বার্ট্রান্ড রাসেল: যুদ্ধবিরোধী শান্তিবাদী দার্শনিক

বার্ট্রান্ড রাসেল। একজন বিখ্যাত শান্তিবাদী দার্শনিক। তিনি একাধারে একজন যুক্তিবিদ, গণিতবিদ, ঐতিহাসিক, সাহিত্যিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক সক্রিয় কর্মী ও নোবেল জয়ী ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন একজন উদারনৈতিক, সমাজতান্ত্রিক ও শান্তিবাদী মানুষ। যদিও সরাসরি কোনো বিশেষ রাজনৈতিক গোষ্ঠীর সঙ্গে তিনি নিজেকে জড়াননি। তবে তিনি তার দার্শনিক তত্ত্ব ও লেখনীর মাধ্যমে যুদ্ধবাদী আচরণের বিরুদ্ধে আজীবন লড়াই করে গেছেন। শান্তির জন্য তার সংগ্রাম ও ত্যাগের কারণে বিশ্বব্যাপী মানবতাবাদী মানুষের কাছে তিনি এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।

বার্ট্রান্ড রাসেল ১৮৭২ সালের ১৮ মে যুক্তরাজ্যের ওয়েলসের মনমাউথশায়ারে একটি অভিজাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার দাদা জন রাশেল দুই মেয়াদে বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।

১৮৭৬ সালে মাত্র চার বছর বয়সেই তিনি তার বাবা-মা ও বোনকে হারান। এরপর তারা দাদা-দাদির কাছেই তিনি লালিত-পালিত হন। দুর্ভাগ্যক্রমে ১৮৭৮ সালে তার দাদাও মারা যান। এরপর তার জন্য গৃহশিক্ষকের ব্যবস্থা করেন তার দাদী। ফলে শৈশবে তিনি বিদ্যালয়ের সহপাঠীদের সাহচর্য থেকে বঞ্চিত হন।

রাসেল খুব মেধাবী ছিলেন। তাই ১৮৯০ সালে তিনি বৃত্তি নিয়ে ক্যামব্রিজের বিখ্যাত ট্রিনিটি কলেজে গণিত নিয়ে পড়তে যান। ওখানে থাকাকালে তিনি আলফ্রেড নর্থ হোয়াইটহেডের সুপারিশে ক্যমাব্রিজ অ্যাপস্টলস (দার্শনিকদের একটি সংগঠন)-এর সদস্য হন। এসময় বিভিন্ন দার্শনিকের বক্তব্য দ্বারা তিনি প্রভাবিত হন এবং দর্শন বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।

১৮৯৩ সালে তিনি গণিত বিষয়ে প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন এবং পরে দর্শন নিয়ে জ্ঞান অর্জনের দিকে মনোযোগ দেন। ১৮৯৪ সালে তিনি নৈতিক বিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশোনা শেষ করেন এবং প্যারিসের ব্রিটিশ অ্যাম্বাসিতে সহকারী রাষ্ট্রদূত হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। এসময় তিনি ‘An Essay on the Foundations of Geometry’ এর উপর থিসিস লেখা শুরু করেন। এর ফলে ১৮৯৫ সালেই তিনি ট্রিনিটি কলেজে ফেলোশিপ পেয়ে যান।

কিছুদিন পর তিনি বার্লিনে চলে যান, যেখানে তিনি কয়েকমাস সামাজিক গণতন্ত্র বিষয়ে পড়াশোনা করেন। এসময় তিনি বৈজ্ঞানিক দর্শন এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক জিজ্ঞাসা নিয়ে লেখালেখি শুরু করেন। পরে তিনি আবার ইংল্যান্ডে চলে আসেনে এবং দর্শন নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। ১৮৯৬ সালে তিনি লন্ডন স্কুল অব ইকোনোমিক্সে লেকচারার হিসেবে যোগ দেন। ১৮৯৮ সালে তিনি ‘An Essay on the Foundations of Geometry’ নামে গ্রন্থ প্রকাশ করেন।

১৮৯৯ সালে তিনি ট্রিনিটি কলেজে লেকচারার হিসেবে নিয়োগ পান। পরের বছর তিনি প্যারিসে দর্শন বিষয়ক আন্তর্জাতিক কংগ্রেসে অংশগ্রহণ করেন। এখানে তিনি বিখ্যাত গণিতবিদদের সঙ্গে পরিচিত হন এবং গণিত নিয়ে গবেষণা করতে অনুপ্রাণিত হন। ইংল্যান্ডে ফিরে এসে তিনি ‘Formulation of mathematics’ নিয়ে গবেষণা শুরু করেন এবং ১৯০১ সালে এ বিষয়ে ‘Russell’s Paradox’ আবিষ্কার করেন। ১৯০৩ সালে তিনি তার ‘The Principles of Mathematics’ গ্রন্থে এ তত্ত্বটি তুলে ধরেন।

১৯১০ সালে তিনি ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারার হিসেবে নিয়োগ পান। এই সময় তিনি ‘Principia Mathematica’ নামে তিনখন্ড গ্রন্থ প্রকাশ করেন, যার কারণে তিনি বিশ্বব্যাপী বিখ্যাত হয়ে যান।

১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ব্রিটেন যুদ্ধে অংশ নেয়। এ সময় তিনি শান্তিকামী দলে যোগ দেন এবং যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন করেন। এর ফলে তাকে অভিযুক্ত করা হয় এবং ১৯১৬ সালে ট্রিনিটি কলেজ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। বিচারে তাকে ১০০পাউন্ড জরিমানা করা হয়। তিনি জরিমানা দিতে অস্বীকার করেন এবং জেলে যেতে রাজি হন। তবে সরকার তার বই নিলামে বিক্রি করে জরিমানা আদায় করে।

১৯১৭ সালে তিনি লীডসে সমাজতান্ত্রিক সম্মেলনের আয়োজন করতে ভূমিকা রাখেন। এ সম্মেলনে বক্তব্য দিয়ে তিনি বেশ প্রশংসিত হন। বিশ্বযুদ্ধে যুক্তরাজ্যের পক্ষে যুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে আমন্ত্রণ জানানোর প্রতিবাদে ১৯১৮ সালে তিনি জনসম্মুখে প্রতিবাদ জানিয়ে বক্তব্য দেন। এর ফলে তার ছয় মাসের জেলে হয় এবং জেলে থাকাকালে তিনি ‘Introduction to Mathematical Philosophy’ নামে বই লিখেন।

১৯২০ সালে তাকে আবারও ট্রিনিটি কলেজে শিক্ষক হিসেবে ফিরিয়ে আনা হয়। এই বছরই ব্রিটিশ সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে তাকে রাশিয়ায় পাঠানো হয়। তবে রাশিয়ার পরিস্থিতি দেখে তিনি খুব মর্মাহত হন। তিনি ছুটি নিয়ে চীনে ও জাপানে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তার শান্তিবাদী আদর্শ নিয়ে বক্তব্য রাখেন। ১৯২১ সালে তিনি ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করেন এবং আবারও লেখালেখি শুরু করেন।

১৯২২ ও ১৯২৩ সালে তিনি চেলসি থেকে লেবার পার্টির পক্ষে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। কিন্তু তার বৈপ্লবিক চিন্তাধারা এবং নির্বাচকমণ্ডলী রক্ষণশীল হওয়ায় তিনি জিততে পারেন নি। ১৯২৭-১৯৩২ সালে তিনি পরীক্ষামূলকভাবে বেকন হিল স্কুল পরিচালনা করেন। পরে ১৯৩৭ সালে আবারও লন্ডন স্কুল অব ইকোনোমিক্স-এ লেকচারার হিসেবে যোগ দেন।

১৯৩৮ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান এবং শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন ভিসিটিং অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৪০ সালে তিনি নিউইয়র্ক সিটি কলেজে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তার উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তাকে এ পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। অতঃপর তিনি মেরিনে বার্নেস ফাউন্ডেশনের সঙ্গে পাঁচ বছরের জন্য চুক্তিবদ্ধ হন। এখানে তিনি দর্শনের ইতিহাস নিয়ে ধারাবাহিক বক্তব্য দেন। পরবর্তীতে তার বক্তব্যগুলো ‘A History of Western Philosophy’ নামে বই আকারে প্রকাশিত হয়।

১৯৪৩ সালে এই চুক্তি বাতিল হয়ে গেলে ১৯৪৪ সালে তিনি আবারও ক্যামব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে যোগদান করেন।

১৯৪৫ সালে তিনি ‘A History of Western Philosophy’ নামে বই প্রকাশ করেন, যা সর্বাধিক বিক্রিত বইয়ের তালিকায় স্থান পায়। ফলে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয়ের বাইরেও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। একই সময়ে তিনি ব্যাপকভাবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। তিনি ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরোধিতা করেন এবং পরমাণু নিরস্ত্রীকরণের লক্ষ্যে কাজ করেন। পরমাণু যুদ্ধের ভয়াবহতা ও এর প্রতিবাদ জানিয়ে আইনস্টাইনের সঙ্গে তিনি ‘রাশেল-আইনস্টাইন ম্যানিফেস্টু’ ঘোষণা করেন। এছাড়া সুয়েজ খাল নিয়ে সৃষ্ট সংকটেও তিনি গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

১৯৬১ সালে তিনি লন্ডনে পরমাণু-অস্ত্রবিরোধী র্যা লি বের করেন, এজন্য সাত দিন কারাবরণ করেন। ১৯৬২ সালে কিউবায় সৃষ্ট মিসাইল সংকটে সমাধানেও তিনি ভূমিকা রাখেন। ১৯৬৬-১৯৬৭ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা তদন্তে গঠিত ট্রাইব্যুনালে তিনি কাজ করেছেন। এছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধেও তিনি সোচ্চার ছিলেন। এভাবে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত যুদ্ধের বিরুদ্ধে শান্তির বার্তা নিয়ে কাজ করে গেছেন বার্ট্রান্ড রাসেল।

অবশেষে ১৯৭০ সালের ৩১ জানুয়ারি এই শান্তিকামী এই মহান দার্শনিক মারা যান।

১৯০৮ সালে তিনি ইংল্যান্ডের বিখ্যাত রয়্যাল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হন। ১৯৪৪ সালে তাকে ট্রিনিটি কলেজের আজীবন ফেলো নির্বাচিত করা হয়। ১৯৪৯ সালে ব্রিটেনের রাজার জন্মদিনে তাকে ‘অর্ডার অব মেরিট’ পুরস্কার দেয়া হয়। মানবিক আদর্শ ও মুক্তচিন্তা নিয়ে লেখার স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৫০ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান।

এছাড়া লন্ডন গণিত সমিতি কর্তৃক ‘ডি মর্গ্যান পদক’ (১৯৩২), রয়্যাল সোসাইটি কর্তৃক ‘সিলভেস্টার পদক’(১৯৩৪), কলিঙ্গ পুরস্কার (১৯৫৭), জেরুজালেম পুরস্কার (১৯৬৩) সহ অসংখ্য সম্মাননা ও পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন শান্তির দূত বার্ট্রান্ড রাসেল।

তার একটি বিখ্যাত উক্তি-

“একটি বই পড়ার দুটি উদ্দেশ্য থাকা উচিত; একটি হল- বইটিকে উপভোগ করা; অন্যটি হল- বইটি নিয়ে গর্ব করতে পারা”

 

টাইমস/ইএইচ/জিএস

Share this news on:

সর্বশেষ

img
মিরপুরে বাসে অগ্নিসংযোগের পর পালাতে গিয়ে যুবকের মৃত্যু Nov 14, 2025
img
দক্ষিণ কোরিয়ায় জনশক্তি রপ্তানি বাড়াতে চান উপদেষ্টা আসিফ নজরুল Nov 14, 2025
img
গণভোট ও নির্বাচন একসঙ্গে হওয়া প্রসঙ্গের ব্যাখ্যা দিলেন মির্জা গালিব Nov 14, 2025
img
'যে সৎ কাজটা তোমাকে ভয় দেখায়, সেটাই করো' Nov 14, 2025
img
“যে বিষয়ে কিছুই জানি না, সেখানে যাব না। অন্তত লোক হাসাতে চাই না” Nov 14, 2025
img
কুমিল্লার দেবিদ্বার থেকেই নির্বাচন করব: হাসনাত আবদুল্লাহ Nov 14, 2025
img
নোয়াখালীতে জামায়াত প্রার্থীর গণসংযোগ, যুবদলের হামলার অভিযোগ Nov 14, 2025
img
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের সাবেক নেতা আটক Nov 14, 2025
img
আর্জেন্টিনার অনুশীলনে স্পেনে বিশাল জনসমাগম, মেসির কৃতজ্ঞতা প্রকাশ Nov 14, 2025
img
ইমাম প্রশিক্ষণে সৌদি সরকারের সহায়তার আশ্বাস Nov 14, 2025
img
আজ থেকে শুরু খালেদা জিয়ার পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণা Nov 14, 2025
img
আমি ব্যর্থ হয়েছি, জোড় হাতে ক্ষমা চাইছি: শাওন Nov 14, 2025
img
দেশের ৪ বিভাগে নতুন কমিশনার Nov 14, 2025
img
আড়াইহাজারে বিএনপি-আওয়ামী লীগ দফায় দফায় সংঘর্ষে আহত ১৫ Nov 13, 2025
img
এই ফলাফলে খুশি নই, হতাশাজনক: ক্যাবরেরা Nov 13, 2025
img
আরো ১৪ জেলায় নতুন ডিসি Nov 13, 2025
img
ভারত ম্যাচের আগে হামজাকে নিয়ে দুঃসংবাদ Nov 13, 2025
img
প্রশাসন নিশ্চুপ থাকলে পরিস্থিতি আরও জটিল হবে: গয়েশ্বর Nov 13, 2025
img

অ্যাটর্নি জেনারেল

ধর্ম যার যার উৎসব সবার, এই বিশ্বাস থেকে বিজয়া পুনর্মিলনীতে এসেছি Nov 13, 2025
img
'দর্শকের উন্মাদনাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আমি প্রচুর স্বার্থত্যাগ করি' Nov 13, 2025