জনগণের আস্থা ফিরাতে সংস্কার ও নির্বাচনের সুস্পষ্ট রোডম্যাপ দিন: জামায়াত আমির

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, আমরা সরকারের কাছে সংস্কার ও নির্বাচনের রোডম্যাপ দাবি করেছিলাম। সুস্পষ্ট রোডম্যাপ না থাকায় জনগণের মধ্যে সংশয় তৈরি হয়েছে। জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য আমরা সরকারের প্রতি সুস্পষ্ট রোডম্যাপ দাবি করছি। এরপর আমাদের দাবি ছিল ফ্যাসিবাদের সুষ্ঠু বিচার। এ বিচার প্রক্রিয়া অনেক দীর্ঘ। তবে জাতির কাছে বিশ্বাসযোগ্য বিচারকার্য অনতিবিলম্বে দৃশ্যমান হতে হবে।

শনিবার সকালে রাজধানী ঢাকার মগবাজারস্থ আল-ফালাহ মিলনায়তনে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার ষান্মাসিক অধিবেশনের উদ্বোধনী বক্তব্যে একথা বলেন ডা. শফুকির রহমান।

তিনি বলেন, স্বাধীনতার মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং ২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের এই দীর্ঘ পরিক্রমায় জাতির মূল প্রত্যাশার অনেকগুলো আজও অপূর্ণ থেকে গেছে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়নি। নাগরিক অধিকার নিশ্চিত হয়নি। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলো দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের মর্যাদাপূর্ণ হেফাযত সংরক্ষণ করতে পারেননি। গত ১৫ বছরের শাসকগোষ্ঠী দেশকে দুঃশাসন উপহার দিয়েছে। তাদের পুরোটা সময় মানুষ দুঃস্বপ্নে বসবাস করেছে। জেল-জুলুমের স্টিমরোলার জাতির ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের কাউকে বিচারের নামে প্রহসন করে আবার কাউকে বিনা বিচারে হত্যা করা হয়েছে। আয়নাঘর বানিয়ে গুমের সংস্কৃতি চালু করা হয়েছে। একটি স্বাধীন দেশে ২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থানে দেশে যা ঘটেছে তার সাক্ষী দেশের আপামর জনগণসহ গোটা বিশ্ববাসী। ইতোমধ্যেই জাতিসংঘের ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি এবং মানবাধিকার সংগঠন ঐ সময়ের সরকারকে স্পষ্টভাবে দায়ী করে জুলাই-আগস্টের ঘটনার একটি রিপোর্ট পেশ করেছে।

তিনি আরও বলেন, বর্তমানে আমরা জাতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁকে অবস্থান করছি। এই বাঁক সফলভাবে উত্তরণ করতে হবে। বিশেষ করে গত কয়েক দিনের ঘটনা প্রবাসীসহ দেশবাসীকে বিচলিত করেছে। এ ব্যাপারে জামায়াতে ইসলামী একটি দায়িত্বশীল সংগঠন হিসেবে সতর্ক দৃষ্টি রাখছে। আমরা দ্রুততম সময়ে কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের জরুরি সভা করে দেশের চলমান বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। আলোচনায় আমরা বলেছি সংঘাত-সংঘর্ষ এবং কাদা ছোড়াছুড়ি করে জাতিকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দেওয়া একেবারেই সমীচীন হবে না।

তিনি বলেন, জামায়াতের রাজনীতি দেশ ও জনগণের কল্যাণে। জামায়াত সবসময় জনগণের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে দলীয় পরিকল্পনা-কর্মসূচি রচনা ও পরিচালনা করে। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে আমরা সংগঠনের পক্ষ থেকে কতিপয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। এই অনিশ্চয়তা উত্তরণে আমরা অন্তর্বতী সরকারের প্রধান উপদেষ্টাকে সর্বদলীয় ডায়ালগ করার আহ্বান জানিয়েছি। আমরা বিশ্বাস করি সকলের সন্তোষজনক আলোচনার মাধ্যমে জাতির আতঙ্ক ও আশঙ্কা দূর হবে এবং এ সংকটের উত্তরণ ঘটবে ইনশাআল্লাহ।

তিনি বলেন, ২০১৪ তে ১৫৪ জনকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়, ২০১৮ তে নিশি রাতের ভোট এবং ২০২৪ এ ডামি আর আমি’র প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে জাতির সাথে চরম তামাশা করা হয়েছে। এ অবস্থায় জাতিকে একটি সুন্দর নির্বাচন উপহার দিতে হবে; যার মাধ্যমে সত্যিকার অর্থে জনগণের মতের প্রতিফলন ঘটবে এবং জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে।

আমরা সরকারের কাছে সংস্কার ও নির্বাচনের রোডম্যাপ দাবি করেছিলাম। সুস্পষ্ট রোডম্যাপ না থাকায় জনগণের মধ্যে সংশয় তৈরি হয়েছে। জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য আমরা সরকারের প্রতি সুস্পষ্ট রোডম্যাপ দাবি করছি। এরপর আমাদের দাবি ছিল ফ্যাসিবাদের সুষ্ঠু বিচার। এ বিচার প্রক্রিয়া অনেক দীর্ঘ। তবে জাতির কাছে বিশ্বাসযোগ্য বিচারকার্য অনতিবিলম্বে দৃশ্যমান হতে হবে।

তিনি আরও বলেন, সম্প্রতি দুটি স্পর্শকাতর বিষয় জাতির সামনে এসেছে। মানবিক করিডোর ও চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর ব্যবস্থাপনা। এব্যাপারে সিকিউরিটি এক্সপার্ট এবং দেশের সকল পক্ষের সাথে আলোচনা করে যথাযথ সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। অথবা নির্বাচিত পার্লামেন্ট-এর জন্য রেখে দেওয়া যেতে পারে।

সেনাবাহিনী প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সেনাবাহিনী আমাদের গর্বের বিষয়। ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ বাঁকে তাদের মর্যাদাপূর্ণ অবদান রয়েছে। সেনাবাহিনীকে বিতর্কিত করা উচিত নয়। জাতির প্রত্যাশা সেনাবাহিনী স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার মাধ্যমে দেশ ও জাতির সেবা করবে এবং দেশের রাজনৈতিক দলগুলো ও সেনাবাহিনী যার যার অবস্থান থেকে নিজ নিজ দায়িত্ব পালনের দিকে নজর দিবে।

তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টা একাধিকবার বলেছেন জাতীয় নির্বাচন তিনি এ বছরের ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে সম্পন্ন করতে চান। এতে আমাদের আস্থা রয়েছে। এব্যাপারে আমরা সরকারকে সব ধরনের সহযোগিতা করতে চাই।
ফিলিস্তিন প্রসঙ্গে আমীরে জামায়াত শান্তিকামী বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, ফিলিস্তিনের জনগণ দশকের পর দশক ধরে নির্যাতিত এবং নিষ্পেষিত হচ্ছে। গাজা ও ফিলিস্তিনে মানবতাবিরোধী যুদ্ধ চলছে। আমরা জাতিসঙ্ঘসহ শান্তিকামী ও মানবতাবাদী বিশ্বসম্প্রাদয়কে যুদ্ধবিরতি নয়, স্থায়ীভাবে যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানাচ্ছি। সিরিয়াকে সে দেশের জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী চলতে দেওয়া উচিত বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
আরাকান প্রসঙ্গে আমীরে জামায়াত বলেন, আরাকানের রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নিয়ে সম্মান ও নিরাপত্তার সাথে পুনর্বাসিত করতে হবে। এব্যাপারে জাতিসঙ্ঘকেই প্রধান ভূমিকা পালন করতে হবে।

আমীরে জামায়াত নিজ দলের দায়িত্বশীলদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, সকল ক্ষেত্রে আমাদের দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। সকল ব্যাপারে সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে। সংগঠনের সর্বস্তরের নেতাকর্মীকে সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার ব্যাপারে দিক নির্দেশনা দিতে হবে।

সাংবাদিকদের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আপনারা সমাজের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। আপনাদেরকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়। আমাদের প্রত্যাশা আপনাদের ইতিবাচক ভূমিকা সমাজকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে এগিয়ে নিয়ে যাবে। আসুন আমরা কালোকে কালো এবং সাদাকে সাদা বলি।

সবশেষে তিনি বলেন, বাংলাদেশকে জনপ্রত্যাশার জায়গায় পৌঁছে দেয়ার জন্য আমাদের প্রিয় সংগঠন অতীতে অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছে; ভবিষ্যতের জন্যও আমরা প্রস্তুত। আল্লাহ তায়ালার বিধানে বিশ্ব মানবতার কল্যাণ নিশ্চিত করা হয়েছে। এই বিধানের মাধ্যমেই সব ধর্মের মানুষের জীবন-সম্পদ ও ইজ্জতের নিরাপত্তা এবং তাদের নিজ নিজ অধিকার নিশ্চিত করার আমাদের লড়াই-সংগ্রাম, চেষ্টা-প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। আসুন আমরা একটি শান্তিপূর্ণ, দুর্নীতিমুক্ত মানবিক কল্যাণ রাষ্ট্র গড়ার প্রত্যয়ে ঐক্যবদ্ধ হই। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন প্রিয় দেশকে সকল ধরনের ক্ষতি ও ষড়যন্ত্রের হাত থেকে রক্ষা করুন। অনৈক্য ও বিভাজন তৈরি না করি। দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে দেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দিই।

কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার ষান্মাসিক অধিবেশনে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীরবৃন্দ, ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেলবৃন্দসহ কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ এবং কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার (পুরুষ ও মহিলা) সদস্যগণ উপস্থিত ছিলেন।

এসএন 

Share this news on:

সর্বশেষ

img
ভারতকে আলোচনায় বসার আহ্বান জানালো পাকিস্তান May 25, 2025
img
মমতাজ ও তার ভাগ্নের ফাঁসির দাবিতে মানিকগঞ্জে বিক্ষোভ মিছিল May 25, 2025
img
যথেষ্ট সাংবাদিক না থাকায় আবারও স্থগিত উপদেষ্টা ফারুকীর সংবাদ সম্মেলন May 25, 2025
img
সব দল প্রধান উপদেষ্টার প্রতি সমর্থন জানিয়েছে: প্রেস সচিব May 25, 2025
img
ড. ইউনূস এমন সিদ্ধান্ত নেবেন না যাতে দেশ ফের অস্থিতিশীল হয়: মান্না May 25, 2025
img
সংস্কারের আগে নির্বাচন হলে জনগণের আশা পূরণ হবে না: জামায়াত আমির May 24, 2025
বিতর্কিত উপদেষ্টাদের বাদ দেয়াসহ বিএনপির ৬ দাবি May 24, 2025
img
শাহবাগে প্রতিবাদ সমাবেশের ডাক জুলাই ঐক্যের May 24, 2025
লন্ডনে জব্দ হাসিনার ঘনিষ্ঠদের ১৫০০ কোটি টাকা May 24, 2025
পদত্যাগের নাটক করছেন ড. ইউনূস অভিযোগ রুমিন ফারহানার May 24, 2025
‘হ্যালো’ বললেই টাকা! লাইভে চমক আনলেন অনন্ত-বর্ষা May 24, 2025
img
রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক শেষে যা জানালেন প্রেস সচিব May 24, 2025
img
বাংলাদেশ-সিঙ্গাপুর ম্যাচের টিকিট যেন সোনার হরিণ May 24, 2025
img
৪০ বছর ধরে সঞ্চয় করে হজে গেলেন ইন্দোনেশিয়ান দম্পতি May 24, 2025
img
হামজাদের স্বপ্নভঙ্গ করে প্রিমিয়ার লিগে সান্ডারল্যান্ড May 24, 2025
img
‘রাষ্ট্রের স্বার্থেই সাংবাদিকদের সুরক্ষা দেওয়া উচিত’ May 24, 2025
img
মুস্তাফিজের রেকর্ড গড়া বোলিং, তবুও বড় সংগ্রহ পাঞ্জাবের May 24, 2025
দায়িত্ব পালন অসম্ভব করে তুললে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে সরকার May 24, 2025
১৭ ছাপাখানা, ৩৫৫ কোটি টাকার কেলেঙ্কারি! May 24, 2025
img
প্রধান উপদেষ্টার কাছে ৫ দাবি জানাল এনসিপি May 24, 2025