ড. ইউনূস পদত্যাগ করলে আবারও রেমিট্যান্স শাটডাউনের হুঁশিয়ারি দিল প্রবাসীরা

দেশে গত বছর জুলাই মাসে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন বড় প্রভাব ফেলে প্রবাসীদের ‘রেমিট্যান্স শাটডাউন’ কর্মসূচি। আন্দোলনের সাথে সংহতি জানিয়ে রেমিট্যান্স না পাঠানোর ক্যাম্পেইন চালান প্রবাসীরা। এতে ধস নামে রেমিট্যান্স প্রবাহে।

হাসিনা সরকারের পতনের পর নিত্য-নতুন রেকর্ড তৈরি হয় রেমিট্যান্স প্রবাহে। তবে সম্প্রতি দেশে চলমান অস্থিরতায় ড. ইউনূস সরকারের পদত্যাগের গুঞ্জনে আবারও অস্থিরতা দেখা দিয়েছে প্রবাসীদের মধ্যে। আবারও ইউনূস সরকার পদত্যাগ করলে আবারও রেমিট্যান্স শাটডাউনের হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন অনেক প্রবাসী।

স্বৈর শাসকের বিরুদ্ধে জুলাই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে প্রবাসেও। আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) বেশ কয়েকটি রাস্তায় বিক্ষোভ করেন দেশটিতে বসবাসরত প্রবাসীরা। দেশটিতে বিক্ষোভ মিছিল নিষিদ্ধ হওয়ায় ৫৭ বাংলাদেশিকে কারাদণ্ড দেয় দেশটির সরকার। অভিযুক্তদের অন্তত তিনজনকে যাবজ্জীবন, ৫৩ জনকে ১০ বছর ও একজনকে ১১ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধেই আন্দোলন করায় তাদের মুক্ত করার কোনো পদক্ষেপ নেয়নি হাসিনা সরকার। তবে হাসিনা সরকার পতনের পর ড. ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করলে তাদের মুক্ত করার জন্য দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ড. ইউনূসের অনুরোধে খুব দ্রুত মুক্তি পান দণ্ডপ্রাপ্ত প্রবাসীরা। যার ফলে প্রবাসীদের মধ্যে ড. ইউনূসের জনপ্রিয়তা আরও বেড়ে যায়।

এছাড়াও ইউনূস সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর গত নভেম্বর মাসে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রবাসী যাত্রী এবং তাদের স্বজনদের জন্য ওয়েটিং লাউঞ্জ চালু করেন ড. ইউনূস। ওয়েটিং লাউঞ্জ উদ্বোধন করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, আজারবাইজান যাবার পথে প্রবাসীদের জন্য বিমানবন্দরে একটি লাউঞ্জ উদ্বোধন করে গিয়েছিলাম। এ লাউঞ্জটা প্রবাসীদের জন্য ডেডিকেটেড, যাতে তাদের পথে পথে ঘুরতে না হয়।

বিদেশ যাওয়া এবং ফেরার সময় যেন তারা এটি আরামে ব্যবহার করতে পারেন। আর আজ প্রবাসীর স্বজনদের জন্য ওয়েটিং লাউঞ্জ উদ্বোধন করা হলো। এই ওয়েটিং লাউঞ্জ কিভাবে আরও আরামদায়ক ও স্বস্তিদায়ক করা যায়, সেজন্য প্রবাসীদের স্বজনদেরকে তাদের মতামত ও পরামর্শ দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

সম্প্রতি দেশের রাজনীতিতে চলছে নানা সমীকরণ। ইতোমধ্যে ড. ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকার থেকে পদত্যাগ করবেন বলে গুঞ্জন উঠেছে। যদিও জামায়াতসহ দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক পক্ষই বলছে, প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগ কোনো সমাধান না। তারা চায় অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বেই আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সর্বদলীয় রাজনৈতিক বৈঠকের আহ্বান জানান জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান। অন্যদিকে বিএনপির পক্ষ থেকে দেখা যাচ্ছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগের বিষয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে কোনো চাপ নেই। তবে ড. ইউনূস স্বেচ্ছায় চলে যেতে চাইলে জাতি বিকল্প জনগণ বেছে নেবে।’

তবে চলমান পরিস্থিতিতে যদি ড. ইউনূস পদত্যাগ করেন তাহলে আবারও ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানো বন্ধের হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন বিভিন্ন দেশে বসবাসরত প্রবাসীরা। তারা বলছেন দেশের এই সংকটময় পরিস্থিতিতে বিভিন্ন সংস্কার কাজে ড. ইউনূসের কোনো বিকল্প নেই। ড. ইউনূস যদি পদত্যাগ করেন তাহলে প্রবাসীরা আবারও বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠবে। ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর বিভিন্ন গ্রুপে রেমিট্যান্স শাটডাউনের হুঁশিয়ারি দিয়ে বিভিন্ন ক্যাম্পেইন চালাচ্ছেন তারা।

দুবাই প্রবাসী আনাম মাহমুদ একটি গ্রুপে লিখেছেন– ‘ডঃ মোহাম্মদ ইউনূস যদি অভিমান নিয়ে পদত্যাগ করে চলে যান, তাহলে আমরা যারা দেশপ্রেমিক রেমিট্যান্স যোদ্ধা আছি আমরাও আরেকবার রেমিট্যান্স শাটডাউন করে দেখিয়ে দেব চোরের দলগুলোকে, ইনশাআল্লাহ।’ জোনায়েদ আহমেদ নামে আরেক প্রবাসী লিখেছেন– ‘ড. মুহাম্মদ ইউনূস পদত্যাগ করলে আমরা প্রবাসীরা একযোগে রেমিট্যান্স শাটডাউন ঘোষণা করবো।’

এছাড়াও কয়েকজন প্রবাসীর সাথে ফোনে যোগাযোগ করা হলে অধিকাংশই বিক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। এরমধ্যে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী খলিলুর রহমান বলেন– ড. ইউনূসের পদত্যাগের গুঞ্জন আমাদের অস্ট্রেলিয়া কমিউনিটিতেও বেশ আলোড়ন তৈরি করেছে। আমাদের এখানে ৯৫ ভাগ প্রবাসী ড. ইউনূসের ওপর আস্থা রাখতে চায়। দেশের এই সংকটময় পরিস্থিতিতে তার কোনো বিকল্প নাই। তিনি যদি কোনো ষড়যন্ত্রের কারণে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন তবে আমাদের প্রবাসীদের মধ্যে এর বড় প্রভাব পড়বে। আবারও রেমিট্যান্স শাটডাউনের মতো ঘটনা ঘটতে পারে।’

অস্ট্রেলিয়ার আরেক মাহাদী বলেন, ‘ড. ইউনূস তিনি একজন নোবেল বিজয়ী, সারা বিশ্বেই তার খ্যাতি রয়েছে। তিনি তার সব সামর্থ্য দিয়ে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। মূল্যস্ফীতি কমাতে কাজ করছেন। অথচ অনেক রাজনৈতিক দল তাকে সহযোগিতা করছে না। নির্বাচনের জন্য অস্থির হয়ে গেছে। আমরা চাচ্ছি তিনি আরও কিছু সময় দিন। এর পরে ফ্রি-ফেয়ার একটা নির্বাচন তার হাত ধরেই হোক। তাকে যদি এভাবে চলে যেতে হয় তবে আমরা প্রবাসীরা আবারও বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠবো।’

সৌদি প্রবাসী সোহাগ বলেন, ‘ড. ইউনূস চলে গেলে অধিকাংশ প্রবাসী বৈধ পথে টাকা পাঠানো থেকে সরে যাবে। জুলাইয়ের অভ্যুত্থানের পরে একটি বড় দল যে সকল কার্যক্রম দেখিয়েছে তাতে প্রবাসীরা অনেক ক্ষিপ্ত, এবং আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় পাঠ হিসেবে বিবেচনা করছে। এই মুহূর্তে ইউনূস ক্ষমতা ছাড়লে প্রবাসীরা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবে।’

জুলাই আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ও বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী ফাহাদ হক বলেন, ড. ইউনূস আন্তর্জাতিকভাবে অনেক জনপ্রিয় একজন ব্যক্তি। তার মাধ্যমেই ফ্রি-ফেয়ার নির্বাচন হওয়া সম্ভব। এবং তা আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হবে। দেশের জন্য তাকে আরও সময় দেওয়া খুব প্রয়োজন। আমরা প্রবাসীরা বিশ্বাস করি তার মাধ্যমে অর্থনীতি আরও সচল হবে। আমরা প্রবাসীরা সবাই ইউনূসের পক্ষে। তিনি যদি এই মুহূর্তে পদত্যাগ করেন তবে আবারও রেমিট্যান্সে ধস নামবে।’

এদিকে ড. ইউনূস সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে নিত্য-নতুন ইতিহাস তৈরি হচ্ছে রেমিট্যান্স প্রবাহে। ইতোমধ্যে এক মাসে ৩.২৯ বিলিয়ন রেমিট্যান্স আহরণের মাইলফলক ছুঁয়েছে বাংলাদেশ। গত বছরের জুলাই মাসে প্রবাসী রেমিট্যান্স শাটডাউন ঘোষণার কারণে ওই মাসে রেমিট্যান্স কমে দাঁড়ায় ১.৯৫ বিলিয়ন ডলার। যদিও ওই মাসে মাত্র ১০ দিনের মতো রেমিট্যান্স পাঠানো বন্ধ রেখেছিলেন প্রবাসীরা। এর পরের মাসে অর্থাৎ ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতন হলেই বাড়তে থাকে রেমিট্যান্স প্রবাহ।

পরবর্তীতে আগস্টে রেমিট্যান্স এসেছিল ২২২ কোটি ১৩ লাখ ২০ হাজার মার্কিন ডলার, সেপ্টেম্বরে এসেছে ২৪০ কোটি ৪১ লাখ, অক্টোবরে এসেছে ২৩৯ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার, নভেম্বর মাসে এসেছে ২২০ কোটি ডলার, ডিসেম্বরে এসেছে ২৬৪ কোটি ডলার, জানুয়ারিতে ২১৯ কোটি ডলার এবং ফেব্রুয়ারিতে ২৫৩ কোটি ডলার ও মার্চে এসেছে রেকর্ড ৩২৯ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স ও এপ্রিল মাসে এসেছিল ২৭৫ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়। চলতি মে মাসেও রেমিট্যান্স তিন বিলিয়ন ডলার ছাড়ানোর প্রবাহ দেখা যাচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সময়ে কোনো কারণে রেমিট্যান্সের গতি কমে গেলে রিজার্ভে এর ভয়াবহ প্রভাব পড়তে পারে। এ বিষয়ে গবেষণা সংস্থা চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের রিসার্চ ফেলো ও অর্থনীতিবিদ এম হেলাল আহমেদ জনি বলেন– আমাদের মতো দেশগুলোতে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স ব্লাডের মতো চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করে। এই মুহূর্তে প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠানো বন্ধ করলে রিজার্ভে অনেক বড় ধাক্কা আসবে। যা দেশের অর্থনীতিতে অনেক ভয়াবহ প্রভাব ফেলবে। এই মুহূর্তে দেশের স্বার্থে জাতীয় ঐক্যমত প্রতিষ্ঠা অত্যন্ত জরুরি।

এসএম/টিএ

Share this news on:

সর্বশেষ

img
মহাসমাবেশের পর ঢাবিতে পরিচ্ছন্নতা অভিযানে জামায়াত Jul 20, 2025
img
করোনার পর সামাজিক বিচ্ছিন্নতা বাড়ায় ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বৃদ্ধি Jul 20, 2025
img
যুক্তরাষ্ট্রে বাড়ছে প্রাপ্তবয়স্কদের একাকীত্ব Jul 20, 2025
img
বাবা-মায়ের দূরত্ব ছাপিয়ে ক্যারিয়ারের স্বপ্নে উজ্জ্বল সারা Jul 20, 2025
img
এনসিপির রাঙামাটির সমাবেশে পাটওয়ারীর অংশগ্রহণে আপত্তি জেলা ছাত্রদলের Jul 20, 2025
img
বিশ্বের দ্রুততম ইন্টারনেট তৈরি করল জাপান Jul 20, 2025
img
উলভসের হল অব ফেমে জায়গা করে নিলেন দিয়োগো জোতা Jul 20, 2025
img
‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব শক্তিকে বিএনপির নেতৃত্বে ঐক্যের আহ্বান ফজলুর রহমানের’ Jul 20, 2025
img
সোমবার ফেনীতে এনসিপির পদযাত্রা Jul 20, 2025
১০ মিনিটে গোটা বিশ্বের সারাদিনের সর্বশেষ আলোচিত সব খবর Jul 20, 2025
জামায়াতের মঞ্চে ঝড় তুললেন সাবেক বিএনপি নেতা Jul 20, 2025
৬০০ কোটি দামের অ্যাপাচি হাতে পাচ্ছে মোদি, নজর সরাসরি পাকিস্তান সীমান্তে Jul 20, 2025
জামায়াতের সমাবেশে যা বললেন নূরুল হক নূর Jul 20, 2025
জনসমুদ্র জামায়াতের, পড়ে গেলেন আমির, বললেন, অভ্যুত্থানের মতো আরেকটা লড়াই হবে Jul 20, 2025
img
চ্যাটজিপিটির সহায়তায় ৬ মাসে ২৭ কেজি ওজন কমালেন এক ব্যক্তি Jul 20, 2025
img
‘কান্তারা’র পর ঐতিহাসিক চরিত্রে আবারো রিশভ শেট্টির জয়জয়কার Jul 20, 2025
img
খুলনায় মদপানে প্রাণ গেল ৫ জনের, বিক্রেতা আটক Jul 20, 2025
img
জামায়াত আমিরের খোঁজ নিয়েছেন খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান Jul 20, 2025
img
৬টি ত্রুটি এনসিপির নিবন্ধন আবেদনে, সময় দিল নির্বাচন কমিশন Jul 20, 2025
img
শ্রমিক স্বার্থ রক্ষায় রাস্তায় নামতে দ্বিধা করব না: শ্রম উপদেষ্টা Jul 20, 2025