নতুন রূপে ‘তারে জমিন পার’ কেন বানালেন আমির?

আমির খানকে দেখে কেউই হয়তো বলবে না, তিনি খুব আবেগপ্রবণ মানুষ। কিন্তু যখন নিজের শৈশবের গল্প বলতে শুরু করেন, বোঝা যায় ভিতরটা কতটা নরম, কতটা গল্পপ্রীতিতে গড়া মানুষ তিনি।

“আমি যখন পাঁচ-ছয় বছরের, তখন বাবার ঘরে বসে লেখকদের গল্প শোনাতাম। বুঝতাম না তখন কী হচ্ছে, কিন্তু পরে বুঝেছি ওটাই ছিল আমার গল্প শেখার ক্লাস,” বলেন আমির।

এত বছর পরও গল্পই ঘিরে রেখেছে তাঁকে। ‘সিতারে জমিন পার’ দিয়ে তিনি আবার ফিরেছেন। না, কোনও মারপিট, তারকাবহুল ছবি নয়। বরং এমন এক সিনেমা, যেখানে দশজন নিউরোডাইভার্জেন্ট শিশুর জীবনে আসে এক বদরাগী কোচ, আর সেই কোচকেই পাল্টে দেয় ওরাই।

এই ছবিকে অনেকে ‘তারে জমিন পার’-এর আত্মিক ধারাবাহিকতা বলছেন। তবে আমির বলেন, “সেই ছবিতে শিক্ষক শিশুকে সাহায্য করেছিল। আর এবার? শিশুরাই সাহায্য করে কোচকে।”

সিনেমায় আমির একজন বাস্কেটবল কোচ, যাঁকে ড্রিংক ড্রাইভের কারণে শাস্তি হিসেবে কমিউনিটি সার্ভিস করতে হয়। তাঁকে প্রশিক্ষণ দিতে হয় নিউরোডাইভার্জেন্ট প্রাপ্তবয়স্কদের।এই গল্প বেছে নেওয়ার কারণ? আমির বলেন, “গল্পটা আমাকে খুশি করেছিল। আমার ভেতরে কিছু নরম করেছিল। নিউরোডাইভার্জেন্স নিয়ে আমার ভাবনাটা বদলে গিয়েছিল। এটাই টেনেছিল আমাকে।”

‘লাল সিং চাড্ডা’ ঠিকমতো চলেনি। অনেকে বলেছিল, এবার ফিরে এসো অ্যাকশন ফিল্মে। সেগুলো তো এখন দারুণ চলছে। আমির হাসতে হাসতে বলেন, “কিন্তু আমি বাস্তববাদী না। এই স্ক্রিপ্টটা এমনভাবে আমাকে ঘিরে ধরেছিল, আর কিছু করার কথা ভাবতেই পারিনি।”

সিনেমাটা হাসায়। কিন্তু সে হাসির মধ্যেই লুকিয়ে থাকে একটা মায়া, একটা স্পর্শ। “আমি চাই, দর্শক হাসুন। তারপর ছবির কোনও এক জায়গায় মনে হোক আরে! এটা তো আমাকে কোথাও ছুঁয়ে গেল,” বলেন আমির।এই সিনেমার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা সমাজে সবার জন্য জায়গা হোক, একসঙ্গে থাকা শেখা হোক শৈশব থেকেই।

আমির বলেন, “খুব ছোটবেলা থেকেই নিউরোডাইভার্জেন্ট শিশুদের আলাদা করে দেওয়া হয়। ওরা বিশেষ স্কুলে যায়, ‘মেইনস্ট্রিম’ থেকে কেমন যেন ছিটকে পড়ে। এতে ওদের ক্ষতি যেমন হয়, তেমনি আমাদেরও।”

তার কথা, “নিউরোটিপিক্যাল শিশুরা শেখে না সহানুভূতি, মজা ভাগ করে নেওয়া, ভিন্নতা মেনে চলা। আর নিউরোডাইভার্জেন্ট শিশুরা পায় না বন্ধুত্ব, সুযোগ কিংবা স্বাভাবিক জীবন। পরিবর্তনটা শুরু হোক স্কুল থেকেই।”

এই সিনেমার জন্য ১০ জন নিউরোডাইভার্জেন্ট শিল্পীকে কাস্ট করা হয়েছে, যাঁদের ৯ জন প্রথমবার ক্যামেরার সামনে এসেছেন।“অডিশন, রিহার্সাল, সবই করেছি নিয়মমাফিক। কিন্তু ওদের যে প্রাণশক্তি, উচ্ছ্বাস, নিঃস্বার্থ মনোভাব—সেটা আমাদের সবাইকে ছুঁয়ে গিয়েছে,” বলেন আমির।

তিনি আরও জানান, “কেউ দেরি করেনি, বাড়তি সুবিধা নেয়নি। বরং ওদের পেশাদারিত্ব আমাদের সবাইকে আরও ভালো করে তুলেছে। গোপি নামের একজন অভিনেতা তো হিন্দি-ই জানতেন না, কেরালার ছেলে। তবুও কী অসাধারণভাবে অভিনয় করল!”

গুলশন নামের কোচের চরিত্রে আমির নিজেই জানালেন, তিনি আসল জীবনে যা নন, এই চরিত্রটি তাই-ই।“ও অসভ্য, আত্মকেন্দ্রিক, অদ্ভুতরকম রূঢ়। আমি তো শিখেই বড় হয়েছি, কিভাবে ভদ্র হতে হয়। তাই চরিত্রটা করতে গিয়ে এমন অনেক কিছু বলেছি, যা বাস্তবে বলতেই পারতাম না,” বলেন তিনি, হেসে।

‘তারে জমিন পার’, ‘পিপলি লাইভ’ বা ‘দঙ্গল’ যেমন ছবি করেছেন, তাতে অনেকেই মনে করেন, আমির শুধু ‘বার্তাবাহী সিনেমা’ করেন।কিন্তু আমির হেসে বলেন, “দিল্লি বেলি দেখেছেন তো? সেখানে তো কোনও বার্তাই নেই! আমি সবরকম গল্প পছন্দ করি। কিন্তু যখন গল্পটা একসাথে শক্তিশালী ও সামাজিকভাবে প্রাসঙ্গিক হয় তখন সেটা আমাকে খুব টানে।”

এখনও পর্যন্ত একটা ঘরানার ছবি করেননি আমির হরর।“আমি খুব ভয় পাই। কখনও শেষ করেই উঠতে পারি না,” বলেন তিনি মজা করে।

পরিচালক আরএস প্রসন্ন সম্পর্কে তিনি বলেন, “ও খুব সংবেদনশীল, ধৈর্যশীল। কোনও তাড়াহুড়ো করে সিনেমা করেন না। ওর ধৈর্যটা দারুণ। ও নতুন শিল্পীদেরও অসাধারণভাবে পরিচালনা করেছে।”

জিজ্ঞেস করা হয়, সিনেমা না করলে কী করতেন? আমির বলেন, “হয়তো খেলাধুলার কোচ হতাম, অথবা শিক্ষক। অনেকে বলে আমি ব্যাখ্যা করতে পারি ভালোভাবে। কিন্তু সত্যি কথা বলতে আমি নিজেকে গল্প ছাড়া আর কোথাও ভাবতেই পারি না। গল্পই আমার ঠিকানা।”

‘সিতারে জমিন পার’ যেন সেই সিনেমাগুলোর একটি, যেগুলো আমাদের আবার মনে করিয়ে দেয় আমরা কেন আমির খানকে ভালোবাসি। তিনি শুধু একজন তারকা নন, একজন গল্পকার।

সাক্ষাৎকারের শেষে, যেভাবে শুরু করেছিলেন, ঠিক সেভাবেই আবেগঘন কণ্ঠে বলেন, “আমি সিনেমার জাদুতে বিশ্বাস করি। আর আমার দর্শকদেরও বিশ্বাস করি।”

বহু বছর পরেও, তিনি এখনও চান আমরা কিছু অনুভব করি। সত্যি বলতে, এতটুকুই তো যথেষ্ট।

এফপি/টিএ

Share this news on:

সর্বশেষ

img
দূষিত শহরের তালিকায় শীর্ষে দুবাই, ঢাকা ২৩তম Jun 16, 2025
img
এরদোয়ানের সঙ্গে ছবি নিয়ে বিতর্কের বিষয়ে যা জানালেন আমির খান Jun 16, 2025
img
সিলেটে দুই উপদেষ্টার গাড়িবহর আটকে বিক্ষোভ করায় ১৫৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা Jun 16, 2025
img
চলতি বছর থেকেই চালু হতে পারে রূপপুরের প্রথম ইউনিট Jun 16, 2025
img
ঢাকায় পৌঁছেছেন জাতিসংঘের গুমবিষয়ক প্রতিনিধি দল Jun 16, 2025
img
বিএনপি দুর্বল নয়, এই দল পুলিশের ভোটে সরকার গঠন করতে চায় না: জি কে গউছ Jun 16, 2025
img
মোস্তফা মোহসীন মন্টুকে নিয়ে এনসিপির শোকবার্তা Jun 16, 2025
img
ইসরায়েলের দিকে ছুটে যাচ্ছে ইরানের মিসাইল Jun 16, 2025
img
বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে ইরানের ফোর্দো পরমাণু কেন্দ্রে Jun 16, 2025
img
‘দখলকৃত অঞ্চল ছাড়ো, এগুলো বাসযোগ্য থাকবে না’ Jun 16, 2025
img
ইরানে ইসরায়েলি হামলায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ২২৪ Jun 16, 2025
img
পিএসজির কাছে ৪-০ গোলে বিধ্বস্ত অ্যাতলেটিকো Jun 16, 2025
img
আরও বেদনাদায়ক জবাব অপেক্ষা করছে : ইরানের প্রেসিডেন্ট Jun 16, 2025
img
নেতানিয়াহুর বাড়ি লক্ষ্য করে ৫০ টি ক্ষেপণাস্ত্র চালাল ইরান Jun 16, 2025
img
ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধবিরতির আলোচনায় অস্বীকৃতি জানাল ইরান Jun 16, 2025
img
গোয়েন্দা প্রধানের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করল ইরান Jun 16, 2025
img
‘নিজেদের ছাড়া কাউকে ভরসা করা যাবে না’ Jun 16, 2025
img
‘সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বহুদলীয় গণতন্ত্রের মৌলিক উপাদান’ Jun 16, 2025
img
সিনেমা না করেও ইনস্টাগ্রামে সক্রিয় থেকেই তারকাখ্যাতি Jun 16, 2025
img
‘পার্বত্য অঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কোনোভাবেই বিনষ্ট করা যাবে না’ Jun 16, 2025