অব্যবস্থাপনা ও অনিয়ন্ত্রিত নগরায়নের ফলে রাজধানী ঢাকায় গত চার দশকে ভূ-তাপমাত্রা বেড়েছে ৩ থেকে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। রাজধানীর প্রায় প্রতিটি অঞ্চল এখন তাপদাহের শিকার। শহরের কোথাও এখন তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নামে না। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ-এর এক নতুন গবেষণায় এমন ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে।
আজ রোববার (২৭ জুলাই) রাজধানীর হলিডে ইনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ‘প্রকৃতিবিহীন ঢাকা? প্রাকৃতিক অধিকারভিত্তিক টেকসই নগর ভাবনার পুনর্বিচার’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে সংস্থাটি।
গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত ৪৪ বছরে ঢাকার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার পরিমাণ ৭ গুণ বেড়েছে। একই সময়ে গাছপালা ও সবুজ আচ্ছাদন কমে এসেছে প্রায় অর্ধেকে, এবং শহরের প্রায় ৬০ শতাংশ জলাধার হারিয়ে গেছে। গবেষণাটি ১৯৮০ থেকে শুরু করে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সময়ের স্যাটেলাইট চিত্র ও তাপমাত্রা তথ্য বিশ্লেষণ করে প্রস্তুত করা হয়েছে, যা ঢাকার পরিবেশগত অবক্ষয়ের একটি জোরালো চিত্র তুলে ধরে।
গবেষণা প্রতিবেদনের বিস্তারিত তুলে ধরেন চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ-এর প্রধান নির্বাহী এম. জাকির হোসেন খান। তিনি বলেন, ঢাকাকে রক্ষা করতে হলে এখনই প্রকৃতির অধিকারকে আইনগত স্বীকৃতি দিতে হবে এবং প্রাকৃতিক অধিকারভিত্তিক সুশাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। তার মতে, ঢাকার সংকট মূলত শহর পরিকল্পনায় অব্যবস্থাপনার ফসল এবং এটি শুধুমাত্র শহরের গঠনগত বিপর্যয় নয়, বরং মানুষের মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন হওয়ার একটি বড় উদাহরণ।
সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা বলেন, ঢাকার অধিকাংশ এলাকাই এখন নিয়মিত তাপদাহের শিকার। ভূ-তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নামছে না বললেই চলে। শ্যামপুর, হাজারীবাগ, তেজগাঁও, রামপুরা ও দারুসসালাম এলাকাগুলোর তাপমাত্রা ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে গেছে। এমনকি একসময় অপেক্ষাকৃত শীতল হিসেবে পরিচিত এলাকাগুলোতেও এখন আর ঠান্ডার কোনো ছোঁয়া নেই।
জাকির হোসেন খান বলেন, ঢাকার এই সংকট শুধুই পরিবেশগত পরিবর্তন নয়, এটি একটি পরিবেশগত অবিচারও বটে। কারণ এতে শুধু প্রাকৃতিক ভারসাম্যই নষ্ট হচ্ছে না, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মৌলিক অধিকার এবং নিরাপত্তাও হুমকির মুখে পড়ছে।
গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, ১৯৮০ সালে ঢাকার সবুজ আচ্ছাদনের পরিমাণ ছিল প্রায় ২১.৬ শতাংশ, কিন্তু বর্তমানে তা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১১.৬ শতাংশে। ঢাকা মহানগর এলাকায় (উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন) একজন নাগরিকের জন্য গড় সবুজ জায়গার পরিমাণ এখন মাত্র ৩.৪৪ বর্গমিটার, যেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে প্রয়োজন অন্তত ৯ বর্গমিটার।
বিশেষভাবে কিছু এলাকা যেমন আদাবর, কাফরুল, বংশাল ও ওয়ারী ‘ট্রি-ডেজার্ট’ বা প্রায় গাছবিহীন অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। শুধু গাছপালাই নয়, ঢাকার জলাধারগুলোর অবস্থাও ভয়াবহ।
গবেষণা বলছে, ১৯৮০ সালের তুলনায় আজ ঢাকা শহরের জলাধার ৬০ শতাংশ কমে গেছে। বর্তমানে জলাধার রয়েছে শহরের মাত্র ৪.৮ শতাংশ জায়গাজুড়ে। জনপ্রতি জলাধারের পরিমাণও আশঙ্কাজনকভাবে কমেছে- ঢাকা উত্তর সিটিতে ১.৭৯ বর্গমিটার এবং দক্ষিণ সিটিতে তা মাত্র ০.৯৭ বর্গমিটার। সূত্রাপুর, গেন্ডারিয়া, কাফরুল, মিরপুরের মতো এলাকাগুলো এখন প্রায় জলশূন্য।
ঢাকার ঘনবসতি এবং নির্মাণ বিস্তারের চিত্রটিও ভয়াবহ। শহরের মোট ৫০টি থানার মধ্যে ৩৭টি থানাই ইতোমধ্যে নিরাপদ নির্মাণ সীমা অতিক্রম করেছে। আদাবর, কলাবাগান, চকবাজার, ওয়ারী, রামপুরা ও মিরপুরের মতো এলাকাগুলোর ৮৫ শতাংশের বেশি অংশ এখন কংক্রিটে ঢাকা। কংক্রিটের এ ঘনত্ব তাপমাত্রা বাড়ানোর পেছনে বড় ভূমিকা রাখছে।
চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ বলছে, ঢাকাকে টিকিয়ে রাখতে হলে এখনই ‘প্রাকৃতিক অধিকারভিত্তিক সুশাসন’ (Natural Rights Led Governance - NRLG) চালু করতে হবে। এ কাঠামোর আওতায় প্রকৃতির চারটি মৌলিক অধিকার স্বীকৃতি পাবে: (১) জীবন ও মর্যাদার অধিকার, (২) শোষণ থেকে মুক্তি, (৩) সামাজিক ন্যায়বিচার, এবং (৪) দেশজ জ্ঞানের স্বীকৃতি। গবেষকরা বলেন, প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার এই লড়াই কেবল সবুজায়ন নয় এটি মৌলিক কাঠামোগত সংস্কার, যেখানে রাষ্ট্র ও জনগণকে প্রকৃতির অভিভাবক হিসেবে কাজ করতে হবে।
গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, যদি ঢাকায় প্রতি নাগরিকের জন্য অন্তত ৯ বর্গমিটার গাছপালা এবং ৪.৫ বর্গমিটার জলাধার সংরক্ষণ করা যায়, তবে শহরের গড় তাপমাত্রা প্রায় ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমানো সম্ভব। এর জন্য প্রয়োজন সুস্পষ্ট পরিকল্পনা, রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং নাগরিক অংশগ্রহণ।
এই প্রেক্ষাপটে সংস্থাটি কিছু স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি সুপারিশও করেছে। স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে- প্রকৃতির অধিকার প্রতিষ্ঠা করে আইন প্রণয়ন, পরিবেশবান্ধব জোনিং, জলাধার পুনরুদ্ধার এবং কংক্রিটের উপর অতিরিক্ত কর আরোপ। আর মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনায় রয়েছে প্রকৃতি-ভিত্তিক নগর পরিকল্পনা, গাছপালা রোপণ, সবুজ বিনিয়োগে অগ্রাধিকার এবং তাপ-ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাকে কেন্দ্র করে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এখনই প্রয়োজন সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. রিফ্ফাত মাহমুদ বলেন, ফ্লাইওভারগুলোকে উল্লম্ব বাগানে রূপান্তর, পরিবেশ শিক্ষার মাধ্যমে যুবসম্প্রদায়কে সম্পৃক্ত করা এবং সম্প্রদায়ভিত্তিক তত্ত্বাবধানে যাওয়া- এই পদক্ষেপগুলো ঢাকাকে আরও বাসযোগ্য ও পরিবেশবান্ধব নগরীতে রূপান্তরের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।
পরিশেষে গবেষণা প্রতিবেদনের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বার্তাটি হলো- ঢাকা টিকবে না, যদি প্রকৃতি না টিকে। নগর উন্নয়ন কেবল কংক্রিট বা ফ্লাইওভার নয়; এটি একটি সামগ্রিক জীবনধারা যেখানে প্রকৃতি, মানুষ এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম- সবাই যেন স্বস্তিতে থাকতে পারে। এখন সময় প্রকৃতিকে ফিরিয়ে আনার, ঢাকাকে আবার নিঃশ্বাস নেওয়ার সুযোগ দেওয়ার- তার আগে না ফুরিয়ে যায় সব সম্ভাবনা।
পিএ/ এসএন