বিশ্বাসশূন্যতা রাজনীতির সবচেয়ে বড় ভ্যাকুয়াম : জিল্লুর রহমান

টিভি উপস্থাপক ও সাংবাদিক জিল্লুর রহমান বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের শুরুতে যে নৈতিক ম্যান্ডেট ছিল- ন্যায়বিচার, সংস্কার, আইন শৃঙ্খলা এবং সংলাপ- সেখানে সবচেয়ে বেশি ভাঙন ধরা পড়েছে। দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার অক্ষমতা, নেওয়া সিদ্ধান্ত তড়িৎ বদলে ফেলা, সরকারের ভেতর সরকারের আভাস, আইনশৃঙ্খলাজনিত অস্থিরতা- এসবেই জনবিশ্বাস ক্ষয়ে গেছে। বিশ্বাসশূন্যতা রাজনীতির সবচেয়ে বড় ভ্যাকুয়াম। ভ্যাকুয়ামের নিয়ম হলো- খালি থাকলে কেউ না কেউ সেটা পূরণ করে।

এখানে ডানপন্থীরা তাদের সাংগঠনিক ধারাবাহিকতা দিয়ে জায়গা করে নিয়েছে। আরেকদিকে, শিক্ষার্থী নেতৃত্বাধীন জাগরণের নৈতিক উচ্চতা ক্ষমতার বলয় ঢোকার তারণায় যে দ্রুত নষ্ট হয়েছে, সেটিও মাঠে নতুন প্রতিদ্বন্দ্বীদের স্পেস তৈরি করেছে।

বৃহস্পতিবার (৩১ জুলাই) রাতে নিজের ইউটিউব চ্যানেলে এসব কথা বলেন তিনি।

জিল্লুর রহমান বলেন, ২০২৪-এর আগস্ট পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতির অক্ষরেখা বদলে গেছে। এ কথা এখন আর বিতর্কের বিষয় নয়। কিন্তু সবচেয়ে বেশি যে প্রশ্নটা কানাঘুঁষা, টেলিভিশন টকশো, আড্ডায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, তা হলো- ডানপন্থিরা কি সত্যি উত্থান ঘটিয়েছে? বা বাংলাদেশে কি সত্যি ডানপন্থীদের উত্থান ঘটেছে? না কি আমরা রাজনীতির মাঠে নতুন এক দৃশ্যমানতার রাজনীতি দেখছি? এই সংকেতগুলো পরস্পর বিরোধী বটে, তবে এগুলো একই টাইমলাইনে দাঁড়িয়ে একটা বড় গল্প বলছে। রাষ্ট্র, সমাজ এবং রাজনীতির ভেতরকার শূন্যতাই এই দৃশ্যমানতার জ্বালানি বলা যেতে পারে।

তিনি বলেন, প্রথম যে সূত্রটা সেটা রাজনৈতিক। দীর্ঘ দমন-পীড়নের অবসানের পর জনতার শক্তিধারা যখন হঠাৎ মুক্ত হলো, তখন যারা সংগঠিত ছিল মসজিদ, মাদরাসা, সামাজিক নেটওয়ার্কে এবং স্থানীয় নেতৃত্বে যাদের টেকসই শিখর ছিল, তারাই সবচেয়ে বেশি দ্রুত মাঠে দাঁড়াতে পেরেছে। বাম, লিবারেল ধারার দলগুলো এবং মূলধারার বড় দলগুলোর একদিকে আন্দোলনের ক্লান্তি, অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ পুনর্গঠনের চাপে যখন গতি হারিয়েছে, তখন ইসলামপন্থীরা বা ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো স্বাভাবিকভাবে দৃশ্যমান হয়েছে। এই দৃশ্যমানতাকে অনেকে উত্থান বলে পড়ছেন, কিন্তু তা কি সত্যিকারের সমতা, অর্জনের সমর্থক?

এখানে দ্বিতীয় সূত্রটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ক্ষমতা এবং বৈধতার সম্পর্ক। উত্থান বলতে যদি ভোটে, নীতি নির্ধারণে, রাষ্ট্রযন্ত্রে স্থায়ী প্রভাবকে বোঝাই, তবে এখনো সেই পর্ব শুরু হয়নি। আমরা আছি প্রাক নির্বাচনী দরকষাকষির একটা মৌসুমে। যেখানে যার কণ্ঠ উচ্চ তার দামও আপাতত বেশি। দ্বিতীয় সূত্রটা প্রশাসনিক। অন্তর্বর্তী সরকারের শুরুতে যে নৈতিক ম্যান্ডেট ছিল- ন্যায়বিচার, সংস্কার, আইন শৃঙ্খলা এবং সংলাপ- সেখানে সবচেয়ে বেশি ভাঙন ধরা পড়েছে। দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার অক্ষমতা, নেওয়া সিদ্ধান্ত তড়িৎ বদলে ফেলা, সরকারের ভেতর সরকারের আভাস, আইনশৃঙ্খলাজনিত অস্থিরতা- এসবই জনবিশ্বাস ক্ষয়ে গেছে। বিশ্বাসশূন্যতা রাজনীতির সবচেয়ে বড় ভ্যাকুয়াম। ভ্যাকুয়ামের নিয়ম হলো খালি থাকলে কেউ না কেউ সেটা পূরণ করে। এখানে ডানপন্থিরা তাদের সাংগঠনিক ধারাবাহিকতা দিয়ে জায়গা করে নিয়েছে। আরেকদিকে শিক্ষার্থী নেতৃত্বাধীন জাগরণের নৈতিক উচ্চতা ক্ষমতার বলয় ঢোকার তারণায় যে দ্রুত নষ্ট হয়েছে, সেটিও মাঠে নতুন প্রতিদ্বন্দ্বীদের স্পেস তৈরি করেছে।

তিনি আরো বলেন, তৃতীয় সূত্রটা হচ্ছে সমাজ এবং সাংস্কৃতিক। ধর্মীয় অনুভূতি বাংলাদেশের বৃহত্তম জনমানুষে শক্তিশালী আবেগ। অর্থনৈতিক চাপে, বৈদেশিক টানাপোড়েনে, অভ্যন্তরীণ অনিশ্চয়তায় যখন দৈনন্দিন জীবন কষ্টসাধ্য, তখন পরিচয়ের রাজনীতি ডালপালা মেলে। মাঠে যখন উন্নয়ন বয়ান ক্লান্ত, সংস্কার বয়ান দুর্বুদ্ধ, নির্বাচন বয়ান অনিশ্চিত, তখন সরল নৈতিক আহ্বানগুলো দ্রুত সাড়া পায়। শালীনতা রক্ষা, ধর্মীয় অনুশাসন, সামাজিক শুদ্ধি-এই ভাষাগুলো সহজ, বোধগম্য এবং সংগঠনে অনুবাদযোগ্য। এখানে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ধর্মীয় অনুশীলনকে নাগরিক অধিকারবিরোধী বা বহুত্ববিরোধী প্রজেক্টে কে এবং কীভাবে হাইজ্যাক করছে? রমজানে দোকান বন্ধে জোর-জবরদস্তি, নারী-বালিকা ক্রীড়া বা নাট্যচর্চায় বাধা, পোশাক অবমাননা, মাজার ভাঙচুর- এসব ছিটেফোঁটা ঘটনা যদি টেমপ্লেট হয়ে ওঠে, তাহলে রাষ্ট্রের নীরবতা, অনীহা বা অনিয়মিত প্রতিক্রিয়াই তাকে উৎসাহিত করে। আইন যদি ধারাবাহিক ও দৃশ্যমানভাবে প্রযোজ্য না হয়, মুড়ি-মুড়কির মতো প্রতীকী শাস্তি আর বড় বড় বুলি কেবল ভীতি প্রদর্শন করে, প্রতিকার নয়।

চতুর্থ সূত্রটা হচ্ছে- আমার বিবেচনায় ভূরাজনৈতিক। দক্ষিণ এশিয়ায় রক্ষণশীল রাজনীতির ঢেউ নতুন নয়। ভারতে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের দীর্ঘছায়া, পাকিস্তানে ইমরান পরবর্তী পুনর্গঠনের দ্বন্দ্ব, আফগানিস্তানে প্রত্যাবর্তনের গল্প- সবমিলিয়ে বৈশ্বিক দক্ষিণে মডারেট নামের চতুর অভিধানে বহুশক্তি স্বার্থ খুঁজে। বাংলাদেশে কূটনৈতিক ও দাতাগোষ্ঠীর স্থিতিশীলতাকেন্দ্রিক অগ্রাধিকার যখন গণতান্ত্রিক প্রাতিষ্ঠানিকতার চেয়ে বেশি জোড়ালো, তখন এমন শক্তিদের সঙ্গে দূরত্ব-নিকটত্বের ক্যালেন্ডার বদলায়। ধর্মীয় স্বাধীনতা নিয়ে আন্তর্জাতিক উদ্বেগ, অভ্যুত্থান পরবর্তী কঠোরপন্থীদের সুযোগ, ধাঁচের বিদেশি আখ্যান- এসবেও অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ফিডব্যাক লোপ তৈরি করে। একদিকে সরকার আন্তর্জাতিক আস্থা ধরে রাখতে ছুঁচো মেরে হাতি মারার মত প্রতিক্রিয়াশীলতা দেখায়। অন্যদিকে মাঠের রাজনীতিতে সহিষ্ণুতার নামে সুযোগও দিয়ে ফেলে। দুধারি এই তলোয়ারই ডানপন্থীদের দরকষাকষির শক্তি বাড়ায়।

ইউটি/টিএ




Share this news on:

সর্বশেষ

img
১৫ ঘণ্টা পার হলেও উদ্ধার হয়নি শিশু সাজিদ Dec 11, 2025
img
বিকেএসপির ৫০ কিংবদন্তি খেলোয়াড়ের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ Dec 11, 2025
img
বিপিএল খেলতে ৯ ক্রিকেটারকে ছাড়পত্র দিল পিসিবি Dec 11, 2025
img
মহান বিজয় দিবস উদযাপনে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে সরকার Dec 11, 2025
img

উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ

বার্নাব্যুতে রিয়াল মাদ্রিদকে ২-১ গোলে হারাল ম্যানসিটি Dec 11, 2025
img
২০২৬ বিশ্বকাপ পর্যন্ত নেইমারকে ধরে রাখতে আত্মবিশ্বাসী সান্তোস Dec 11, 2025
img
নোয়াখালী শিবিরে যোগ দিলেন পেসার ইবরার আহমেদ Dec 11, 2025
img
বিশ্বকাপের প্রস্তুতিতে মার্চের ২ প্রতিপক্ষ চূড়ান্ত করল ইংল্যান্ড Dec 11, 2025
বড় জয় ভারতের- দক্ষিণ আফ্রিকা ৭৪ রানেই অলআউট Dec 11, 2025
img

উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ

বিলবাওয়ের মাঠে হোঁচট পিএসজির Dec 11, 2025
নিজের ছক্কার রেকর্ড হারিয়েও রোহিত শর্মাকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত আফ্রিদি Dec 11, 2025
বডি-শেমিংয়ের যন্ত্রণায় ভেঙে পড়েছিলেন কেট উইন্সলেট Dec 11, 2025
img

ফেসবুক পোস্ট দিয়ে ছাত্রশক্তি নেত্রীর পদত্যাগ

জুলাইয়ে থানার বাইক চোরের কাছে অনেক সময় হেরে যাই : জিনিয়া শারমিন রিয়া Dec 11, 2025
পদত্যাগ করলেন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ ও মাহফুজ আলম Dec 11, 2025
ট্রাম্পকে শান্তি পুরস্কার: ইনফান্তিনোর চারটি নিয়ম লঙ্ঘনের অভিযোগ Dec 11, 2025
মেগা প্রজেক্ট নয়, বিনিয়োগ যাবে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে: তারেক রহমান Dec 11, 2025
ছাত্র উপদেষ্টারা দায়িত্ব পালনে শতভাগ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে Dec 11, 2025
img
ন্যাটো আমাকে ড্যাডি বলে ডাকে : ডোনাল্ড ট্রাম্প Dec 11, 2025
১০ মিনিটে গোটা বিশ্বের সারাদিনের সর্বশেষ আলোচিত সব খবর Dec 11, 2025
প্রেস সেক্রেটারির মুখ আর ঠোঁটের প্রশংসায় মগ্ন ট্রাম্প Dec 11, 2025