ইয়াসির আরাফাত: ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা আন্দোলনের মহানায়ক

ইয়াসির আরাফাত, ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা আন্দোলনের পথিকৃৎ। এক অবিসংবাদিত আরব জাতীয়তাবাদী নেতা। ১৯৬৯-২০০৪ পর্যন্ত প্যালেস্টাইন লিবারেশন অরগেনাইজেশন (পিএলও)এর চেয়ারম্যান ও ১৯৯৪-২০০৪ পর্যন্ত প্যালেস্টাইন ন্যাশনাল অথরিটির (পিএনএ) প্রেসিডেন্ট ছিলেন।

১৯২৯ সালের ২৪ আগস্ট মিশরের কায়রোতে এক ফিলিস্তিনি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ইয়াসির আরাফাত। শৈশবের অধিকাংশ সময়ই তিনি মিশরের কায়রোতে ছিলেন। লেখাপড়া করেছেন মিশরের কিং ফুয়াদ ইউনিভার্সিটিতে। এখান থেকেই তিনি আরব জাতীয়তাবাদে আকৃষ্ট হন এবং ইহুদিবাদ বিরোধী আদর্শে প্রভাবিত হন।

১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিন ভাগ করে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিবাদে ১৯৪৮ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধে মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুডের পক্ষে তিনি ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেন। ১৯৫২-৫৬ পর্যন্ত ফিলিস্তিনি ছাত্রদের জেনারেল ইউনিয়নের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেছেন।

ইসরাইলকে উৎখাত করে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৫৯ সালে তিনি আধাসামরিক সংগঠন ‘ফাতাহ’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৫৯ থেকে ২০০৪ পর্যন্ত তিনি এ দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন। এ দলটি মিশর, জর্ডান, লেবাননসহ বিভিন্ন আরব দেশ থেকে ইসরাইলের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যেতে থাকে।

১৯৮৩-৯৩ সাল পর্যন্ত তিনি তিউনিসিয়ায় ছিলেন এবং সশস্ত্র সংগ্রামের পরিবর্তে ইসরাইলের সঙ্গে সমঝোতা ও শান্তি আলোচনার চেষ্টা চালিয়ে যান। ১৯৮৮ সালে তিনি ইসরাইল রাষ্ট্রের অস্তিত্ব স্বীকার করে নেন এবং ফিলিস্তিন-ইসরাইল সংকট নিরসনে ‘দ্বি-রাষ্ট্র’ ভিত্তিক সমাধান নীতির প্রতি সম্মতি দেন।

তার নেতৃত্বেই ১৯৮৮ সালের ১৫ নভেম্বর জেরুজালেমকে রাজধানী করে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের ঘোষণা দেয়া হয়। স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে সর্বপ্রথম স্বীকৃতি দেয় আলজেরিয়া।

১৯৯৪ সালে তিনি গাজায় বসতি স্থাপন করেন। ফিলিস্তিন-ইসরাইল সংকট নিরসনের লক্ষ্যে তিনি ইসরাইলের সঙ্গে বেশ কিছু শান্তি আলোচনা ও সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করেন। তার নেতৃত্বে ১৯৯৩ সালে ইসরাইল ও পিএলও এর মধ্যে ঐতিহাসিক ‘অসলো চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়। স্বাধীন ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি না দিলেও এ চুক্তির মাধ্যমে ইসরাইল ও পিএলও পরস্পরকে স্বীকৃতি দেয়।

এই চুক্তি স্বাক্ষর করায় ১৯৯৪ সালে আইজ্যাক রবিনের সঙ্গে তিনি নোবেল শান্তি পুরস্কার পান। তার কূটনৈতিক প্রচেষ্টার ফলে ১৯৯৫ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর ইসরাইল ও পিএলও এর মধ্যে গাজা ও পশ্চিম তীর সম্পর্কিত অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ফলে গাজা ও পশ্চিম তীরে সীমিত আকারে ফিলিস্তিনের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। রামাল্লাকে রাজধানী করে গাজা ও পশ্চিম তীরের প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনা করে পিএনএ। যার প্রেসিডেন্ট হন ইয়াসির আরাফাত।

ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বে ফাতাহের উত্থানে ফিলিস্তিনে আরেক বিপ্লবী সংগঠন হামাসের প্রভাব কমে আসে। ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংকটের দীর্ঘমেয়াদি ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাতিসংঘ ২০০২ সালে শান্তির জন্য রোডম্যাপ প্রস্তাব ঘোষণা করে। এ প্রস্তাব প্রণয়নে ভূমিকা রাখেন ইয়াসির আরাফাত।

ইসরাইল কর্তৃক দুই বছর ধরে রামাল্লা অবরোধের সময় ২০০৪ সালের শেষ দিকে ইয়াসির আরাফাতের স্বাস্থ্যের অবনতি হতে থাকে। পরে ২০০৪ সালের ১১ নভেম্বর ফ্রান্সের প্যারিসে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান এই মহান নেতা।

ফ্রান্সের সামরিক বাহিনী তার কফিনে গার্ড অব অনার প্রদান করেন এবং ফরাসি প্রেসিডেন্ট জ্যাক শিরাক আরাফাতকে একজন ‘বীর পুরুষ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।

মিশরের কায়রোতে তার শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা উপস্থিত হয়ে এই মহান নেতার প্রতি সম্মান জানান।

জেরুজালেমে পবিত্র আল-আক্বসা মসজিদের পাশে সমাহিত করার পরিকল্পনা থাকলেও ইসরাইলের আপত্তির কারণে তাকে রামাল্লায় সমাহিত করা হয়।

ইয়াসির আরাফাতকে বিষক্রিয়া দ্বারা হত্যা করা হতে পারে বলে অনেক বিশ্লেষক অভিযোগ করেন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এ নিয়ে অনেক তদন্ত ও গবেষণা করে।

সর্বশেষ ২০১৫ সালে ফ্রান্সের এক চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ইয়াসির আরাফাতের মৃত্যুর কারণ ছিল স্বাভাবিক। তার দেহে পলোনিয়াম নামে যে বিষাক্ত পদার্থের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে, তা প্রাকৃতিক কারণেই হয়েছে বলে এ প্রতিবেদনে বলা হয়।

ইসরাইলের দৃষ্টিতে তিনি একজন বিতর্কিত ব্যক্তি হলেও ফিলস্তিনিসহ বিশ্বের নিপীড়িত মুক্তিকামী মানুষের কাছে ইয়াসির আরাফাত ছিলেন একজন পথ প্রদর্শক।

তিনি বলেছিলেন, “আমার এক হাতে জলপাই গাছের শাখা (শান্তির প্রতীক), আর এক হাতে যুদ্ধাস্ত্র। আমার হাত থেকে জলপাই গাছের শাখা পড়তে দিও না।”

  

টাইমস/এএইচ/জিএস

Share this news on:

সর্বশেষ

img
বিনিয়োগ সম্ভাবনা যাচাইয়ে রাজধানীতে আন্তর্জাতিক প্রতিনিধি দল Nov 02, 2025
img
আর্সেনালের নির্ভার জয়, হোঁচট খেলো ম্যানইউ Nov 02, 2025
img
যেকোনো মূল্যে বাংলাদেশকে হারাতে চায় ভারত Nov 02, 2025
img
প্রোটিয়াদের ৪ উইকেটে হারিয়ে সিরিজ জয় পাকিস্তানের Nov 02, 2025
img
রোববার প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে বৈঠক করবে এনসিপি Nov 02, 2025
img
যুবদল নেতা নয়নের চাঁদাবাজির টাকা নিয়ে গণভোট করা সম্ভব : নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী Nov 02, 2025
img
২০০ যাত্রী নিয়ে ডুবোচরে আটকে গেল লঞ্চ Nov 02, 2025
img
ঢাবি শিক্ষিকাকে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্যের প্রতিবাদে মশাল মিছিল Nov 02, 2025
img
দেশে নতুন প্রতারকের জন্ম হয়েছে : কায়সার কামাল Nov 02, 2025
img
চ্যাম্পিয়ন হলে রোহিত-কোহলিদের সমান বোনাস পাবেন ভারতের মেয়েরা Nov 02, 2025
img
অন্তর্জালে অমির ‘১২ মাস’, নেটিজেনদের প্রশংসায় ভাসছেন অমি Nov 02, 2025
img
‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়ে বিএনপি সংস্কারবিরোধী অবস্থান নিয়েছে : সাদিক কায়েম Nov 02, 2025
img
কিছু রাজনৈতিক দল নির্বাচন ব্যাহত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত : রোকন উদ্দীন Nov 02, 2025
img
নিকোলের সঙ্গে বিচ্ছেদের খবর স্বীকার করলেন ইয়ামাল, দাবি স্প্যানিশ সাংবাদিকের Nov 01, 2025
img
সুষ্ঠুভাবে কাজ শেষ করায় ঐকমত্য কমিশনকে প্রধান উপদেষ্টার অভিনন্দন Nov 01, 2025
img
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে আ. লীগের ঝটিকা মিছিল, গ্রেপ্তার ১৩ Nov 01, 2025
img
জাতীয় নির্বাচন ঘিরে মোতায়েন থাকবে যৌথ বাহিনীর ৯৪ হাজার সদস্য Nov 01, 2025
img
জাতীয় পার্টির রাজনীতিতে আ. লীগের প্রভাব ছিল : শামীম হায়দার Nov 01, 2025
img
সকাল ৯টার মধ্যে ঢাকাসহ দেশের ১১ জেলায় ঝড়ের আভাস Nov 01, 2025
img
কেনিয়ায় ভূমিধসে প্রাণ গেল অন্তত ১৩ জনের Nov 01, 2025