নেপোলিয়ন বোনাপার্টঃ ফরাসি বিপ্লবের শিশু

নেপোলিয়ান বোনাপোর্ট। ছিলেন ফ্রান্সের বিখ্যাত সেনাপতি ও সম্রাট। ইউরোপীয় ইতিহাসের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের একজন। তার রাজত্বকালেই ফ্রান্স ইউরোপের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। তাকে বলা হয় ‌‘ফরাসি বিপ্লবের শিশু’।

নেপোলিয়ান বলেছিলেন, “আমার জন্য ফ্রান্স যতটা প্রয়োজন, তার চেয়ে বেশি ফ্রান্সের প্রয়োজন আমাকে”।

নেপোলিয়ান ১৭৬৯ সালের ১৫ আগস্ট ইতালির কর্সিকা দ্বীপে জন্মগ্রহণ করেন। তবে তিনি ফ্রান্সে সামরিক প্রশিক্ষণ নেন এবং প্রথম ফ্রান্স প্রজাতন্ত্রে বেড়ে ওঠেন। ১৭৯৯ সালে সামরিক ক্ষমতা বলে ফ্রান্সের ‘প্রথম কনস্যুল’ পদে অধিষ্ঠিত হন। পাঁচ বছর পরই ১৮০৪ সালে ফ্রান্সের সিনেট নেপোলিয়ানকে ‘ফ্রান্সের সম্রাট’ ঘোষণা করে।

ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশক। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে একগুচ্ছ সেনা অভিযান পরিচালনা করেন নেপোলিয়ান। একের পর এক দেশ ও অঞ্চল জয় করেন। একসময় তিনি পুরো ইউরোপে ফ্রান্সের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন।

অপ্রতিরোধ্য নেপোলিয়ান। তার চৌকস বুদ্ধিমত্তার কাছে যেন ইউরোপের কোন শক্তিই টিকে থাকতে পারছিল না। একপর্যায়ে নেপোলিয়ানের নজর পড়ে রাশিয়ার দিকে। ১৮১২ সালে নেপোলিয়ান রাশিয়া আক্রমণ করে বসেন। আর তাতেই তার ভাগ্য বিপর্যয় শুরু। প্রথম দিকে নেপোলিয়ানের সৈন্যদল সফলভাবে মস্কোর আশপাশ দখল করে নেয়। মনে হচ্ছিল যেন রাশিয়া দখল নেপোলিয়ানের জন্য সময়ের ব্যাপার মাত্র।
কিন্তু বিধি বাম। মস্কোর বরফে আচ্ছাদিত হয়ে পড়ে নেপোলিয়ানের সৈন্যদল। প্রচন্ড ঠান্ডায় রোগাক্রান্ত হয়ে রাশিয়া থেকে শূন্যহাতে ফিরেন নেপোলিয়ান।

১৮১৩ সাল। লিপজিগের যুদ্ধে ইউরোপের ষষ্ঠ কোয়ালিশিনের কাছে পরাজিত হন নেপোলিয়ান। একই বছর তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে ফ্রান্স দখল করে নেয় কোয়ালিশন। নেপোলিয়ানকে এলবা দ্বীপে নির্বাসনে পাঠানো হয়। কিছুদিন পরই নেপোলিয়ান সেখান থেকে পালিয়ে যান। তাকে গ্রেফতার করতে অষ্টদশ লুইয়ের নেতৃত্বে একদল সেনাবাহিনী পাঠানো হয়। কিন্তু নাটকীয়ভাবে সৈন্যদলটি নেপোলিয়ানের সঙ্গে হাত মিলায়। তারা ফিরে এসে ফ্রান্স দখল করেন এবং নেপোলিয়ান আবার ফ্রান্সের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন।

এরপর ডিউক অব ওয়েলিংটনের নেতৃত্ব ইউরোপের ছয় পরাশক্তির জোট ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ১৮১৫ সালের জুন মাসে বিখ্যাত ওয়াটার’লু যুদ্ধে ব্রিটেনের কাছে পরাজিত হন নেপোলিয়ান। তাকে আটলান্টিক মহাসাগরের সেন্ট হেলেনা দ্বীপে নির্বাসন দেয়া হয়।

নির্বাসিত অবস্থায় ছয় বছর পর ১৮২১ সালে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান এই বীর সেনাপতি। একজন সেনাপতি ও সম্রাট হওয়া সত্ত্বেও নেপোলিয়ান ছিলেন অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিত্ব।

তিনি বলেন, “আলেকজান্ডার, সিজার, কিংবা আমি সাম্রাজ্য জয় করেছি শক্তি দিয়ে। অথচ যিশু খ্রিস্ট তার সাম্রাজ্য জয় করেছেন ভালোবাসা দিয়ে। তাই আজ লাখ লাখ লোক তার জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত”। বলতে গেলে ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপের সবচেয়ে আলোচিত চরিত্র নেপোলিয়ান।


প্রত্যয়দীপ্ত নেপোলিয়ানের হাত ধরেই আধুনিক ইউরোপের পথ চলা সুগম হয়। যুগ যুগ ধরে চলা ঘুণে ধরা সামন্ততন্ত্রের পতন ঘটিয়ে ইউরোপের রাজনীতিতে এক নতুন দ্বার উন্মোচন করেছিলেন তিনি। ধর্মীয় সহিষ্ণুতা, যুক্তিসঙ্গত মূল্যবোধ আর উদারতাবাদের সমন্বয়ে তিনি ‘নেপোলিয়ানীয় আদর্শ’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যদিও তিনি এই আদর্শ সাম্রাজ্য জয়ের ক্ষেত্রেই বেশি ব্যবহার করেছিলেন বলে অনেকে মনে করেন।

স্যার অরবিন্দ বলেন,‘নেপোলিয়ান ছিলেন গণতন্ত্রের স্বৈরাচারী রক্ষক’।

তবে নেপোলিয়ানের বীরত্বের প্রশংসা করে সর্বকালের সেরা বৃটিশ সেনাপতি ওয়েলিংটন বলেন, “এই যুগে, অতীতে, যেকোন সময়েই, নেপোলিয়ান”!

১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের তিন মূলনীতি হল স্বাধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব। নেপোলিয়ান এই তিন নীতির আলোকে প্রশাসনিক ও নাগরিক সংস্কার কার্যক্রম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাই তাকে বলা হয় ‘ফরাসি বিপ্লবের শিশু’।

 

টাইমস/এএইচ/জিএস

Share this news on:

সর্বশেষ

img
তিস্তার পানি বেড়ে বিপৎসীমার কাছে, আতঙ্কে মানুষজন Sep 14, 2025
img
না খেলার চেয়ে কষ্ট করে খেলা ভালো : আকরাম খান Sep 14, 2025
img
পদ্মা সেতুতে চালু হচ্ছে ইলেকট্রনিক টোল কালেকশন পদ্ধতি Sep 14, 2025
img
টসের সময় হাত মেলাননি ভারত-পাকিস্তানের অধিনায়ক Sep 14, 2025
img
দুর্গাপূজায় নিরাপত্তা নিশ্চয়তায় চট্টগ্রামে মাঠে থাকবে বিএনপি Sep 14, 2025
img
সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন বক্সার হ্যাটন আর নেই Sep 14, 2025
img
ইউটিউবে বিশেষ উপায়ে রেকর্ড আয় আমির খানের সিনেমার Sep 14, 2025
img
বাংলাদেশে প্রবেশকালে মহেশপুর সীমান্তে আটক ৩ Sep 14, 2025
img
এটা শুধু প্রাপ্তি নয়, সবার ভালোবাসা : অপরাজিতা Sep 14, 2025
img
নির্ধারিত সময়ের আগেই সংবিধান সংশোধন করে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন দিতে হবে: গোলাম পরওয়ার Sep 14, 2025
img
বাবার শিক্ষা ও স্টপওয়াচের গল্পে অনুপ্রেরণা দিলেন লেডেকি Sep 14, 2025
img
চাঁপাইনবাবগঞ্জে ২৫ জন সনাতন ধর্মাবলম্বী যোগ দিলেন জামায়াতে Sep 14, 2025
img
কুষ্টিয়ায় পৌঁছেছে ফরিদা পারভীনের মরদেহ Sep 14, 2025
img
ট্রাম্পের ১০০ শতাংশ শুল্কারোপের হুমকির কঠোর প্রতিক্রিয়া জানাল চীন Sep 14, 2025
img
ঢাকা-৮ এ ভোটযুদ্ধে নামলেন ইনকিলাব মঞ্চের শরিফ ওসমান হাদি Sep 14, 2025
img
টাকার বদলে পারিশ্রমিক হিসেবে এক গ্লাস দুধ পেয়েছিলেন অভিনেতা গুলশান গ্রোভার! Sep 14, 2025
img
সবাইকে সমীহ করে ট্রফি জয়ের পরিকল্পনা বাংলাদেশের! Sep 14, 2025
img
সাবেক সচিব আবু আলম শহীদ খানসহ ৪ জনের জামিন নামঞ্জুর Sep 14, 2025
img
ব্রাজিলের পর আবারও রিয়ালে ফিরতে চান আনচেলত্তি Sep 14, 2025
img
সিঙ্গেল-ইউজ প্লাস্টিক মুক্ত করতে সচিবালয়ে শুরু হচ্ছে চেকিং কার্যক্রম Sep 14, 2025