বিবিসির প্রতিবেদন নিয়ে জয়ের তীব্র সমালোচনা

বিবিসির সম্প্রতি প্রকাশিত ‘Custom Investigation’ প্রতিবেদনকে "অনৈতিক সাংবাদিকতার একটি নির্লজ্জ উদাহরণ" বলে আখ্যা দিয়েছেন বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে এবং তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়।

বুধবার (৯ জুলাই) রাত ৯টা ৪৪ মিনিটে ফেসবুকে দেওয়া এক স্ট্যাটাসে তিনি অভিযোগ করেন, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে সংঘটিত মর্মান্তিক ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে বিবিসি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তথ্য বিকৃতি করেছে এবং সাংবাদিকতার ন্যূনতম নীতিমালা অনুসরণ করেনি।

জয়ের ভাষ্য অনুযায়ী, প্রতিবেদনটিতে অভিযুক্তদের থেকে কোনও বক্তব্য গ্রহণ করা হয়নি, এমনকি তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টাও করা হয়েছে - এমন ইঙ্গিতও মেলেনি। পুরো প্রতিবেদনটি কয়েক সেকেন্ডের খণ্ডিত অডিও, কথিত একটি ফরেনসিক বিশ্লেষণ এবং সরকার-ঘনিষ্ঠ কয়েকজন ব্যক্তির বক্তব্যের ওপর দাঁড়িয়ে তৈরি করা হয়েছে। অথচ এটিকে "বিস্তৃত তদন্ত" হিসেবে উপস্থাপন করেছে বিবিসি।

ফেসবুক পোস্টে তিনি বলেন, প্রতিবেদনটি দুটি অংশে বিভক্ত। প্রথম অংশে দাবি করা হয়েছে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট যাত্রাবাড়ীতে পুলিশের গুলিতে কমপক্ষে ৫২ জন নিহত হন। কিন্তু বিবিসি এখানে ঘটনাটির প্রেক্ষাপট উপেক্ষা করেছে। সজীব ওয়াজেদের দাবি, সেদিন পুলিশ চরম সংকটে পড়েছিল, চারদিক থেকে ঘেরাও হয়ে পড়া, প্রাণনাশের আশঙ্কা, এবং সেনাবাহিনীর আকস্মিক পিছু হটার ফলে তারা একরকম বাধ্য হয়েই গুলি চালায়। বিবিসির প্রতিবেদনে এসব তথ্যকে গুরুত্বহীন করে দেখানো হয়েছে।

বিবিসির সঙ্গে কথা বলা দুই পুলিশ সদস্য স্পষ্টভাবে বলেছেন যে তারা চারদিক থেকে ঘেরাও হয়ে পড়েছিলেন এবং আসন্ন মৃত্যুর মুখোমুখি ছিলেন। নিজেদের জীবন বাঁচাতে গুলি চালানো ছাড়া তাদের সামনে আর কোনো বিকল্প ছিল না। এমন চরম পরিস্থিতিতে কেউ আদেশ জারি করার অবস্থায় ছিলেন না। বাস্তবে, ওই মুহূর্তে দেশে কার্যত কোনও কার্যকর সরকারও ছিল না।

বিবিসি সেনা সদস্যদের সঙ্গে কথা বলতে ব্যর্থ হয়েছে, ফলে সেনাবাহিনীর হঠাৎ সরে যাওয়ার ঘটনা অমীমাংসিতই থেকে গেছে। তবুও, বিবিসি খুব দ্রুত সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেছে যে পুলিশ “নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে” - যা প্রমাণের জন্য তারা বিক্ষোভকারীদের বাছাই করা বক্তব্য এবং কিছু মোবাইল ও ড্রোন ফুটেজের ওপর নির্ভর করেছে।

বাহ্যিকভাবে নিরপেক্ষ দেখালেও, বিবিসির তথাকথিত “তদন্ত” কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পুরোপুরি গোপন করতে পারেনি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে "গুলি চালানো শুরু হয় দুপুর ২:৪৩ মিনিটে", যা স্পষ্ট করে ইঙ্গিত দেয় - শেখ হাসিনার গণভবন ত্যাগ করার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর সহিংসতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়।

ওই সময়ে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন পুলিশ স্টেশনে বর্বর হামলা শুরু হয়। অসহায় পুলিশ সদস্যরা নিজেদের জীবন রক্ষায় লড়াই করছিলেন। যাত্রাবাড়ীতেও একই দৃশ্য দেখা গিয়েছিল। এমনকি ওই দিনের আগেও পুলিশ সদস্যদের নির্মমভাবে হত্যা করে জনসমক্ষে প্রদর্শন করা হয়েছিল। অথচ বিবিসি এসব তথ্য ইচ্ছাকৃতভাবে উপেক্ষা করে বিক্ষোভকারীদের "নির্দোষ" হিসেবে উপস্থাপন করেছে।

হাজার হাজার হিংস্র বিক্ষোভকারী যাত্রাবাড়ী থানায় হামলা চালায়। সেনাবাহিনী সেখানে প্রাথমিকভাবে উপস্থিত থাকলেও, রহস্যজনক কারণে তারা হঠাৎ পিছু হটে। বিক্ষোভকারীরা তখন থানায় ঢুকে পুলিশের ওপর অগ্নিসংযোগ করে। এসব ভয়াবহ ঘটনার বহু ভিডিও ক্লিপ অনলাইনে ছড়িয়ে পড়ে, তবুও বিবিসি শুধুমাত্র কিছু মোবাইল ও ড্রোন ভিডিও ব্যবহার করেছে।

বিবিসি উল্লেখ করেছে কে মোবাইল ভিডিও করেছে, কিন্তু ড্রোনটি কে পরিচালনা করেছিল বা কেন তারা আগেভাগেই কৌশলগতভাবে অবস্থান নিয়েছিল - এই প্রশ্নগুলোর কোনও উত্তর মেলেনি। বিবিসি এড়িয়ে গেছে নিহতদের ময়নাতদন্ত না হওয়ার প্রসঙ্গেও।

বিবিসি এইরকম হতাশাজনক পরিস্থিতিতে গুলি চালানো ছাড়া পুলিশের কাছে কোনও কার্যকর বিকল্প ছিল কিনা তা উল্লেখ করেনি। প্রতিবেদনে "পুলিশের গুলিতে" নিহতদের সুনির্দিষ্ট সংখ্যা দাবি করা হয়েছে, কিন্তু ১১ মাস ধরে তদন্তের পরও বিবিসি ঠিক কতজন পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছে তা নিশ্চিত করতে পারেনি। অস্পষ্টভাবে বলেছে, "কমপক্ষে ছয়জন পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন।" যদিও পুলিশ সদস্য নিহতের সংখ্যা নির্ধারণ করা সহজ হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু তা স্পষ্ট করা হয়নি।

এছাড়া, ঘটনার পর ইউনূস সরকারের পক্ষ থেকে যে ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হয়েছিল, সেটিও বিবিসির রিপোর্টে উল্লিখিত হয়নি।

প্রতিবেদনের দ্বিতীয় অংশে শেখ হাসিনার একটি কথিত ফোনালাপের অডিও ক্লিপ দেখানো হয়েছে। এটি মাত্র কয়েক সেকেন্ডের এবং এতে প্রেক্ষাপটের সম্পূর্ণ অভাব রয়েছে - তিনি কেন, কাকে এবং কোন পরিস্থিতিতে এই কথাগুলো বলেছেন, সেটি বলা হয়নি। এমনকি তিনি আদৌ বলেছিলেন কি না, তাও যাচাই করা হয়নি।

সাংবাদিকতায় প্রেক্ষাপট উপস্থাপন করা মৌলিক নিয়ম, কিন্তু বিবিসি তা উপেক্ষা করেছে। আন্তর্জাতিক একটি গণমাধ্যম হিসেবে বিবিসি চাইলে বিদেশে অবস্থানরত আগের সরকারের ঊর্ধ্বতন কারও বক্তব্য নিতে পারত, কিন্তু তারা কেবল অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তথ্যকেই প্রচারযোগ্য বলে মনে করেছে।

প্রতিবেদনে শেখ হাসিনার ভাষণের কিছু দৃশ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, অথচ সহিংস হামলার প্রকৃত প্রেক্ষাপট এড়িয়ে গিয়ে সেগুলোকে পুলিশের "বর্বরতার" অংশ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। একই ধরণের পক্ষপাত ইতিপূর্বে একটি তথাকথিত জাতিসংঘের তদন্তকারী দল গ্রহণ করেছিল। সরকার প্রদত্ত তথ্যের উপর নির্ভর করে তারা বলেছিল “সম্ভবত ১,৪০০ জন নিহত হয়েছে”, যদিও বর্তমান সরকার তার তালিকায় অনেক কম সংখ্যা দেখিয়েছে।

বিবিসিও এবার একই পন্থা নিয়েছে - তথাকথিত “তদন্ত” করে কেবল সরকার-সরবরাহকৃত বর্ণনা প্রচার করে সরকারি প্রচারণাকে জোরদার করেছে।

বিবিসির প্রতিবেদনে শেখ হাসিনার কথিত ফোনালাপের তারিখ - ১৮ জুলাই - উল্লেখ করা হয়েছে, যা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সূত্র থেকে নেওয়া। তাদের দাবি অনুযায়ী, শেখ হাসিনা ১৮ জুলাই গণভবন থেকে ফোনটি করেছিলেন।

ধরেও নেওয়া যায় বিবিসির দাবি সত্যি - তাহলে সত্যতা যাচাইয়ের দায় কি কেবল ফরেনসিক পরীক্ষার মাধ্যমে গলার মিল খুঁজে পাওয়া? ফরেনসিক পরীক্ষাটিও নিজে না করে আউটসোর্স করেছে অন্য একটি সংস্থাকে দিয়ে।

যদি ১৮ জুলাইয়ের বাস্তব পরিস্থিতি বিবিসি খতিয়ে দেখত, তাহলে তারা পেত- ১৭ জুলাই: চট্টগ্রামে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের ১৫ জন সদস্য নির্মমভাবে ছাদ থেকে ফেলে হত্যা করা হয়। ১৬ জুলাই থেকে: পুলিশ স্থাপনাগুলিতে ধারাবাহিক আক্রমণ, গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ভবনে হামলা। ১৮ জুলাই: ঢাকার রামপুরায় একটি টিভি চ্যানেল পুড়িয়ে দেওয়া হয়, পুলিশ আটকে পড়ে। ফায়ার সার্ভিস বাধা পায়, তাদের গাড়ি ভাঙচুর হয়। একই ভাবে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিরাপত্তা বাহিনী অবরুদ্ধ হয়, পরে হেলিকপ্টারে উদ্ধার করতে হয়। ঢাকায় ব্যাপক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে, পাবলিক বাস এবং পুলিশ বাক্স ভাঙচুর করা হয়। মহাখালীতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরে আগুন, অগ্নিনির্বাপকদের গাড়ি এবং একটি অ্যাম্বুলেন্স ভাঙচুর করায় এবং কর্মকর্তারা আহত হন।

এই সহিংসতাগুলোর কথা বিবিসি ইচ্ছাকৃতভাবে এড়িয়ে গেছে। অথচ তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম নিজেই সম্প্রতি বলেছেন, ১৮ জুলাই ছিল এক মাসেরও বেশি সময় ধরে পরিকল্পিত এক অভিযানের চূড়ান্ত দিন।
লন্ডনে যদি বিবিসির নিজস্ব সদর দপ্তর অবরুদ্ধ হতো, পুলিশ সেখানে আটকে পড়তো, তাদের জীবন হুমকির মুখে পড়তো - তাহলে কি প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার আত্মরক্ষার নির্দেশ দিতেন না? তখন কি বিবিসির তদন্ত দল এমনই এক পক্ষপাতদুষ্ট প্রতিবেদন প্রকাশ করতো?

প্রসঙ্গত, বিবিসিতে বুধবার (৯ জুলাই) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, ৫ আগস্ট যাত্রাবাড়ীতে পুলিশের গুলিতে অন্তত ৫২ জন নিহত হন এবং এই ঘটনায় শেখ হাসিনার সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ হিসেবে একটি অডিও ক্লিপ প্রকাশ করা হয়।

এসএন 

Share this news on:

সর্বশেষ

img
জুলাই সনদে ইতিহাস বিকৃতি ও পুনর্লিখনের অভিযোগ Oct 16, 2025
img
জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচারের আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার Oct 16, 2025
img
ভোমরা স্থলবন্দরকে ‘কাস্টমস হাউজ’ ঘোষণা Oct 16, 2025
img
সবাইকে জুলাই সনদ সইয়ের ঐতিহাসিক মুহূর্তের অংশ হওয়ার আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার Oct 16, 2025
img
আগামী বছরের শুরুতে ব্যাংকের সুদহার বড় পরিসরে কমা উচিত : বাণিজ্য উপদেষ্টা Oct 16, 2025
img
চট্টগ্রাম ইপিজেডে ৬ ঘণ্টা ধরে জ্বলছে কারখানা, নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে ২৩ ইউনিট Oct 16, 2025
img
ঘুষের টাকাসহ গ্রেপ্তার কাস্টমস কর্মকর্তা শামীমা বরখাস্ত Oct 16, 2025
img
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে আরব আমিরাত, নিশ্চিত হলো ২০ দল Oct 16, 2025
img
দলকে বিশ্বকাপে না তুলতে পারলে দেশ ছাড়ার কথা জানালেন ইতালি কোচ Oct 16, 2025
img
প্রয়োজনে বিদেশ যাবেন না, তাও স্বামীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবেন না শিল্পা Oct 16, 2025
img
বিএনপি জুলাই সনদে সই করবে কি না, এ বিষয়ে আরেকটু অপেক্ষা করতে হবে: মির্জা ফখরুল Oct 16, 2025
img
জানা গেল কবে হতে পারে ২০২৬ সালের ঈদুল ফিতর Oct 16, 2025
img
প্রাথমিক শিক্ষকদের দাবি নিয়ে মন্ত্রণালয়ে বৈঠক, আন্দোলন স্থগিত Oct 16, 2025
img
ভারতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে লুৎফে সিদ্দিকীর সাক্ষাৎ Oct 16, 2025
img
বাংলাদেশকে হেসেখেলে হারিয়ে সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়া Oct 16, 2025
img
আমাদের ব্যাটিং দূর্বলতা একদম এক্সপোজ হয়ে গেছে : লিপু Oct 16, 2025
img
নিহত ৩ বাংলাদেশির মরদেহ হস্তান্তর করল ভারত Oct 16, 2025
img
মাইলস্টোনে পাসের হার ৯৯.৮৩ শতাংশ, ফল উৎসর্গ বিমান দুর্ঘটনায় আহত-নিহতদের Oct 16, 2025
img
রাকসুর ভোট গণনা শুরু Oct 16, 2025
img
দেশের মানুষ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ভোট চায় : মেজর হাফিজ Oct 16, 2025