ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দিয়ে মুসলিমদের উচ্ছেদ ও বাংলাদেশে বিতাড়ন করছে ভারত

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামে মুসলিমদের উচ্ছেদ ও বাংলাদেশে বিতাড়ন করছে ভারত। গত কয়েক সপ্তাহে হাজারো মুসলিম পরিবারের ঘরবাড়ি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়েছে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ।

মুসলিমদের লক্ষ্য করে চালানো এই দমন অভিযানে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে। সোমবার (২৮ জুলাই) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে বার্তাসংস্থা রয়টার্স।

বার্তাসংস্থাটি বলছে, বাংলাদেশ সীমান্তঘেঁষা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় আসাম রাজ্যের একটি কোণে নীল ত্রিপল দিয়ে তৈরি অস্থায়ী আশ্রয়ে শত শত মুসলিম পুরুষ, নারী ও শিশু বাস করছেন। সম্প্রতি তাদের ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। আসামে আসন্ন রাজ্য নির্বাচনকে ঘিরে এটিই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় উচ্ছেদ অভিযান।

গত কয়েক সপ্তাহে হাজারো পরিবারের ঘরবাড়ি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়েছে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ। কর্তৃপক্ষের দাবি, এসব মানুষ সরকারি জমি দখল করে অবৈধভাবে বসবাস করছিল।

ভারতের ক্ষমতাসীন হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি আসামে আগামী বছর ফের নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। এদিকে ২০২৪ সালের আগস্টে বাংলাদেশে ভারতপন্থি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতন এবং ভারতজুড়ে “বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী” হিসেবে আখ্যায়িত করে বাংলাভাষী মুসলিমদের বিরুদ্ধে জাতীয় পর্যায়ের দমন অভিযান শুরু হয়েছে। মূলত আসামের সাম্প্রতিক এই উচ্ছেদও সেই ধারাবাহিকতার অংশ।আসামের গোলপাড়া জেলায় উচ্ছেদ হওয়া এক বাসিন্দা হচ্ছেন ৫৩ বছর বয়সী আরান আলী।

তিনি বলেন, “সরকার বারবার আমাদের হয়রানি করে। আমরা তো এখানেই জন্মেছি। তবু আমাদের ‘অনুপ্রবেশকারী’ ও ‘বিদেশি’ বলা হয়।”



বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের ৪০৯৭ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্তের মধ্যে আসাম রাজ্য ২৬২ কিলোমিটারজুড়ে বিস্তৃত। বহুদিন ধরেই সেখানে বাংলাদেশি অভিবাসন নিয়ে ভয় ও ক্ষোভ থেকে বিদেশি বিরোধী মনোভাব রয়েছে, বিশেষ করে বাংলা ভাষাভাষী হিন্দু ও মুসলিম উভয়ের বিরুদ্ধেই। স্থানীয়দের ধারণা, এদের উপস্থিতি আসামের সংস্কৃতি ও অর্থনীতিকে বিপন্ন করছে।

তবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দল বিজেপির নেতৃত্বাধীন সরকারের চলমান অভিযান কেবল মুসলিমদের লক্ষ্য করেই চালানো হচ্ছে, যা ইতোমধ্যে বিক্ষোভ ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটিয়েছে। আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা সম্প্রতি বলেছেন, “বাংলাদেশি মুসলিম অনুপ্রবেশকারীরা ভারতের পরিচয়কে হুমকির মুখে ফেলছে।”

সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম এক্স-এ (সাবেক টুইটার) দেওয়া এক বার্তায় তিনি বলেন, “নির্ভয়ে সীমান্ত পেরিয়ে আসা মুসলিম অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধেই প্রতিরোধ গড়ে তুলছি আমরা, কারণ এতে ভয়াবহ জনমিতিক পরিবর্তন ঘটেছে।”

তিনি দাবি করেন, আসামের ৩১ মিলিয়ন জনসংখ্যার ৩০ শতাংশই অভিবাসী মুসলিম (২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী)। তার মতে, “আরও কয়েক বছরের মধ্যে রাজ্যের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর হার ৫০ শতাংশে পৌঁছাবে।”

রয়টার্সের অনুরোধ সত্ত্বেও মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত শর্মা এই বিষয়ে কোনও মন্তব্য করেননি।

বিজেপি বরাবরই ভারতকে হিন্দুদের প্রাকৃতিক আবাসভূমি হিসেবে দেখে এবং দেশটির বৃহৎ মুসলিম জনগোষ্ঠী মোকাবিলায় নানা নীতিমালা গ্রহণ করেছে। ২০১৯ সালে তারা ভারতের নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে প্রতিবেশী দেশ থেকে আসা অমুসলিম অনথিভুক্ত অভিবাসীদের নাগরিকত্ব দেওয়ার পথ খুলে দেয়।

২০২১ সালের মে মাসে ক্ষমতায় আসার পর থেকে হিমন্ত শর্মার সরকার এখন পর্যন্ত প্রায় ৫০ হাজার মানুষকে উচ্ছেদ করেছে। যাদের বেশিরভাগই বাংলা ভাষাভাষী মুসলিম।

সরকারি তথ্য বলছে, মাত্র গত এক মাসেই আসামের পাঁচটি এলাকায় প্রায় ৩ হাজার ৪০০ মুসলিম পরিবারের ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এর আগে ২০১৬-২০২১ মেয়াদে প্রায় ৪ হাজার ৭০০ পরিবার উচ্ছেদের শিকার হয়েছিল।

ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক প্রভীন দন্তি বলেন, “বাংলাভাষী মুসলিমরা আইনগত অবস্থান যাই হোক ভারতের কট্টরপন্থি গোষ্ঠীগুলোর সহজ লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠেছে।”
ভারতের বিরোধী নেতারা অভিযোগ করেছেন, বিজেপি নির্বাচনকে সামনে রেখে ভোটারদের মেরুকরণে এই উচ্ছেদ ও বিতাড়ন নীতি গ্রহণ করেছে। বিরোধী এমপি অখিল গগৈ বলেন, “এই পদক্ষেপগুলো রাজনৈতিকভাবে লাভজনক এবং বিজেপির জন্য উপকারি।”

মূল বিরোধী দল কংগ্রেস ২০১৬ সালের নির্বাচনে হেরে বিজেপির কাছে ক্ষমতা হারিয়েছিল। দলটি জানিয়েছে, তারা ক্ষমতায় ফিরলে গুঁড়িয়ে দেওয়া বাড়িগুলো পুনর্নির্মাণ করবে এবং যারা এসব ধ্বংস করেছে, তাদের কারাগারে পাঠাবে।

আসামে এই উচ্ছেদের মাত্রা বেড়েছে কাশ্মিরে হিন্দু পর্যটকদের ওপর চালানো একটি প্রাণঘাতী হামলার পর। পাকিস্তান-ভিত্তিক সন্ত্রাসীদের ওপর এর দায় চাপানো হয়েছিল। এরপর বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলো হাজার হাজার বাংলাভাষী মুসলিমকে ‘অবৈধ অভিবাসী’ ও নিরাপত্তা হুমকি বলে গ্রেপ্তার করে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, শেখ হাসিনার পতন ও ভারতে পলায়নের পর দিল্লি-ঢাকার মধ্যে সম্পর্ক অবনতির কারণে বাংলাভাষী মুসলিমদের প্রতি ভারতীয় রাজনীতিতে বিরূপ মনোভাব আরও বেড়েছে, যা বিজেপির নির্বাচনী অস্ত্রে পরিণত হয়েছে।

বাংলা ভাষা বাংলাদেশের প্রধান ভাষা এবং ভারতের কিছু অঞ্চলেও এটি ব্যাপকভাবে প্রচলিত। আসামসহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্য শত শত বাংলাভাষী মুসলিমকে বাংলাদেশে ‘পুশব্যাক’ করেছে। আদালতে অনুপ্রবেশকারী হিসেবে ঘোষণার বিরুদ্ধে আপিল চলার সময় তাদের কিছুজনকে ফেরত আনা হয় বলেও জানায় রয়টার্স।

আসাম সরকার বলছে, রাজ্যের ট্রাইব্যুনালগুলো এখন পর্যন্ত প্রায় ৩০ হাজার মানুষকে ‘বিদেশি’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। এদের অনেকে বহু বছর ধরে ভারতেই বসবাস করছে, পরিবার ও জমিজমাও রয়েছে।

অধিকারকর্মীরা বলছেন, এদের মধ্যে অনেকেই ভুলভাবে ‘বিদেশি’ তকমা পেয়েছেন এবং তারা আর্থিকভাবে এতটাই দুর্বল যে আইনি লড়াই চালিয়ে যেতে পারেন না। 

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২০১৬ সালে জানিয়েছিল, দেশটিতে ২ কোটি অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসী রয়েছে।


মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া পরিচালক ইলেইন পিয়ারসন বলেন, “অবৈধ অভিবাসী শনাক্তের নামে ভারত হাজার হাজার দুর্বল মানুষকে ঝুঁকির মুখে ফেলেছে। এর মাধ্যমে মুসলিমদের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক নীতির প্রতিফলন ঘটছে।”

চলতি বছরের মে মাসে ভারত জানিয়েছে, তারা বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর জন্য ২ হাজার ৩৬৯ জনের একটি তালিকা প্রস্তুত করেছে এবং বাংলাদেশকে দ্রুত যাচাই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার আহ্বান জানিয়েছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য রয়টার্সের অনুরোধে সাড়া দেয়নি।

শেখ হাসিনার পতন ও বাংলাদেশে ‘হিন্দুদের ওপর হামলার’ ঘটনার পর থেকে আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত শর্মা সীমান্তে অনুপ্রবেশ রোধের নানা উদাহরণ, ছবি-তথ্যসহ সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ করছেন।

বিশ্লেষক প্রভীন দন্তি বলেন, “আসামের রাজনীতিকে দীর্ঘদিন ধরে চালিত করে আসা জাতিগত জাতীয়তাবাদ বিজেপির ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের সঙ্গে মিলিয়ে গেছে। এখন লক্ষ্য বদলে গেছে- বাংলাভাষী বহিরাগত থেকে বাংলাভাষী মুসলিমদের দিকে।”

সূত্র: রয়টার্স

কেএন/টিকে

Share this news on:

সর্বশেষ

img
ঢাকায় ঝটিকা মিছিলের প্রস্তুতিকালে আ.লীগের ১১ জন গ্রেপ্তার Sep 19, 2025
img
সুপার ফোরে কবে কার বিপক্ষে মাঠে নামবে বাংলাদেশ Sep 19, 2025
img
দুনিথ ওয়েলালাগের বাবা আর নেই Sep 19, 2025
img
আফগানদের হারিয়ে বাংলাদেশকে নিয়েই সুপার ফোরে গেল শ্রীলঙ্কা Sep 19, 2025
img
চবি ভিসি-প্রোভিসির সঙ্গে স্বরাষ্ট্র ও শিক্ষা উপদেষ্টার মতবিনিময় Sep 19, 2025
img
কাশিমপুর থানা আ.লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি গ্রেপ্তার Sep 18, 2025
img
জ্যান ফ্রাইলিঙ্কের রেকর্ড ফিফটিতে জিম্বাবুয়েকে হারাল নামিবিয়া Sep 18, 2025
img
ইউরোপে ‘রোহিঙ্গা সংকট’ তুলে ধরার আশ্বাস দিল প্রতিনিধি দল Sep 18, 2025
img
রাবিতে পোষ্য কোটা পুনর্বহালের প্রতিবাদে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ মিছিল Sep 18, 2025
img
বাংলাদেশ ও চীন হাতে হাত রেখে এগিয়ে যাবে: প্রধান উপদেষ্টা Sep 18, 2025
নাহিদ ইসলামকে জেরা শেষে যা বললেন আসামি পক্ষের আইনজীবী Sep 18, 2025
img
আসিফ মাহমুদের নতুন এপিএস রাহাত Sep 18, 2025
img
মিথ্যা বলেছিলেন টিউলিপ: দ্য টাইমস Sep 18, 2025
img
প্রথম প্রেম মনে করার দিন আজ Sep 18, 2025
img
হিমাচলে বন্যার্তদের তোপের মুখে কঙ্গনা Sep 18, 2025
img
ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে যুক্তরাজ্যের স্বীকৃতির বিরোধিতা করলেন ট্রাম্প Sep 18, 2025
img
নেপালকে ৪ গোলে উড়িয়ে দিল বাংলাদেশ Sep 18, 2025
img
নির্বাচনী দায়িত্বে অবহেলা ও অপরাধের সাজা বাড়ছে Sep 18, 2025
img

শেষ ওভারে নবির ৫ ছক্কা

শ্রীলংকাকে ১৭০ রানের টার্গেট দিল আফগানিস্তান Sep 18, 2025
img
আওয়ামী লীগের মিছিলে নেতৃত্ব দেয়া তেজগাঁও কলেজের শিক্ষক গ্রেপ্তার Sep 18, 2025