গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তী সরকারকে রাজনৈতিক অনৈক্যের জন্য দায়ী করেছেন আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি পার্টি) চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু।
তিনি বলেছেন, গত ৫ আগস্টের পর আমাদের মধ্যে জাতীয় ঐক্য হওয়া দরকার ছিল। কারণ, প্রত্যেকটি বিরোধী রাজনৈতিক দলই আমরা বিপদে ছিলাম। শেখ হাসিনার পতনের পরে আমরা দুই ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছি। কেউ এটাকে সুযোগ হিসেবে নিচ্ছেন, আবার কেউ কেউ মনে করছেন যে আমাদের মধ্যে অনৈক্য বিভেদ তৈরি হয়েছে।
বুধবার (২৩ জুলাই) প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর বৈঠকে এবি পার্টির পক্ষ থেকে এসব কথা বলেন মজিবুর রহমান মঞ্জু।
বৈঠকে তিনি বলেন, আপনি (প্রধান উপদেষ্টা) যদি আমাদের সংস্কার ভালোমতো করতে না পারেন, একটি ভালো নির্বাচন যদি দিতে না পারেন, তাহলে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিয়ে চলে যান।
বৈঠক শেষে মঞ্জু বলেন, আজকের বৈঠকে প্রথমে প্রধান উপদেষ্টা আমাদের উদ্দেশ্যে একটি সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিয়েছেন। সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে উনার কাছে মনে হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনৈক্যের কারণে ফ্যাসিবাদ নানা ধরনের সুযোগ নিচ্ছে। উনি (প্রধান উপদেষ্টা) কিছুটা উদ্বিগ্ন, চিন্তিত। সেই চিন্তার জায়গা থেকে তিনি আজকে আমাদের এখানে ডেকেছেন। বিশেষ করে গোপালগঞ্জের ঘটনা এবং মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসে বিমান বিধ্বস্তে হতাহতের ঘটনায় মব বা বিশৃঙ্খলা ও ফ্যাসিবাদ সৃষ্ট উদ্ভূত পরিস্থিতিতে।
তিনি বলেন, এবি পার্টির পক্ষ থেকে আজকের বৈঠকে দুটি ভাগে কথা বলেছি। প্রথমত- পর্যবেক্ষণ ও সমালোচনা এবং দ্বিতীয়ত- পরামর্শ। আলোচনার পর্যবেক্ষণ অংশে আমরা বলেছি, গত ৫ আগস্টের পর ঐক্যের বিপরীতে যে রাজনৈতিক অনৈক্য বা বিভেদ তৈরি হয়েছে সেজন্য দায়ী সরকার। সরকার চাইলে শুরুতেই এই অনৈক্য বিভেদ দূর করতে পারতেন।
এবি পার্টির পক্ষ থেকে এমন মন্তব্যে প্রধান উপদেষ্টা কিছুটা সম্মতিও জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এখন থেকে নির্বাচন হওয়ার আগ পর্যন্ত ঘন ঘন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করবেন, বসবেন।
মঞ্জু বলেন, প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছি, আপনি শুধু ঝামেলা হলেই বা বিপদে পড়লে আমাদেরকে ডাকেন। আমাদের অনেক কথা থাকে যে কথাগুলো আমরা এখানে বিশেষ করে আপনাকে বলতে পারি না। কারণ অনেকগুলো দল থাকি আমরা। ২ থেকে ৪ মিনিট করে কথা বলার সুযোগ হয়।
দুটি বিষয়ে ব্যাপক সংশয়ের কথা উল্লেখ করে মঞ্জু বলেন, ১. সংস্কার আসলে ঠিকমতো হবে কিনা? ২. নির্বাচন ঠিকমতো হবে কিনা? এই দুটি বিষয়ে সংশয় সম্পূর্ণ দূর করার আহ্বান জানানো হয়েছে এবি পার্টির পক্ষ থেকে।
আজকের বৈঠকে অংশ নেওয়া অনেক রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ সরকারের কার্যক্রমের সমালোচনা করেছেন বলে উল্লেখ করেন মঞ্জু।
এবি পার্টির চেয়ারম্যান বলেন, এই সরকারকে দুর্বল সরকার বলে মনে হচ্ছে। কারণ, কখনো মনে হয় সরকার একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। কঠিন বলতে আমরা কঠোরতার কথা বলছি না। এই সরকার কোনো ঘটনায় কাউকে বহিষ্কার করেছে বা কোনো উপদেষ্টার ব্যাপারে পদক্ষেপ নিয়েছে। যখনই সচিবালয় বা যমুনা ঘেরাও হয় তখনই শুধুমাত্র সরকার নড়েচড়ে বসে। এই জায়গাটায় আমরা সরকারের ব্যর্থতা বা দুর্বলতা হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, আমরা বলেছি, এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। সরকারের ক্রেডিবিলিটি বা সক্ষমতা অনেক কমে গেছে। উদাহরণ হিসেবে আমরা দুটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেছি, এক গতকাল দুজন উপদেষ্টা মাইলস্টোন স্কুলে ৯ ঘণ্টা আটকা ছিলেন। এটার অর্থ হচ্ছে জনগণের ক্ষোভ উপদেষ্টাদের প্রতি তৈরি হয়েছে। এর আগে আমরা দেখেছি যমুনায় একজন উপদেষ্টাকে বোতল নিক্ষেপ করা হয়েছে। সেজন্য আমরা মনে করছি এসব ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ।
মঞ্জু বলেন, আমাদের ছাত্র আন্দোলনে যারা প্রধান নেতৃত্বে ছিলেন, তারাও ধীরে ধীরে তাদের ক্রেডিবিলিটি হারিয়েছেন।
তিনি সারজিস ও হাসনাতের উদাহরণ দিয়ে বলেন, আমরা আগে দেখতাম তারা কোথাও গেলে সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। এখন আমরা এ ধরনের কোনো সিচুয়েশনে দেখছি না। তাদের সেই গ্রহণযোগ্যতা কমেছে। বিভিন্ন জায়গায় আমরা দেখছি তাদেরকে নিয়ে নানা ধরনের স্লোগান দেওয়া হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, আমরা প্রধান উপদেষ্টাকে আরেকটা কথা বলেছি, আমাদের উপদেষ্টারা যে যে মন্ত্রণালয়ে দায়িত্বে রয়েছেন, উনারা কেউ তাদের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের বিস্তারিত ব্রিফিং করেন না। সব ব্রিফিং করেন প্রেস উইং। আমরা অনুরোধ করেছি এখন থেকে প্রধান উপদেষ্টা প্রেস উইং কোনো মন্ত্রণালয়ের ব্রিফিং না করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় নিজ নিজ ব্রিফ করবেন।
গতকাল রাতে চারটি রাজনৈতিক দল বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠক প্রসঙ্গে মঞ্জু বলেন, আমরা বলেছি এই চারটি রাজনৈতিক দল একে অপরের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক ও উস্কানিমূলক বক্তব্য দিচ্ছে। যদিও এটা গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু তাদের উস্কানিমূলক বক্তব্যের মাধ্যমে এটেনশন ক্রিয়েট হচ্ছে। এটা চলতে থাকলে আমাদের নির্বাচন সুষ্ঠু করায় সংশয় দেখা দিবে।
মঞ্জু বলেন, আমরা প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছি যদি আপনি আমাদের সংস্কারও ভালোমতো করতে না পারেন যদি একটি ভালো নির্বাচনও করতে না পারেন তাহলে আপনি দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিয়ে চলে যান। উনি (প্রধান উপদেষ্টা) আমাদেরকে আশ্বস্ত করেছেন যে এখন থেকে তিনি নিয়মিত আমাদের সঙ্গে বসবেন। আমরা আরেকটা কথা এবি পার্টির পক্ষ থেকে বলেছি যে, জুলাই অভ্যুত্থান উদযাপন যেটা হচ্ছে সেখানে রাজনৈতিক দলগুলোকে কোথাও সম্পৃক্ত করা হয়নি। আমাদের এই বক্তব্য শুনে তিনি বিস্মিত হয়েছেন। বলেছেন, এটাতো হবার কথা না।
মঞ্জু বলেন, আমি প্রধান উপদেষ্টাকে অনুরোধ করেছি আগামী পাঁচ আগস্ট যদি সম্ভব হয় তাহলে সব রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে একটি সমাবেশ বা সভা করেন। সবার কথা কিছুটা হলেও শুনেন। আমরা মাইলস্টোনের বিমান দুর্ঘটনার ব্যাপারেও কথা বলেছি, অনেক আলোচনা হয়েছে। তারা ব্যবস্থা নেবেন বলে আশ্বস্ত করেছেন।
বৈঠকে রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সৈয়দ হাসিবউদ্দিন হোসেন, গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকি, এবি পার্টির মজিবুর রহমান, নাগরিক ঐক্যের শহীদুল্লাহ কায়সার, গণঅধিকার পরিষদের নুরুল হক, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) রেদোয়ান আহমেদ, খেলাফত মজলিসের আহমদ আবদুল কাদের, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাইফুল হক, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল- জেএসডির তানিয়া রব, ১২ দলীয় জোটের শাহাদাত হোসেন সেলিম, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) বজলুর রশীদ ফিরোজ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) রুহিন হোসেন প্রিন্স ও গণফোরামের মিজানুর রহমান অংশ নেন।
এর আগে প্রধান উপদেষ্টা গতকাল রাতে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি ও ইসলামী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বৈঠক করেন।
কেএন/টিএ