আবরার হত্যা ও ছাত্র রাজনীতি প্রসঙ্গে যা বললেন ডাকসুর ভিপি নুর

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সহ-সভাপতি (ভিপি) নুরুল হক নুরের সঙ্গে কথা হয়েছে বাংলাদেশ টাইমস প্রতিবেদকদের।

বৃহস্পতিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু ভবনের ছাদে নেয়া সেই সাক্ষাৎকার পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-

বাংলাদেশ টাইমস: ক্ষমতায় যে দলগুলো থাকে, এরা তো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন হলে তাদের ক্ষমতা দেখায়,  হত্যাসহ বিভিন্ন ঘটনা ঘটায়। এসব নিয়ে আপনার মন্তব্য কি?

ডাকসু ভিপি নুর: এটা ঠিক যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নির্যাতন ও নিপীড়ন চলে, হত্যা চলে, রাজনৈতিক দাসত্বের রাজনীতি চলে। শিক্ষার্থীদেরকে রাজনৈতিক দাসত্বের মধ্যে আবদ্ধ করে, তাদের জোর করে মিছিল মিটিং করানো কিংবা রাজনৈতিক কর্মসূচিতে নেয়া এসব ঘটনা নতুন নয়। সেই ৯০ এর দশকের পর থেকেই চলে এসেছে।

যে দল ক্ষমতায় থেকেছে সেই দলই ছাত্র সংগঠনকে ব্যবহার করেছে। আজকে যে ছাত্রলীগ মানে আওয়ামী লীগ যে পর পর তিন টার্ম ক্ষমতা নিয়েছেন, তারা খুব বেশি বেপরোয়া হয়ে গেছেন। তাদের কর্মকাণ্ড লাগামহীন হয়ে গেছে। বেড়েছে নির্যাতন ও নিপীড়নের মাত্রা। সেই কারণেই আজকে আবরারের মতো ছাত্রকে বুয়েটের একটি হলে পিটিয়ে মারা হয়েছে। এটি শুধু বুয়েটের চিত্র নয়। বরং এটি সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চিত্র।

সুতরাং এটা তো শুধুমাত্র ছাত্র সংগঠন এই কর্মকাণ্ডের জন্য দায়ী নয়। এর জন্য সেই সংগঠনের রাজনৈতিক দল দায়ী, যারা তাদের ছাত্র সংগঠনগুলোকে ভিন্নমত দমন, ক্যাম্পাস দখল করার জন্য উৎসাহিত করে। ভিন্ন মতের মানুষ জনের ওপরে হামলা মামলা চালিয়ে ক্যাম্পাসকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য উৎসাহিত করে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রশাসক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করার পরেও সেই ছাত্র সংগঠনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় না। বরং তারা তাদের অপকর্মকে নিয়ে সাফাই গায়। এছাড়া তারা তার সহযোগীর ভূমিকা পালন করে। এখানে প্রশাসনেরও দায় রয়েছে।

বাংলাদেশ টাইমস: আবরার হত্যার জন্য তো ১০ জনকে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে এবং ১৯ জনের নামে মামলাও হয়েছে এবং তাদেরকে গ্রেপ্তার করার জন্য সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, এটাকে আপনি কিভাবে দেখেন?

ডাকসু ভিপি নুর: তাদেরকে (ছাত্রলীগ) ধরা হয়েছে বা রিমান্ডে নেয়া হয়েছে, এটা একটা পজিটিভ দিক। কিন্তু পজিটিভ দিকটা যখনই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে তখনই সিসিটিভির ফুটেজ নিয়ে শুরু করতো, তাহলে আমরা বুঝতাম যে ভালো একটা পজিটিভ দিক। সেটা না করে কিন্তু ছাত্রদের সিসিটিভির ফুটেজ হল প্রশাসন দিতে চায়নি। একটি হত্যাকাণ্ড ঘটার পরও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন সেখানে এসে কথা বলেনি। বরং ছাত্রদের সাথে বাকবিতণ্ডা হয়েছে।

ছাত্রদের রাজপথে বিক্ষোভ মিছিল করতে হয়েছে। আমরা ছাত্র সমাজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমরা প্রতিবাদ করেছি। তারপরেও অপরাধীদের ধরার জন্য বা চিহ্নিত করা জন্য প্রশাসন একটু নড়ে চড়ে বসেছে। ছাত্রদের যদি প্রতিবাদ না হতো তাহলে হয়তো এই অগ্রগতি হতো না।

বাংলাদেশ টাইমস: বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি বন্ধে যে আন্দোলন চলছে, এটাকে আপনি কিভাবে দেখেন?

ডাকসু ভিপি নুর: এখানে তাদের সাথে আমি একাধিকবার কথা বলেছি। তারা সামগ্রিকভাবে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের কথাটা আসলে বলতে চায়নি। তারা এখানে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের যে সন্ত্রাস নির্ভর ছাত্ররাজনীতি তা বন্ধ করার কথাটা বলেছে। কিন্তু যেহেতু ক্ষমতায় রয়েছে একটি দল, আর তাদের নিয়ন্ত্রণেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, আইন, প্রশাসন সব। সুতরাং তাদের বিরুদ্ধে কথা বলাটা আবার তাদের বিরুদ্ধে গিয়ে কাজ করাটা বা টিকে থাকাটা কঠিন এই সময়ে। সেই জায়গা থেকে তারা জেনারেলি ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের কথা বলেছে। এই ছাত্ররাজনীতির একটা গৌরব উজ্জ্বল ভূমিকা ছিল। এই দেশের মানুষের সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও সংগ্রামে এই ছাত্ররাজনীতির সবাই কিন্তু আন্দোলন করেছে, সেই দাবি আদায় করেছে, নেতৃত্ব দিয়েছে। সেখানে যদি ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়, তাহলে এই দেশে স্বৈরতন্ত্র কায়েম হবে।

সমাজে যে অন্যায়, অনিয়ম, ঘুষ, দুর্নীতি, অবিচার সেগুলো কিন্তু বাড়বে। কারণ এখন আবরার হত্যার বিচারের দাবিতে এই ছাত্র সমাজই সারা দেশে বিক্ষোভ মিছিল করছে। এটাও একটা রাজনীতি, সচেতনতার মধ্যে পড়ে। কারণ তারা দেখতেছে যে ক্ষমতাসীন দলের যে ছাত্র সংগঠনের যে নির্যাতন নিপীড়ন মানুষের ওপরে হচ্ছে সেগুলোর প্রতিবাদ করা দরকার। সেজন্য তারা ওই রাজনৈতিক চেতনা থেকে তারা প্রতিবাদ মুখর হয়েছে। নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, ভ্যাট আন্দোলন, কোটা সংস্কার আন্দোলন, এই আন্দোলনগুলোতে ছাত্ররা কিন্তু রাজনৈতিক সচেতন থাকার কারণেই সম্পৃক্ত হয়েছে।

সুতরাং আজকে যে কলুষিত রাজনীতি, শিক্ষাঙ্গনগুলোতে যে সন্ত্রাস বা দলীয় লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি চলছে তা বন্ধ করে পরিচ্ছন্ন সুষ্ঠু ধারার রাজনীতি চালু করতে হবে। সেজন্য ছাত্র সংসদ নির্বাচনের নিয়ম যদি চালু হয়ে যায়, তবে কলুষিত রাজনীতি, অপরাজনীতি, সন্ত্রাস নির্ভর রাজনীতি থাকবে না। যদি ছাত্র সংসদ নির্বাচনের বিষয়টা যদি সামনে আসে কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজগুলোতে প্রশাসন, সরকারের আন্তরিকতা থাকে তবে বুয়েটেও ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের কথা বলবে না। এখন তারা সরকারি দলের সন্ত্রাসীদের সন্ত্রাস নির্ভর ছাত্ররাজনীতিতে অতিষ্ঠ হয়ে তারা এই ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবি তুলেছে।

বাংলাদেশ টাইমস: সনি হত্যা হয়েছিল ২০০২ সালে। তারপরে বুয়েটে ৭ বছর ছাত্র রাজনীতি বন্ধ ছিল। তারপরে ২০০৯ সাল থেকে ছাত্র রাজনীতি আবার শুরু হলো। শিক্ষার্থীরা বলছেন, এসময়ে আমরা ভালো ছিলাম। তবে তারা ২ বা ৩ বছর ব্যাপী অনেক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, এরকম চিত্র আমরা অনেক জায়গায় দেখেছি। এ নিয়ে আপনার মন্তব্য কি?

ডাকসু ভিপি নুর: সনি হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল আওয়ামী লীগের সময়ে নয়, বিএনপির সময়ে। ছাত্রদলের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে। সেজন্য আমরা বলছি যে, যখন যে দল এই যে গণতন্ত্রের মুখোশে এক ধরনের স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা চালিয়েছে দেশে, সেসময় তাদের ছাত্র সংগঠনও এরকম নির্যাতন চালিয়েছে। তখনকার সময়ে সেই মাত্রা একটু কম ছিল। এখন এর মাত্রা বেড়েছে। আসলে একই দল তিন টার্ম থাকায় তাদের মাত্রাটা অতিরিক্ত হয়ে গেছে।

আজকে সেই কারণে বলছি যে আগের ছাত্ররাজনীতি অনেক ভালো ছিল। এখনকার সন্ত্রাস নির্ভর রাজনীতিতে অতিষ্ঠ হয়ে গেছে। ছাত্ররাজনীতি কখনও নিষিদ্ধ হবে না। এখন সাময়িকভাবে সরকার এই যে ছাত্রদের যে উত্তাল প্রতিবাদ সারা দেশে যে ছাত্র, শিক্ষক, সাংবাদিক সকল মানুষ এই আবরার হত্যাকাণ্ডে ঐক্যবদ্ধ করার পথে যাচ্ছে। এটি সমস্ত জাতিকে নাড়া দিয়েছে।

যখন মানুষকে প্রতিবাদে ফুসে উঠেছে তখন এই ঘটনাকে ঠান্ডা করার জন্য সরকার যে কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কিন্তু এই ঘটনা যখন থেমে যাবে আবার এই রাজনৈতিক চর্চায় চলবে। তাই ছাত্রদের কাছ থেকে, শিক্ষকদের কাছ থেকে, সাংবাদিকদের কাছ থেকে সুষ্ঠু ধারার আজ ছাত্ররাজনীতির দাবিটা আসতে হবে। আর সেই সুষ্ঠু ধারার দাবির একমাত্র উপায় হচ্ছে ছাত্র সংসদ নির্বাচনগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চালু করে দেয়া।

বাংলাদেশ টাইমস: আপনাকে ধন্যবাদ।

 

ডাকসু ভিপি নুর:  আপনাকেও ধন্যবাদ

 

টাইমস/টিআর/এইজে/এসআই

Share this news on:

সর্বশেষ

img

শহীদ মিনারে হাজার হাজার শিক্ষক

‘মার্চ টু যমুনা’র প্রস্তুতি নিচ্ছেন শিক্ষক-কর্মচারীরা Oct 16, 2025
img
এইচএসসি পরীক্ষায় ভূগোল বিষয়ে অনুত্তীর্ণ মারুফা Oct 16, 2025
img
হাবিবুরসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে সূচনা বক্তব্য ২৩ অক্টোবর Oct 16, 2025
img
এবারের এইচএসসির ফলাফল সবাইকে বিস্মিত করেছে: শিক্ষা উপদেষ্টা Oct 16, 2025
img
চট্টগ্রামে শতভাগ পাস করেছে ৮ কলেজের শিক্ষার্থীরা Oct 16, 2025
img
ক্রমশ এক জটিল পরিস্থিতির দিকে দেশ যাচ্ছে : জিল্লুর রহমান Oct 16, 2025
img
শিক্ষকদের দাবি দাওয়া নিয়ে সরকার কাজ করছে : শিক্ষা উপদেষ্টা Oct 16, 2025
img
বাংলাদেশকে নিয়ে হোমওয়ার্ক সেরে মাঠে অস্ট্রেলিয়া নারী দল Oct 16, 2025
img
এবার জিপিএ-৫ কমেছে ৭৬ হাজার ৮১৪ Oct 16, 2025
img
কমে যাচ্ছে শতভাগ পাস করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা Oct 16, 2025
img
শেখ হাসিনা-রেহানা-টিউলিপের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিচ্ছেন সিটি করপোরেশনের ৭ কর্মকর্তা Oct 16, 2025
img
জুলাই সনদ স্বাক্ষরের আগে তিন দাবি এনসিপির Oct 16, 2025
img
মক্কায় নতুন প্রকল্পে একসঙ্গে নামাজ পড়তে পারবেন ৯ লাখ মুসল্লি Oct 16, 2025
img
'৮টি যুদ্ধ থামিয়েছি, কিন্তু নোবেল পাইনি', ট্রাম্পের আক্ষেপ Oct 16, 2025
img

ঢাকা বোর্ড চেয়ারম্যান

আমরা ফল বানাইনি, বাস্তব চিত্রটাই এবার সামনে এসেছে Oct 16, 2025
img
৬ লাশ পোড়ানোর মামলায় চলছে ১৬তম সাক্ষীর জবানবন্দি Oct 16, 2025
img
আলোচিত শিক্ষার্থী আনিসা ২ বিষয়ে ফেল Oct 16, 2025
img
জুয়ার বিজ্ঞাপন বন্ধ করেছে ইএসপিএন ক্রিকইনফো : ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব Oct 16, 2025
img
ফলাফলে এগিয়ে মেয়েরা, ছেলেদের প্রায় অর্ধেক ফেল Oct 16, 2025
img
সিলেট শিক্ষাবোর্ডে পাসের হার মাত্র ৫১.৮৬ শতাংশ Oct 16, 2025