বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক আরো জোরদার ও দৃশ্যমান করতে আজ শনিবার ঢাকায় আসছেন পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার। এই সফরে সরকারি পর্যায়ে আলোচনার পাশাপাশি রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গেও বৈঠক করবেন তিনি। এ ছাড়া এ দেশের নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ও শিক্ষাবিদদের সঙ্গেও তাঁর সাক্ষাতের কথা রয়েছে।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারসহ বিভিন্ন ইস্যুতে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কে টানাপড়েন দেখা দেয়।
পরে পাকিস্তান সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলেও আওয়ামী লীগ সরকার দৃশ্যমান সাড়া দেয়নি। গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পাকিস্তান বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারের উদ্যোগ নেয়। অন্তর্বর্তী সরকারও পাকিস্তানের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক রাখার নীতি অনুসরণ করছে।
দীর্ঘ ১৫ বছর বিরতির পর গত এপ্রিলে বাংলাদেশ-পাকিস্তান পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
ওই বৈঠকের পরপরই পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারের ঢাকা সফরের কথা থাকলেও কাশ্মীর সংকটের কারণে স্থগিত হয় সফরটি। অবশেষে আজ ইসহাক দার ঢাকায় আসছেন। এটি পরিবর্তিত বাংলাদেশে পাকিস্তান থেকে মন্ত্রী পর্যায়ের তৃতীয় সফর।
পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রী জাম কামাল খান গত বুধবার ঢাকায় এসেছেন। এর আগে গত জুলাইয়ে বাংলাদেশ সফর করেন পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহসিন নকভি।
জানা গেছে, পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরে স্বাক্ষরের জন্য একটি চুক্তি ও পাঁচটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) চূড়ান্ত করা হয়েছে। সম্ভাব্য চুক্তিটি হলো দুই দেশের সরকারি ও কূটনৈতিক পাসপোর্টধারীদের ভিসা বিলোপ বিষয়ে। স্বাক্ষরের জন্য সম্ভাব্য এমওইউগুলো হচ্ছে : দুই দেশের বাণিজ্যবিষয়ক যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন, সংস্কৃতি বিনিময়, দুই দেশের মধ্যে ফরেন সার্ভিস একাডেমির মধ্যে সহযোগিতা, দুই রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থার মধ্যে সহযোগিতা এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের সঙ্গে পাকিস্তানের ইসলামাবাদ পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (আইপিআরআই) মধ্যে সহযোগিতা।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ইসহাক দার আজ দুপুরে বিশেষ ফ্লাইটে ঢাকায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছবেন।
আজ ঢাকায় পাকিস্তান হাইকমিশনের পক্ষ থেকে একটি সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। অনুষ্ঠানের ফাঁকে তিনি এ দেশের শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ ও নাগরিক সমাজের কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে আলাদা বৈঠক করবেন।
সফরসূচি অনুযায়ী আগামীকাল রবিবার ঢাকায় বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা-পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষে নেতৃত্ব দেবেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন। বৈঠক শেষে দুই দেশের মধ্যে চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকগুলো স্বাক্ষরের কথা রয়েছে। ইসহাক দারের সম্মানে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন করবেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, দুই দেশের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ, সংযুক্তি, কৃষি, নানা পর্যায়ে চলাচল সুগম করাসহ দ্বিপক্ষীয় নানা বিষয় আলোচনায় থাকবে। পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ে বৈঠকের ধারাবাহিকতায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে বৈঠক হচ্ছে। এ বৈঠকে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নিতে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, বোঝাপড়া ও অভিন্ন স্বার্থের বিষয়ে জোর দেবে বাংলাদেশ।
সাম্প্রতিক সময়ে উচ্চ পর্যায়ের যোগাযোগের সম্পর্ক যেখানে এসেছে, তা এগিয়ে নিতে হলে অমীমাংসিত বিষয়গুলোর সুরাহার কথা বলা হবে। বিশেষ করে একাত্তরের গণহত্যার জন্য পাকিস্তানের আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাওয়া, আটকে পড়া পাকিস্তানিদের প্রত্যাবাসন ও অবিভাজিত সম্পদে বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যা প্রদান- ঐতিহাসিক এই তিন ইস্যুর সুরাহা চাইবে বাংলাদেশ।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, দ্বিপক্ষীয়র পাশাপাশি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ইস্যুতে আলোচনা করা হবে। ইসহাক দার আগামীকাল রবিবার ঢাকায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাত্ করবেন। দুই দিনের সফর শেষে আগামীকাল রাতে তাঁর ঢাকা ছাড়ার কথা রয়েছে।
এ বছরের শেষে বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের সরাসরি ফ্লাইট চালু হবে। দুই দেশের বন্দরের মধ্যে কানেক্টিভিটি বৃদ্ধি পেলে দেশ দুটির মধ্যে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে নতুন দুয়ার উন্মোচিত হবে। গতকাল শুক্রবার দুপুরে চট্টগ্রাম চেম্বারের আয়োজনে ব্যবসায়ী কমিউনিটির সঙ্গে মতবিনিময়ের সময় পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রী জাম কামাল খান এই আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
এ সময় ব্যবসায়ীরা দুই দেশের মধ্যে শিল্পের কাঁচামাল বিনিময়, শিপ ব্রেকিং শিল্পের কনভেনশন পেছাতে একযোগে কাজ করাসহ সর্বোপরি শিল্প ও বাণিজ্যের সম্ভাবনা নিয়ে মতামত তুলে ধরেন।
পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রী জাম কামাল খান বলেন, ‘ব্যবসা ক্ষেত্রে বিভিন্ন সম্ভাবনা চিহ্নিতকরণের লক্ষ্যে এরই মধ্যে একাধিক ব্যাবসায়িক প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করেছে এবং আরো প্রতিনিধিদল সফর করবে। বর্তমান পরিবর্তিত বৈশ্বিক অর্থনীতির ধারা আমাদের সামনে অনেক সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচন করে দিয়েছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের পাকিস্তানি ভিসা সহজীকরণের ব্যবস্থা হয়েছে।’
নগরীর ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের কনফারেন্স হলে চট্টগ্রাম চেম্বারের প্রশাসক মুহাম্মদ আনোয়ার পাশার সভাপতিত্বে এই সভায় বক্তব্য দেন বিভাগীয় কমিশনার ড. মো. জিয়াউদ্দীন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. নাজনীন কাউসার চৌধুরী, বিএসআরএম গ্রুপ চেয়ারম্যান আলী হুসেইন আকবর আলী, পান রপ্তানিকারক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. একরামুল করিম চৌধুরী, বিজিএমইএ পরিচালক এম মহিউদ্দিন চৌধুরী, বাফার সিনিয়র সহসভাপতি আমিরুল ইসলাম চৌধুরী (মিজান), প্রান্তিক গ্রুপের এমডি ইঞ্জিনিয়ার গোলাম সরওয়ার প্রমুখ।
কেএন/টিএ