সুব্রত বাইনকে নিয়ে গুম কমিশনের প্রতিবেদন, মুক্তি পেয়েছিলেন বন্দি বিনিময়ের মাধ্যমে

শেখ হাসিনার পতনের পর ২০২৪ সালের ৬ থেকে ৭ আগস্টের মধ্যে শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন র‍্যাবের টাস্ক ফোর্স ফর ইন্টারোগেশন (টিএফআই) সেল থেকে মুক্তি পান বলে গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। তবে ইন্টারপোলের তালিকাভুক্ত এই সন্ত্রাসীকে কারা, কেন, কীভাবে মুক্তি দিল, সেসব তথ্য প্রতিবেদনে আসেনি।

গত বুধবার (৪ জুন) গুম কমিশন ‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ: অ্যা স্ট্রাকচারাল ডায়াগনোসিস অব এনফোর্সড ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেয়।

বৃহস্পতিবার (৫ জুন) প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং প্রতিবেদনের দুটি অধ্যায় প্রকাশ করে। সেই প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে আসে।

প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, মুক্তির প্রায় আড়াই বছর আগে ভারত ও বাংলাদেশের ‘গোপন ও অবৈধ’ বন্দি বিনিময়ের মাধ্যমে সুব্রতকে র‍্যাবের হাতে তুলে দেওয়া হয়। দুই দেশের গোয়েন্দা সংস্থার মধ্যে বন্দি বিনিময়ের ঘটনাটি ঘটে ২০২২ সালের এপ্রিলের শেষ দিকে। ওই সময় সুব্রতকে ফিরে পাওয়ার বিপরীতে ভারতের এক অপরাধীকে সে দেশের হাতে তুলে দেওয়া হয়, যিনি র‍্যাবের টিএফআই সেলে বন্দি ছিলেন।

সুব্রতকে দেশে আনা হয় ২০২২ সালের ২৮ এপ্রিল। তিনি শুরু থেকেই র‍্যাবের টিএফআই সেলে বন্দি ছিলেন। সেখানে তিনি পাইলসসহ নানা শারীরিক সমস্যায় ভোগেন। বাইরের জগতের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ না থাকায় মানসিকভাবেও ভেঙে পড়েন। এদিকে, সুব্রতকে টিএফআই সেলে প্রশিক্ষণ দেওয়ার যে ‘গুজব’ অনলাইনে ছড়িয়ে পড়ে, তার কোনো প্রমাণ তাদের অনুসন্ধানে মেলেনি বলে জানিয়েছে কমিশন।

কমিশনের তথ্যানুযায়ী, মুক্তির পর তিনি আবার তার অপরাধ জগৎ পুনরায় গড়ে তোলেন। এক প্রভাবশালী রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষক জোগাড় করে আবার হত্যার আদেশ দিতে থাকেন। তাকে আবার গ্রেপ্তার করার আগ পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো তাকে ধরতে হিমশিম খাচ্ছিল।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ঘটনাটি জোরালোভাবে দেখায় যে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একজন কুখ্যাত ব্যক্তিকে আটক রাখার আদেশ র‍্যাব থেকে একা আসতে পারে না। এটি কমপক্ষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বা আরও ঊর্ধ্বতন স্তরের সিদ্ধান্ত ছিল। প্রশ্ন থেকে যায় কেন তাকে আইনি প্রক্রিয়ায় না এনে বছরের পর বছর গোপনভাবে আটক রাখা হলো। অথচ যেখানে অনেক কম অপরাধে অন্যদের হত্যা করা হয়েছে।

কমিশনের ধারণা, একসময় তাকে হত্যা করার পরিকল্পনা ছিল, কিন্তু সেটি বাস্তবায়ন হয়নি। যদি তাকে আদালতে হাজির করা হতো তাহলে হয়তো বিচারব্যবস্থা শুরু থেকেই তাকে আটক রাখতে পারত। কিন্তু তাকে আইনের বাইরে রাখা হয়েছিল, ফলে তার মুক্তি আইনি নিয়মে চ্যালেঞ্জ করা যায়নি। এভাবে তার অপরাধজগৎ আবার গড়ে তোলার সুযোগ তৈরি হয়। এই ঘটনা প্রমাণ করে, অবৈধ আটক শুধু ব্যক্তিগত অধিকার নয়, বরং জননিরাপত্তা ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর গ্রহণযোগ্যতাকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে।

২০২২ সালের এপ্রিলের শেষ দিকে বাংলাদেশ থেকে ভারতে গোপনে পাঠানো এক ব্যক্তিকে পশ্চিমবঙ্গের নিরাপত্তা সংস্থা মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই ছেড়ে দেয়। যদি তিনি সত্যিই ভয়ংকর অপরাধী হতেন, তাহলে এমন দ্রুত মুক্তি সম্ভব হতো না। বাইনকে অবৈধ ও অনানুষ্ঠানিক উপায়ে আটক রাখা রাষ্ট্রের পক্ষে তাকে আইনের আওতায় আনাকে কঠিন করে তোলে। ফলে, মূল্যবান সময় ও সম্পদ নষ্ট হয় এবং তিনি রাজনৈতিক সুরক্ষা নিয়ে আবারও অপরাধ জগতে সক্রিয় হন।

র‍্যাবের হেফাজতে বাইনকে আটকে রাখা হলেও কেন তাকে বিচারের মুখোমুখি করতে আদালতে আনা হয়নি, তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। তবে ধারণা করা হচ্ছে, তার অবৈধ স্থানান্তর বিচারিক প্রক্রিয়া জটিল করে তোলে এবং ভারতের কিছু সংস্থার সঙ্গে র‍্যাবের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগও এতে প্রভাব ফেলতে পারে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এই ধরনের গোপনীয়তা, অবৈধতা এবং অনানুষ্ঠানিক পদক্ষেপ দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী না করে বরং দুর্বল করে। জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে যে জোরপূর্বক গুমকে বৈধতা দেওয়া হয়, সেটিই শেষ পর্যন্ত নিরাপত্তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে।

আরআর/টিএ

Share this news on:

সর্বশেষ

ঈদে মেজবান আয়োজন ঢাবি শিবিরের! যা বললেন শিবির সভাপতি ফরহাদ Jun 07, 2025
img
দীপিকার বড় চমক, এবার ৮০০ কোটির ছবিতে এই বলিউড কুইন Jun 07, 2025
নির্বাচনী ঘোষনা শেষে যে প্রতিক্রিয়া জানালেন জামায়াত আমীর Jun 07, 2025
বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম উদ্বোধনে যা বললেন উপদেষ্টা আসিফ Jun 07, 2025
img
মেসি অনন্য, পৃথিবীতে আর কোনো লিওনেল মেসি আসা সম্ভব নয়: গার্দিওলা Jun 07, 2025
বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম উদ্বোধনে যা বললেন এজাজ Jun 07, 2025
img
জুলাইয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে যাচ্ছে অনুর্ধ্ব ১৯ দল Jun 07, 2025
img
ক্যান্সারের আক্রান্ত দীপিকা, ১৪ ঘণ্টার দীর্ঘ অস্ত্রোপচার Jun 07, 2025
img
দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে আমরা দেশের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করব: হাসনাত আব্দুল্লাহ Jun 07, 2025
img
২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ২৬ জন Jun 07, 2025
img
'একান্তই যদি কাউকে কষ্ট দিতে চান, তবে তাকে হাসির পাত্র বানিয়ে দিন' Jun 07, 2025
img
দেশকে গণতান্ত্রিক ধারা থেকে সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে: ইশরাক Jun 07, 2025
img
স্টেজ শো-তে ব্যস্ত, দেশ-বিদেশে ছুটছেন মিষ্টি জান্নাত Jun 07, 2025
img
এবার ঈদে এফডিসিতে হয়নি কোনো কোরবানির আয়োজন Jun 07, 2025
img
ঈদের দিনেও ঢামেকে রোগীদের সেবায় নিয়োজিত নার্স-চিকিৎসকরা Jun 07, 2025
img
ঈদে স্বর্ণের দামে স্বস্তির হাওয়া Jun 07, 2025
img
তোমার সব কিছুই যত্নে রেখেছি মা : আরিফিন শুভ Jun 07, 2025
img
নরওয়ের কাছে হেরে বিশ্বকাপ নিয়ে অনিশ্চয়তায় ইতালি Jun 07, 2025
img
১২ ঘণ্টার মধ্যেই সকল বর্জ্য অপসারণ করার চেষ্টা চলমান: আসিফ মাহমুদ Jun 07, 2025
img
মেসির শৈশবের ক্লাবের সিদ্ধান্তে ক্ষোভ, সমালোচনার মুখে কর্তৃপক্ষ Jun 07, 2025