।

তিনি বই পড়তে খুব ভালবাসতেন। পাবলো নেরুদা, জন কিটস, কার্ল মার্ক্স, রুডইয়ার্ড কিপলিংসহ বিখ্যাত লেখকদের প্রায় তিন হাজার বই তার ব্যক্তিগত সংগ্রহে ছিল।

তার সম্পর্কে দার্শনিক জ্যাঁ পল সার্তে বলেন, ‘আমাদের সময়ের সবচেয়ে পরিপূর্ণ একজন ব্যক্তিত্ব ছিলেন চে গুয়েভারা।’

 

 টাইমস/জিএস/টিএইচ

Share this news on:

সর্বশেষ

img
ভোট বর্জন করেও জাকসুর ভিপি-জিএস পদে কত ভোট পেল ছাত্রদল? Sep 14, 2025
img
সংগীতশিল্পী ফরিদা পারভীনের মৃত্যুতে সংস্কৃতি উপদেষ্টার শোক Sep 14, 2025
img
২৫ বছরের জন্য বাফুফেকে ৮ জেলা স্টেডিয়াম বরাদ্দ Sep 14, 2025
img
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে হারে সুপার ফোর স্বপ্নে বড় ধাক্কা টাইগারদের Sep 14, 2025
img
জাকসুর ভিপি জিতুর ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগের কারণ কী? Sep 14, 2025
img
সেই ফাইয়াজের ভাই এবার জাকসুর জিএস Sep 13, 2025
img
ফজলুর রহমানকে গালি দিয়ে স্লোগান দেওয়া ফারজানা চাঁদাবাজি মামলায় গ্রেপ্তার Sep 13, 2025
img
জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী ফরিদা পারভীন আর নেই Sep 13, 2025
হাইকমিশনের খালি গাড়িতে ডিম নিক্ষেপ, নিরাপদেই ছিলেন মাহফুজ আলম Sep 13, 2025
‘ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন না হলে জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে’ Sep 13, 2025
img
লিটমাস টেস্টের ফল কী বার্তা দিচ্ছে? Sep 13, 2025
img
চীনা বাণিজ্য সম্মেলনে যোগ দিল বাংলাদেশি প্রতিনিধি দল Sep 13, 2025
img
পিআর পদ্ধতি সাধারণ মানুষ বোঝে না: মাহমুদুর রহমান মান্না Sep 13, 2025
img
পাকিস্তানে সংঘর্ষে প্রাণ গেল অন্তত ১৯ সৈন্যের Sep 13, 2025
img
দেড় কোটি টাকা কানাডায় মেয়ের কাছে পাচার, অভিযোগে ও আলোচনায় সাবেক প্রধান শাহীনুল Sep 13, 2025
img
ফের শক্তিশালী বৃষ্টিবলয়ে প্রবেশ করছে দেশ Sep 13, 2025
img
জাকসুর ফলাফল ঘোষণায় এত সময় লাগার কারণ Sep 13, 2025
img
জাকের ও শামিমের ব্যাটে লড়াইয়ের পুঁজি পেল বাংলাদেশ Sep 13, 2025
‘আমাদের জন্য কি অপেক্ষা করছে আমরা জানি, গোপালগঞ্জে দেখে এসেছি’ Sep 13, 2025
img
ছেলে ভিপি নির্বাচিত হওয়ায় গর্বিত সাদিক কায়েমের বাবা Sep 13, 2025