‘রাতের ভোট নিয়ন্ত্রণ করেছিল এনএসআই-ডিজিএফআই'


প্রহসনের নির্বাচন ও রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন আদালতে। তিনি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কৌশল নিয়ে বিস্তারিত বলেছেন।

মঙ্গলবার (১ জুলাই) ঢাকার অতিরিক্ত মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জিয়াদুর রহমান তার জবানবন্দি রেকর্ড করেন। 

নূরুল হুদা আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে অনিয়মের বিষয়ে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ, দলের নেতা-কর্মী, নির্বাচন প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকা কর্মকর্তা-কর্মচারী, পুলিশ প্রশাসন ও গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাদের ভূমিকার কথা উল্লেখ করেছেন।

জবানবন্দিতে সাবেক সিইসি বলেন, ‘আমি মনে করি, তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল কেন্দ্রীয়ভাবে পরিকল্পনা করে প্রশাসন ও পুলিশের কিছু অসৎ কর্মকর্তার যোগসাজশে ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অনিয়ম ও কারচুপি করে দিনের ভোট রাতে গ্রহণ করেছে এবং অস্বাভাবিকভাবে কোনো কোনো নির্বাচনী এলাকায় শতভাগ ভোটগ্রহণ দেখানো হয়েছে, যা নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।’

তৎকালীন সরকারি দলের সরাসরি হস্তক্ষেপেই অনিয়মগুলো সংঘটিত হয়েছে উল্লেখ করে নূরুল হুদা বলেন, ‘কিছু কিছু অতিউৎসাহী সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী নির্বাচনী অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন বলে আমি মনে করি।’

সাবেক সিইসি ২০১৮ সালের ভোটের অস্বাভাবিক ফলাফলের তথ্যও উল্লেখ করেছেন জবানবন্দিতে। তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের পর আমি রেজাল্টশিট দেখে জানতে পারি যে অনেক কেন্দ্রে ৯০ থেকে ১০০ শতাংশ ভোট পড়ে, যা আমার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। আরো শুনেছি যে অনেক কেন্দ্রে রাতে ব্যালট বাক্সে ব্যালট পেপার ভর্তি করা হয়। রাতেই ভোট দেওয়া হয়ে যায়।’
‘ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের প্রভাবে তাদের কর্মীবাহিনী, দায়িত্বে থাকা পুলিশ, রিটার্নিং কর্মকর্তা, সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় এই কাণ্ড ঘটেছে বলে আমি মনে করি। তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ এ ঘটনার জন্য সম্পূর্ণ দায়ী।

আমি বিশ্বাস করি, আমি বা আমার কমিশনের লোকদের অন্ধকারে রেখে এই অরাজক পরিস্থিতি ও ভোটের অনিয়ম করা হয়েছিল।’
প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর (ডিজিএফআই) ও জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা (এনএসআই) সংস্থার তৎকালীন কর্মকর্তাদের ভূমিকার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন নূরুল হুদা। জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ‘তৎকালীন গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআই এবং ডিজিএফআইয়ের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে পুরো নির্বাচনব্যবস্থাটা নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছিল বলে আমি পরে বুঝতে পারি। নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নে আমি বিশ্বাস করি যে, নির্বাচনে কারচুপি ও অনিয়ম হয়েছে। দিনের ভোট রাতে হয়েছে। অস্বাভাবিকভাবে কোনো কোনো নির্বাচনী এলাকায় ভোটগ্রহণ হয়েছে, যা নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।’

এ ছাড়া দিনের ভোট রাতে করার ক্ষেত্রে পুলিশের অনেক সদস্য জড়িত ছিলেন বলে জবানবন্দিতে বলেন নূরুল হুদা। তিনি বলেন, ‘তৎকালীন সময়ে কর্মরত পুলিশ বাহিনীর সদস্যরাও আমাকে কোনো প্রকার সহযোগিতা করে নাই। তারা আমাকে প্রকৃত ঘটনা জানায় নাই। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা আগের দিন রাতে ব্যালট পেপার ভর্তি করে দেয় বলে শুনেছি। নির্বাচনের পূর্বে পুলিশ গণহারে বিএনপির নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করেছিল বলে আমি অভিযোগ পেয়েছিলাম। এ বিষয়ে আমি পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলি। তারা জানান, ওই সব লোকের বিরুদ্ধে আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে। এ জন্য আমি কিছুই করতে পারিনি।’

নূরুল হুদা জবানবন্দিতে বলেন, ‘আমি বা আমার কমিশনের লোকদের অন্ধকারে রেখে এই অরাজক পরিস্থিতি ও ভোটের অনিয়ম করা হয়েছিল। এ বিষয়ে আমরা যথেষ্ট বিব্রত ছিলাম। যেহেতু গেজেট প্রকাশের পর আমাদের নির্বাচন বাতিলের ক্ষমতা থাকে না, তাই আমি নির্বাচন বাতিল করতে পারি নাই।’

নূরুল হুদা বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন রিটার্নিং কর্মকর্তা, সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তাদের মাধ্যমে নির্বাচন পরিচালনা করে। কিন্তু ওই সব কর্মকর্তা তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এবং সম্পূর্ণরূপে নির্বাচন কমিশনকে অন্ধকারে রেখে ২০১৮ সালের নির্বাচনে ভোট জালিয়াতির সুযোগ সৃষ্টি করেছেন বলে আমি মনে করি।’

এর আগে ২২ জুন উত্তরার নিজ বাসভবনে একদল জনতার হামলার শিকার হন কে এম নূরুল হুদা। পরে তাকে পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়। পরদিন আদালত তাকে ৪ দিনের রিমান্ডে পাঠান। এই মামলায় গত সোমবার নূরুল হুদার ১০ দিনের রিমান্ড চেয়েছিল পুলিশ।


ইউটি/এসএন

Share this news on:

সর্বশেষ

img
৪-৫ জন উপদেষ্টা একটি বিশেষ দলের পক্ষে কাজ করছে: ডা. তাহের Oct 14, 2025
img
রুক্মিণীর নতুন ছবি ‘হাঁটি হাঁটি পা পা’-এ চিরঞ্জিতের আবেগঘন প্রশংসা Oct 14, 2025
img
অভিযুক্ত সেনা কর্মকর্তাদের ‘সেনা আইনে’ বিচার দাবি এক্স-ফোর্সেস অ্যাসোসিয়েশন Oct 14, 2025
img
১৯ অক্টোবরের মধ্যে এনসিপি প্রতীক না নিলে ইসি নিজের মতো সিদ্ধান্ত নেবে Oct 14, 2025
img
ইতালির প্রধানমন্ত্রীকে ‘সুন্দরী’ বললেন ট্রাম্প Oct 14, 2025
img
ক্ষমতা ছাড়বেন মাদুরো : মারিয়া কোরিনা মাচাদো Oct 14, 2025
img
২০ বছর পর বাংলাদেশ-পাকিস্তান যৌথ অর্থনৈতিক কমিশনের বৈঠক Oct 14, 2025
নিশ্বাস ধরে ‘পারফেক্ট শট’ দিলেন সামিরা খান মাহি! Oct 14, 2025
img
শেখ হাসিনাকে ফেরাতে রেড নোটিশ জারির পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে: দুদক চেয়ারম্যান Oct 14, 2025
নেটপাড়ায় শিরোনামে তামান্না ভাটিয়া, বিতর্কে অন্নু Oct 14, 2025
'মার্চ টু সচিবালয়' যা বলছেন শিক্ষক-কর্মচারীরা Oct 14, 2025
কেমন সাড়া পাচ্ছেন রাবিতে ছাত্রশিবিরের প্যানেল? জানালেন ভিপি প্রার্থী Oct 14, 2025
img
সরকার ভোজ্যতেলের দাম বাড়ায়নি : বাণিজ্য উপদেষ্টা Oct 14, 2025
img
টিভিতে দেখাবে না বাংলাদেশ-হংকং চায়না ম্যাচ, দেখা যাবে অনলাইনে Oct 14, 2025
img
ট্রাম্প শান্তির দূত, ফের নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত করব: শেহবাজ শরিফ Oct 14, 2025
img
বিকেলে জাপানের মুখোমুখি হচ্ছে ব্রাজিল Oct 14, 2025
img
তেহরানের সাথে পারমাণবিক চুক্তি করতে প্রস্তুত ওয়াশিংটন Oct 14, 2025
img
মিরপুরে ২ কারখানায় আগুন, নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের ৬ ইউনিট Oct 14, 2025
img
শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে তৃতীয় দিনের যুক্তিতর্ক চলছে Oct 14, 2025
img
কোনো কিছুই ড. ইউনূসের নিয়ন্ত্রণে নেই : কর্নেল অলি Oct 14, 2025