‘বাজি’ গানে এক হলো মারমা-বম-মণিপুরি সুর

কেবল একটিমাত্র উৎস থেকে বাংলাদেশের সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। এটি এক ধরণের মোজাইক, যেখানে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ধারণ করা নানা সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য, বিশ্বাস আর সুর নিহিত। তাদের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠীগুলোও, যারা প্রতিটি নাচ, গান, এবং হাতে বোনা শাড়ি ও কাপড়ে বহন করে চলেছে তাদের পূর্বপুরুষের গল্প। আজকের বাংলাদেশে তাদের উপস্থিতি শুধু ঐতিহ্য নয়, সংস্কৃতি রক্ষায় তাদের দৃঢ়তার এক জীবন্ত স্মারকও বটে।

চট্টগ্রামের পাহাড়ে ভোর শুরু হয় পরিচিত এক ছন্দে। কুঁড়েঘর থেকে উড়ে আসে ধোঁয়া, বটগাছের নিচে বয়োজ্যেষ্ঠরা জড়ো হন, তাদের নীরব আড্ডা মিশে যায় পাখির কলরবে। সেখানে জীবন চলে প্রকৃতি আর ঐতিহ্যের সাথে তাল মিলিয়ে। এপ্রিলে যখন মারমা নববর্ষ ‘সাংগ্রাই’য়ের আগমন ঘটে, গ্রামগুলো যেন পরিণত হয় রঙ ও হাসির ক্যানভাসে। শিশুরা জলকেলিতে মেতে ওঠে, নারীরা ব্যস্ত হয়ে পড়ে ভাত ও সবজির ভোজ তৈরিতে, পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত হয় ঢাক-ঢোল আওয়াজ। মারমাদের কাছে এটি শুধু একটি উৎসব নয়, একতা ও আনন্দের এক নতুন সূচনা।

তাদের দৈনন্দিন প্রায় প্রতিটি কাজেই পাওয়া যায় শিল্পের ছোঁয়া। কখনো দেখা যায়, কাঠের বারান্দায় এক নারী বুনছে থামি, তার হাতের সাহসী নকশা যেন বুনে চলছে বসন্তের পাহাড়। তার ঠিক পাশেই পুরুষেরা বাঁশ কেটে তৈরি করছে নানা যন্ত্রপাতি, যা একদিকে প্রয়োজন মেটাচ্ছে, অন্যদিকে তাতে রয়েছে কাব্যের ছোঁয়াও। এদিকে চারিদিকে বেজে চলছে সংগীত, খিন ঢোলের মৃদু ধ্বনি, বাঁশির সুর, ঘণ্টার টুংটাং। সব মিলে মনে হবে যেন প্রেম, ফসল আর ভক্তির এক গল্প। পার্বত্য চট্টগ্রামের সর্ববৃহৎ আদিবাসী জনগোষ্ঠী মারমাদের জন্য এগুলো শুধু পরিবেশনা নয়, বরং দৈনন্দিন জীবনের অংশ। ধানক্ষেত থেকে মঠ, উৎসব থেকে পারিবারিক মিলনমেলা, সবত্রই সংগীত তাদের সঙ্গী। তাদের কাছে সংস্কৃতি অলংকার নয়, শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো, যা ছন্দ, সুর ও রীতি-নীতির মাধ্যমে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে প্রবাহিত হতে থাকে।

পাহাড়ের আরেকটু উঁচুতে পাওয়া যায় বম সম্প্রদায়কে। তাদের জীবন চলে মিলেমিশে থাকার ছন্দে, যেখানে প্রতিবেশীরা জমি ভাগাভাগি করে, ফসল বিনিময় করে, একে অপরের বোঝা বহন করে। তাদের কাছে সহযোগিতা কেবল ঐতিহ্য নয়, এটি বেঁচে থাকার শ্রেষ্ঠ উপায়। বমরা তাদের শিকড় খুঁজে পায় ভারত-মায়ানমার সীমান্তের চিন-কুকি-মিজো জনগোষ্ঠীতে। তাদের পোশাকই তাদের গল্প বলে। নারীরা বোনে পুয়ান, রঙিন নকশায় আঁকা এক ধরণের স্কার্ট যা পূর্বপুরুষদের কাহিনী বহন করে। এগুলো শুধু পোশাক নয়, এগুলো তাদের স্মৃতি।

রোববারে কাঠের গীর্জা থেকে ভেসে আসে স্তোত্রের সুর, যেখানে মিশনারি প্রভাব মিশে যায় স্থানীয় সুরে। রাতের বেলা তারা ভরা আকাশের নিচে প্রকৃতি, গর্ব আর নৈতিকতার গল্প খুয়াং ঢোল আর বাঁশির ছন্দে ফিরে আসে লোকগান হয়ে। উৎসব তাদের ঐক্যকে পরিপূর্ণ করে, নাচের প্রতিটি পদক্ষেপ তাদের ভূমির সাথে, একে অপরের সাথে তাল মিলায়। বমদের সংস্কৃতি লোক দেখানো নয়, বরং এটি তাদের জীবনের স্পন্দন।

বমরা পাহাড়ে তাদের ছন্দ ধরে রাখলেও, মণিপুরি সম্প্রদায় বাস করে সিলেট ও মৌলভীবাজারের সবুজ সমতলে। তাদের জীবন কাটে বৈষ্ণব ভক্তিতে রাধা-কৃষ্ণের উপাসনায়। রাসলীলা আর জন্মাষ্টমীর মতো উৎসবে গ্রামগুলো রূপ নেয় খোলা মঞ্চে, যেখানে সঙ্গীত আর নৃত্যে বলা হয় প্রাচীন গল্প। এর কেন্দ্রবিন্দু মণিপুরি নৃত্যের রত্ন “রাস”। পূর্ণিমার আলোয় রঙিন ফনেক আর ইনাফি পরা নারীরা নিখুঁত ভঙ্গিতে বৃত্তাকারে নাচতে থাকে, দেখে মনে হয় তারা যেন প্রার্থনারত।

সাদা ধুতি পরা পুরুষেরা যোগ দেয় পুং বাদক হিসেবে, তারা নাচে ও ঘোরে, তাদের ছন্দ যেন রূপকথাকে জীবন্ত করে তোলে। এগুলো মঞ্চের বিনোদন নয়, তাদের ভক্তির প্রকাশ। পোশাক বোনাও তাদের কাছে পবিত্র। মণিপুরি তাঁতে তৈরি হয় শিল্পকর্মের মতো কাপড়। যাতে প্রতিটি সুতোই গাথা হয় ইতিহাস ও বিশ্বাস সঙ্গী করে। তাদের নাচের মতো, এই শিল্পেও প্রকাশ পায় তাদের ভক্তি, যা নিজেদের পরিচয়কে অমর করে রাখার পথ হিসেবে দেখে তারা।

মারমা, বম আর মণিপুরিদের বিশ্বাস, ভাষা ও ভৌগোলিক অবস্থান আলাদা হলেও নিজেদের ঐতিহ্যকে ভবিষ্যতে বয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে দৃঢ় সংকল্প তারা। তাদের গান, নাচ আর শিল্পকর্ম জাদুঘরে বন্দি নয়, এগুলো জীবন্ত, পরিবর্তনশীল, গর্বের সাথে হস্তান্তরিত। নদী ও জঙ্গলে সৃষ্টি মারমাদের ‘বল্লাদ’, বমদের লোকস্মৃতি সম্বলিত স্তোত্র, মণিপুরিদের ভক্তিনৃত্য, এসব বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে ব্যাপক সমৃদ্ধ করেছে। বৈচিত্র্য এখানে অলংকার নয়, বরং এটি এক ধরণের শক্তি, যা পরিবর্তনশীল বিশ্বে সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখে।

প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বাংলাদেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সঙ্গীত পাহাড়-সমতলে প্রতিধ্বনিত হয়েছে, আচার, উৎসব আর পারিবারিক মিলনমেলায় বেঁচে থেকেছে। কিন্তু এসব ঐতিহ্য বেশিরভাগ সময়ই তাদের নিজস্ব অঞ্চলের ভেতরেই সীমাবদ্ধ ছিল, জাতীয় পর্যায়ে তেমন একটা উঠে আসেনি। সেই নীরবতা ভেঙেছে সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত কোক স্টুডিও বাংলার গান ‘বাজি’ দিয়ে। প্রথমবারের মতো মারমা, বম আর মণিপুরি কণ্ঠ মিলে একই মঞ্চে। মূলধারার গণমাধ্যমের কল্যাণে নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে গেছে তাদের ঐতিহ্য। মারমা পাহাড় থেকে এসেছিল কিও উ প্রু মারমার বাঁশির সুর ও তার দাদীর কণ্ঠে পূর্বপুরুষের বিলুপ্তপ্রায় গান। বমদের কাছ থেকে এলো বাঁশের খুঁটির নাচ, আর মণিপুরিরা তাতে যোগ করল অনবদ্য পুং চোলম নৃত্য, যেখানে ঢাকীরা ঘুরে ঘুরে লাফ দিয়ে নিখুঁত ভঙ্গিতে বাজাল। এগুলো কেবল পরিবেশনা ছিল না, এগুলো ছিল জীবন্ত প্রমাণ যে বাংলাদেশি সঙ্গীত ঐতিহ্য কতটা বৈচিত্র্যময় আর সমৃদ্ধ হতে পারে।

এর ফলাফল ছাপিয়ে গিয়েছিল গানকে। এটি ছিল ঐতিহ্যের মধ্যে সংলাপ, স্মরণ করিয়ে দেওয়া যে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ভবিষ্যৎ ঐক্যে নয়, নিহিত আছে সুরের সমন্বয়ের। বাজি দেখিয়েছে, যখন বিভিন্ন সুর মিলিত হয়, তখন তা শুধু সঙ্গীত নয়, সৃষ্টি করে একটি জাতির আত্মার সুর।

এসএন 

Share this news on:

সর্বশেষ

img
ডাকসু নির্বাচন জাতীয় নির্বাচন থেকে কোনো অংশে কম না : হাইকোর্ট Sep 01, 2025
img
বিপ্লবী তরুণদের নিয়ে নানা কটুকথা বলা হচ্ছে: তাসনিম জারা Sep 01, 2025
img
যেকোনো মূল্যে সকল রাজনৈতিক দলের ঐক্য ধরে রাখতে হবে : শামা ওবায়েদ Sep 01, 2025
img
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মামলা থেকে অব্যাহতি পাচ্ছেন ৩৫ ব্যক্তি Sep 01, 2025
img
ডাকসু নির্বাচনে আইনি লড়াই : প্রশংসায় ভাসছেন অ্যাডভোকেট শিশির মনির Sep 01, 2025
img
সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের কমিটি বিলুপ্ত Sep 01, 2025
img
সব ধরনের মার্কিন পণ্যে শুল্ক শূন্যে নামানোর প্রস্তাব ভারতের, দাবি ট্রাম্পের Sep 01, 2025
img
নির্বাচন না দিয়ে দেশ ছেড়ে কেউ পালাতে পারবে না : জয়নুল আবেদীন Sep 01, 2025
img
৩৬ জুলাইয়ের আদলে এবার ৩৬ দফা ইশতেহার দিল ছাত্রশিবির Sep 01, 2025
img
সেপ্টেম্বরে লঘুচাপ ও নিম্নচাপ নিয়ে আবহাওয়া দফতরের পূর্বাভাস Sep 01, 2025
যে ইহুদি নবীজিকে পরীক্ষা করেছিলেন | ইসলামিক জ্ঞান Sep 01, 2025
আধ্যাত্মিক গুরুর আশ্রমে র‌্যাপার বাদশা! Sep 01, 2025
img
মুম্বাইয়ের রাস্তায় হামলার শিকার সুমনা Sep 01, 2025
img
চীনে যাচ্ছে অ-১৭ ফুটবল দল, ঢাকায় আসছে চীনা নারী দল Sep 01, 2025
img
নির্বাচন পেছাতে নতুন নতুন ইস্যু তুলছে জামায়াত-এনসিপি : জাহেদ উর রহমান Sep 01, 2025
img
ফ্যাসিস্টরা এখন দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চায় : টুকু Sep 01, 2025
img
স্থগিত হওয়া নারী কাবাডি বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হবে বাংলাদেশে! Sep 01, 2025
রোহিতের ফিটনেস টেস্টে নতুন অধ্যায়ের ইঙ্গিত! Sep 01, 2025
পিআর পদ্ধতি নিয়ে যা বললেন জামায়াত সেক্রেটারি Sep 01, 2025
দিল্লিতে হাসিনার বাসভবন ও সিআরআইর চাঞ্চল্যকর কার্যক্রম Sep 01, 2025