শিশুর বেড়ে ওঠায় বাবা-মার আচরণ

মানসিক বিকাশ শিশুকে আত্মনির্ভরশীল হতে শেখায়, সামাজিক সম্পর্ক স্থাপনে সাহায্য করে এবং জীবনে সফল ও সার্থক হয়ে ওঠার দরজা খুলে দেয়। 

মায়ের সঙ্গেই শিশুর সর্বপ্রথম সমঝোতা ও মানবিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এ সম্পর্ক আনন্দদায়ক ও উৎসাহব্যঞ্জক হলে শিশু তার বহির্জগতকে আরও জানতে, শিখতে ও বুঝতে পারে। এটিই শিশুর মানবিক বিকাশের প্রথম ভিত্তি। এ ভিত্তির সঙ্গে বাবাও জড়িত। 

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, বাবা-মা তাদের সন্তানদের প্রতি অনেক সময় এমন আচরণ করেন বা এমনভাবে ‘শাসন’ করেন যা ভালোর পরিবর্তে ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ফলে শিশুর স্বাভাবিক ও সুষ্ঠু বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। তাই শিশুর প্রতি গাইডেন্স ও আচরণ বিজ্ঞানসম্মত হতে হয়। 

অতিরক্ষণশীল মনোভাব

সাধারণত মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শহুরে পরিবারে এ আচরণ দেখা যায়। সন্তানের প্রতি বাবা-মার মনোভাব ও আচরণ এতটাই আবেগপূর্ণ থাকে যে, স্নেহ-মমতা-ভালোবাসা দিয়েই তারা সন্তানকে সবকিছু থেকে রক্ষা করতে চান। যেমন শিশু যদি নিজ হতে খেতে চায় তখন বাবা-মা বলেন, তুমি নিজ হাতে খেয়ো  না, তোমার কষ্ট হবে- আমি তোমাকে খাইয়ে দিচ্ছি। তেমনি শিশু নিজের কাপড় নিজে পরতে চাইলে তারা শিশুকে পরতে না দিয়ে নিজেই পরিয়ে দেন। এ শিশুরা স্কুলে কোনও মানসিক চাপে পড়লে বা সামাজিক কোনও সমস্যায় পড়লে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার সাহস ও আত্মবিশ্বাস না থাকায় ওই কাজ থেকে পিছিয়ে যায় বা বাবা-মাকে এর সমাধানে জড়িত করে।

  • যে কোনও ব্যাপারে নিজ থেকে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।
  • পরনির্ভরশীল হয়ে বেড়ে ওঠে।
  • সমাজে খাপ খাইয়ে নিতে পারে না।
  • সামাজিকভাবে ব্যাল্যান্স না হওয়ায় যে কোনও সমস্যা সমাধানের জন্য বাবা-মার আশ্রয় নেয়।

সমালোচনামূলক মনোভাব

এ ধরণের বাবা-মা কখনও সন্তানের প্রশংসা করতে চান না। তারা সন্তানের কোনও কাজই সন্তুষ্ট নন। যেমন সন্তান যদি পরীক্ষায় এ প্লাস পায়, তারা বলেন-তুই তো গোল্ডেন পেলি না। তারা মনে করেন, এভাবে বললে তাদের সন্তানের আরও ভালো করার প্রতি আকাঙ্ক্ষা জাগবে। এ ধরণের বাবা-মা সব সময় অন্য বাচ্চার সঙ্গে তাকে তুলনা করে। যেমন- তোর মামাতো ভাই তো খুব সুন্দর ছবি আঁকে, তুই তো কিছুই পারিস না। ফলে বাবা-মার প্রতি সন্তানের দূরত্ব সৃষ্টি হয় এবং তারা কোনও ব্যাপারে বাবা-মাকে জানায় না। বাবা-মার ভালো পরামর্শগুলোও তারা শোনে না, মানে না।

ফলাফল

  • স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কোনও কাজ করার উৎসাহ ও সাহস হারিয়ে ফেলে। 
  • যে কোনও কাজে আগে থেকেই হার স্বীকার করে।
  • বাবা-মার প্রতি তার মনের কান ঢেকে ফেলে। ফলে তাদের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি হয়।

কর্তৃত্বমূলক আচরণ

আমি তোমার মা বা বাবা, অতএব আমি যা বলছি তাই তোমাকে করতে হবে। কারণ আমি তোমার চেয়ে অনেক ভালো বুঝি- তাই আমার কথামতোই তুমি চলবে। এভাবেই সন্তানদের প্রতি বাবাগিরি বা মাগিরি ফলায় আমাদের বাবা-মা। আমাদের দেশে পিতৃত্ব বা মাতৃত্বসুলভ আচরণ শেখানোর কোনও ফরমাল ট্রেনিং না থাকায় অনেক বাবা-মা বুঝতে পারে না তারা তাদের সন্তানকে কীভাবে ‘শাসন’ বা গাইড করবেন। তারা সন্তানদের জন্য সবকিছু নির্দিষ্ট করে দেন। এটা করবে, এটা নয়; ওটা খাবে, এটা নয়- তাদের শাসনের ধরণ এমনই। এভাবে শিশু অসহায় হয়ে যায়। বাবা-মার ধারণা- আমার সন্তানদের জন্য যা ভালো বুঝছি তাই করছি। এ অভিভাবকরা কখনও নিজের ভুল স্বীকার করে না। তাই তারা কখনও ‘সরি’ বা ‘দুঃখিত’ বলেন না।

  • এ ধরণের শিশুরা আত্মকেন্দ্রিক ও অন্তর্মুখী হয়ে পড়ে। 
  • তাদের বহুমুখী আচরণ কমে যায়, ফলে সৃজনশীলতা ব্যাহত হয়।
  • ছকবাঁধা জীবনে তারা কখনও কখনৗ জেদি ও হিংসাত্মক আচরণ করে।

হিংসাত্মক আচরণ

সন্তানের কোনও কাজেই এ ধরণের বাব-মা স্বীকৃতি দেন না এবং সবসময় কঠিন ভাষা প্রয়োগ করে তাকে শাসান। একে ভার্বাল এবিউস বলে। কখনও কখনও শারীরিক অত্যাচার করতেও তারা ছাড়েন না। বকাঝকা আর মারধর করাই এ ধরণের বাবা-মার বৈশিষ্ট্য। এ বাবা-মায়েরাই আবার আত্মীয়-স্বজন বা চিকিৎসকের কাছে অভিযোগ করেন- এত মারি, এত বকি তবুও বাচ্চা আরও খারাপ হয়ে যাচ্ছে।

ক্ষতিকর দিক

  • সন্তানরা বাইরের পরিবেশর সবার সঙ্গে মারামারি, বকাবকি করে। ফলে সামাজিক সম্পর্ক স্থাপনে তারা ব্যর্থ হয়।
  • এরা পড়ালেখায় ভালো করে না এবং জীবনে সাফল্যও পায় না। 
  • কারও সঙ্গেই এদের বন্ধুত্ব টেকসই ও স্থায়ী হয় না। 
  • বাবা-মাসহ সবার প্রতি অবাধ্য আচরণ করে। 
  • যে কোনও সমস্যা সমাধানে তারা বকা এবং মারামারিকেই বেছে নেয়। 
  • অন্যের দুঃখে কষ্টে তারা এতটুকুও সহানুভূতি বা সহমর্মিতা প্রকাশ করে না। 

তাই বাবা-মার উচিত হবে এ ধরণের আচরণ থেকে বেরিয়ে এসে তাদের সন্তানদের সঠিক উপায়ে ‘মানুষ’ করা। সন্তানকে ভালোবাসা ও স্বাধীনভাবে বেড়ে ওঠার সুযোগ করে দিতে হবে। তবে এ স্বাধীনতা যেন নিয়ন্ত্রিত ও সীমার মধ্যে থাকে। 

সন্তানকে সব কিছু করতে দেয়া এবং তার মতামতকে বিবেচনা করতে হবে। যেমন- ভাত নিয়ে কেউ নিজের হাতে খেতে চাইলে তাকে উৎসাহ দিতে হবে এবং গাইড করতে হবে। এভাবে শিশুর কনফিডেন্স অনেক বেড়ে যায়। 

তার প্রত্যেক কাজেই উৎসাহ ও স্বীকৃতি দেয়া উচিত। শারীরিক-বিপজ্জনক কোনও পরিস্থিতির মুখোমুখি না হওয়া পর্যন্ত তাকে কোনও কাজে বিরত না রাখাই ভালো। ভালো কাজকে পুরস্কৃত করা উচিত। তবে ভালো করলে পুরস্কার পাবে- এ লোভ দেখানো যাবে না। 

নীরব ভালোবাসা শিশুরা উপভোগ করে। এভাবে শিশুরা নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে জ্ঞাত হয়। 

 

টাইমস/এসই/এইচইউ

Share this news on:

সর্বশেষ

img
বেশি ছাড় দেওয়ার মানসিকতায় মাইনকা চিপায় বিএনপি : মাসুদ কামাল Nov 01, 2025
img
কিউরেটর গামিনির সঙ্গে বিসিবির সম্পর্ক সমাপ্তির পথে Nov 01, 2025
img
অভিষেক শর্মা ভারতের পরবর্তী ব্যাটিং সুপারস্টার: অশ্বিন Nov 01, 2025
img
বিএনপি অন্যায়ভাবে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে: ডা. তাহের Nov 01, 2025
img
উত্তম-সুচিত্রার পেশাদারিত্বের প্রশংসায় মুখ খুললেন রঞ্জিত মল্লিক Nov 01, 2025
img
শেখ হাসিনার কনফিডেন্স শূন্যের কোটায়: জিল্লুর রহমান Nov 01, 2025
img
সাংবাদিকতার অতীত মানদণ্ড হারিয়ে ফেলেছে রয়টার্স : উপ-প্রেস সচিব Nov 01, 2025
img
মা হতে বারবার ব্যর্থ হলেও হার মানেননি ফারাহ খান! Nov 01, 2025
img
রোববারের মধ্যে ৩ বিভাগে ভারী বৃষ্টির আভাস Nov 01, 2025
img
আজ থেকে শুরু জাটকা শিকারে নিষেধাজ্ঞা Nov 01, 2025
img
বঙ্গভবন থেকে মুজিবের ছবি নামানো অন্যায় হয়েছে : সেলিম Nov 01, 2025
img
‘প্রিন্স’ নায়িকার পারিশ্রমিক নিয়ে শোবিজে তুমুল আলোচনা Nov 01, 2025
img
ট্রাম্পের দেওয়া নেকলেস অর্থ দিয়ে কিনে রাখলেন স্টারমার Nov 01, 2025
img
ভোট নিয়ে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে: শামা ওবায়েদ Nov 01, 2025
img
নিজ বাসার ছাদে খুন হলেন আওয়ামী লীগ নেতা Nov 01, 2025
img
এই সরকারের অধীনে ভালো নির্বাচন দেখি না : জিল্লুর রহমান Nov 01, 2025
img
গণভোট ছাড়া জাতীয় নির্বাচন হবে অর্থহীন: জামায়াত আমির Nov 01, 2025
img
দুর্বল শাসন ব্যবস্থাই বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনের কারণ : আজিত দোভাল Nov 01, 2025
img
বেটিংয়ে জড়ানোয় বরখাস্ত ১৪৯ রেফারি Nov 01, 2025
img
ভেনেজুয়েলায় হামলার পরিকল্পনা নেই: ট্রাম্প Nov 01, 2025