গর্বাচেভ: একজন উদার গণতান্ত্রিক নেতার গল্প

মিখাইল গর্বাচেভ। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির মহাসচিব। ছিলেন গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত রাশিয়ার প্রথম প্রেসিডেন্ট। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপে কমিউনিস্টের বিস্তার প্রতিরোধ করতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। গণতান্ত্রিক সংস্কারের জন্য তার লড়াই স্নায়ুযুদ্ধের অবসান করেছিল। তার আপ্রাণ চেষ্টার ফলেই বার্লিন দেয়াল পতনের মাধ্যমে দুই জার্মানি এক হয়েছিল।

শান্তির জন্য তার এই অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি ১৯৮৯ সালে অটোহ্যান শান্তি পদক ও ১৯৯০ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পান। গর্বাচেভ ১৯৩১ সালে উত্তর ককেশাস অঞ্চলের স্টেভরপোলে এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বয়স যখন ১১ বছর, তখন জার্মান বাহিনী তাদের গ্রাম দখল করে নেয়। জার্মান সেনাদের নির্যাতন ও গ্রামের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা তার মধ্যে যুদ্ধবিরোধী মনোভাবের জন্ম দেয়।

আইন বিষয়ে পড়তে ১৯৫০ সালে তিনি মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং এখান থেকেই সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হিসেবে রাজনীতিতে যোগ দেন। আইন বিষয়ে ভালো জ্ঞান আর দক্ষতার কারণে ১৯৮০ সালে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির  কনিষ্ঠতম পলিটব্যুরো সদস্য নিযুক্ত হন। ১৯৮৫ সালে পার্টির মহাসচিবের দায়িত্ব পান।

দলের ক্ষমতা নেয়ার পরপরই তিনি সংস্কার কর্মসূচিতে হাত দেন। তিনি ‘গ্লাসনস্ত’ ও ‘পেরেস্ত্রইকা’ নামে দুটি সংস্কার নীতি চালু করেন। ‘পেরেস্ত্রইকা’ হল গর্বাচেভের একটি অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচি, যার উদ্দেশ্য অর্থনীতিকে বাজার ব্যবস্থার উপর ছেড়ে দিয়ে একটি অবাধ অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করা।

অন্যদিকে ‘গ্লাসনস্ত’ হল তার একটি রাজনৈতিক কর্মসুচি, যার উদ্দেশ্য নাগরিকের ধর্মীয় ও ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার নিশ্চিত করা। তার এই নীতি গণতন্ত্রের এক নতুন দ্বার উন্মোচন করে এবং বহু কারাবন্দী গণতান্ত্রিক নেতার মুক্তি নিশ্চিত করে।

সোভিয়েত ইউনিয়নের কঠোর অবস্থানের বিরুদ্ধে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো দীর্ঘদিন ধরে গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করছিল। তাই গর্বাচেভের এই নীতিগুলো পূর্ব ইউরোপের গণতন্ত্রের জন্য ছিল এক মাইলফলক। মূলত তার এই নীতির ফলেই সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে অস্ত্র প্রতিযোগিতা হ্রাস পায় এবং কয়েক দশক ধরে চলা স্নায়ুযুদ্ধের অবসান হয়। তিনি বলেছিলেন, “তারকা যুদ্ধ নয়, আমাদের তারকা শান্তি প্রয়োজন।”

১৯৯১ সালে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে ১৫ টি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। ফলে দ্বি-মেরুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার পরিবর্তে মার্কিন নেতৃত্বাধীন এক-মেরুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার যাত্রা শুরু হয়। এ পরিবির্তনের জন্য গর্বাচেভের সংস্কারনীতিই মূলত ভূমিকা রেখেছে।

সোভিয়েত ইউনিয়ন রক্ষায় ব্যর্থ হওয়ায় তিনি পরবর্তীতে অনুশোচনা করেছেন। তবে তিনি বলেছেন, তার এই নীতিগুলোর উদ্দেশ্য ছিল সংস্কারের মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়নকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। গণতন্ত্রের প্রতি তার এই উদার মনোভাবের জন্য তিনি কট্টর কমিউনিস্টদের রোষানলে পড়েন।

১৯৯১ সালে তার বিরুদ্ধে সেনা অভ্যুত্থান হয়। অভ্যুত্থান ব্যর্থ হলেও কমিউনস্ট পার্টির ‘পলিটব্যুরো’ সদস্য পদ হারান।

এরপর ১৯৯১ সালে গর্বাচেভ প্রেসিডেন্ট পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ২০০১ সালে সোস্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি অফ রাশিয়া ও ২০০৭ সালে ইউনিয়ন অফ সোস্যাল ডেমক্রেটের মাধ্যমে তিনি আবারো রাশিয়ার রাজনীতিতে আসেন। যদিও এ ক্ষেত্রে তিনি সফল হতে পারেন নি।

গর্বাচেভ বিভিন্ন সময় রাশিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট পুতিনকে সমর্থন দিয়ে আসছেন। তবে ২০১১ সালে পুতিন তৃতীয়বার প্রেসিডেন্ট হলে তিনি তার কঠোর সমালোচনা করেন। সব ক্ষমতা নির্বাহী বিভাগকে দিয়ে রাশিয়ার রাজনীতিতে যে পরিবর্তন আসছে তা নিয়ে তিনি সতর্ক করেছেন।

আরেকটি স্নায়ুযুদ্ধের আশংকা করে তিনি গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আমেরিকার হস্তক্ষেপ বিপর্যয় নিয়ে আসবে বলে তিনি সতর্ক করেছেন।

২০০৭ সালের অর্থনৈতিক দুর্যোগের জন্য তিনি মুক্তবাজার অর্থনীতির সীমাবদ্ধতাকে দায়ী করছেন এবং অর্থনীতি নিয়ে নতুন করে ভাবা উচিত বলে মন্তব্য করেছেন।

বিশ্বের পরিবেশ সংরক্ষণে কাজ করতে তিনি ‘গ্রিন ক্রস ইন্টারন্যাশনাল’ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছেন। ব্যক্তিগতভাবে নাস্তিক হলেও ধর্মীয় স্বাধীনতার ব্যাপারে তিনি অত্যন্ত উদার। ভারতের আধ্যাত্মিক গুরু শ্রী চিন্ময়ের সঙ্গে রয়েছে তার গভীর বন্ধুত্ব।

 

টাইমস/এএইচ/জিএস

Share this news on: