কনফুসিয়াস: মেষপালক থেকে বিখ্যাত দার্শনিক

কনফুসিয়াস ছিলেন একজন প্রাচীন চীনা শিক্ষাগুরু, রাজনীতিবিদ ও দার্শনিক। কনফুসিয়াস সেসব প্রভাবশালী দার্শনিকের একজন যারা তাদের দর্শনকে মহত্ত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, যা যুগ যুগ ধরে মানব জীবনের চলার পাথেয় হিসেবে ভূমিকা রাখছে। তার দর্শনের মূল ভিত্তি ছিল ব্যক্তি ও সরকারের নৈতিকতা, সামজিক সম্পর্কের সংশোধন, ন্যায়বিচার ও আন্তরিকতা। চীনাদের কাছে ‘মাস্টার কং’ নামে পরিচিত এই মহান দার্শনিক ভদ্রতা, পরিকল্পনা, শ্রদ্ধাবোধ, নৈতিকতা, সততা, ন্যায়পরায়ণতা ও দায়িত্ববোধকে সাধারণ অনুভূতি থেকে ভিন্নভাবে লালন করার শিক্ষা দিয়েছেন।

তিনি শিক্ষা দিয়েছেন যে, এই মুল্যবোধগুলোই একটি সুখী জীবন গড়ে তুলার একমাত্র পাথেয়। তার মতে সুপরিকল্পিত কাজ এবং অন্যদের সহযোগিতার মাধ্যমেই প্রকৃত সুখ পাওয়া যায়। তার দর্শনের মূল উদ্দেশ্যই ছিল কতিপয় লোককে সুবিধা না দিয়ে রাষ্ট্রের সবাইকে উপকৃত করা।

৫৫১ খ্রিস্টপূর্বে চীনের লু’ স্টেটে কনফুসিয়াসের জন্ম। তার বাবা ‘কং’ ছিলেন একজন সৈনিক। কনফুসিয়াসের তিন বছর বয়সেই তার বাবা মারা যান। এরপর থেকে মায়ের কাছে অত্যন্ত দারিদ্রতার মধ্য দিয়ে বড় হয়েছেন তিনি। তার পরিবার ছিল চীনের ‘শাই’ নামে এক মধ্যবিত্ত শ্রেণির পরিবার। এটা কোন অভিজাত পরিবার না হলেও কৃষকদের থেকে কিছুটা উপরে মর্যাদা দেয়া হত। আর এই শ্রেণিভেদ কনফুসিয়াসের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ লোক থেকে কিছুটা ভিন্ন ধারার চিন্তা জাগ্রত করে।

তিনি মনে করলেন যে, মানুষকে মর্যাদা দেয়া ও পুরস্কৃত করা উচিত তার মেধা দিয়ে, সে কোন পরিবারে জন্ম নিয়েছে তা দিয়ে নয়। কনফুসিয়াসের শৈশব সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা যায়নি। তবে তিনি তার কর্মজীবন শুরু করেছিলেন একজন মেষ পালক হিসেবে। পরে বুক কিপার ও ক্লার্কের কাজ করেছেন। ত্রিশ বছর বয়সে তিনি শিক্ষকতা শুরু করেন। তিনিই ছিলেন চীনের প্রথম কোন শিক্ষক যার লক্ষ্য ছিল সবার জন্য শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করা।

চল্লিশ বছর বয়সে তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। একসময় তিনি চীনা সরকারের নজরে পড়েন এবং লু’ স্টেট শহরের গভর্নর নিযুক্ত হন। পরবর্তীতে তিনি সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সেই সময় লু স্টেটের নেতৃত্বে ছিলেন একজন ডিউক যার অধীনে ছিল তিনটি অভিজাত পরিবার যারা সরকার নিয়ন্ত্রণ করত। কনফুসিয়াস এ ব্যবস্থার সংস্কার করে একটি কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। তিনি কিছুটা সফলও হয়েছিলেন, তবে পুরোপুরি সংস্কার করতে পারেননি। এরপর থেকে তার বেশ কিছু শত্রু তৈরি হয় এবং তিনি লু স্টেট ছেড়ে চলে যান।

কারো কারো মতে, সে সময় লু’ স্টেটকে প্রতিরোধ করতে পার্শ্ববর্তী রাজ্যের এক রাজা লু’ স্টেটের রাজাকে ১০০টি ঘোড়া ও ৮০ জন সুন্দরী রমণী উপহার দেয়। এটা পেয়ে রাজা চরম আনন্দ-উল্লাস ও বিলাসিতায় মত্ত হয়ে পড়েন। এর প্রতিবাদে কনফুসিয়াস রাজ্য ছেড়ে চলে যান। তিনি চীনের বিভিন্ন শহর ঘুরে বেড়াতে থাকেন এবং তার রাজনৈতিক চিন্তা ও দর্শন প্রচার করতে থাকেন।

তার প্রচারিত দর্শন কনফুসিয়ানিজম হিসেবে পরিচিত। কেউ কেউ এটাকে একটি ধর্মীয় আবার কেউ কেউ এটাকে ধর্মনিরপেক্ষ দর্শন হিসেবে বিবেচনা করেন। তার দর্শনে পরকাল ও স্বর্গের অস্তিত্ব স্বীকার করা হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে তার মতবাদ ধর্মীয় বিভিন্ন বিশ্বাস ও আচরণের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

তার দেয়া কনফুসিয়ানিজম আদর্শের কিছু উল্লেখযোগ্য দিক হলো
-অন্যদের সঙ্গে নম্রভাবে আচরণ কর।
-সু অভ্যাস গড়ে তুলুন এবং দৈনন্দিন কার্যপদ্ধতি মেনে চলুন।
-একজন ব্যক্তির উত্তম মূল্যবোধ ও নৈতিকতা থাকা উচিত।
-পরিবার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান যেখানে বাবা-মা, ভাই-বোন, পিতা-পুত্র, স্বামী-স্ত্রী, শিক্ষক-ছাত্র, দাস-মালিক ইত্যাদি প্রতিটি সামাজিক সম্পর্কে পারস্পরিক সম্মান ও শ্রাদ্ধাবোধ থাকতে হবে।
-প্রত্যেকের উচিত সবকিছুতে নতুনত্ব নিয়ে আসা।
-তিনি শক্তিশালী ও কেন্দ্রীয় সরকার ব্যবস্থায় বিশ্বাস করতেন।
-একজন ব্যক্তির যে গুনাবলী থাকা আবশ্যক তা হলো সততা, ন্যায়পরায়ণতা, পরার্থপরতা, ধার্মিকতা ও আনুগত্য।

৪৭৯ খ্রিস্টপূর্বে বার্ধক্যজনিত কারণে মারা যান এই মহান দার্শনিক। পরবর্তীতে কনফুসিয়াসের অনুসারীরা তার আদর্শকে ‘দ্য অ্যানালেক্টস অব কনফুসিয়াস’ গ্রন্থে তুলে ধরেছেন। হান রাজাদের শাসনামলে কনফুসিয়াসের শিক্ষা রাষ্ট্রীয় দর্শন হিসেবে বিবেচিত হত। তার দেয়া কর্তৃপক্ষের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার ব্যবস্থা আদর্শ হিসেবে এখনও চীনা সংস্কৃতি ও সরকার ব্যবস্থায় অনুসরণ করা হয়।

কনফুসিয়াসের কিছু বিখ্যাত উক্তি
“যখন তুমি কোন ভালো মানুষকে দেখ, তার মত হওয়ার চেষ্টা কর। আর যখন কোন খারাপ মানুষকে দেখবে, তখন তোমার নিজের দুর্বলতাগুলোর দিকে নজর দিবে।”

“যদি তুমি কোন কিছু সঠিক মনে কর, কিন্তু সেই অনুযায়ী কাজ করতে পার না, তবে তোমার সাহসিকাতার অভাব আছে।”

“তুমি নিজে যা করতে চাও না, অন্যকে তা করতে দিও না।”

“চিন্তা না করে কেবল অধ্যয়ন করা অনর্থক, তবে অধ্যয়ন না করে চিন্তা করা বিপজ্জনক।”

 


টাইমস/এএইচ/জিএস

Share this news on:

সর্বশেষ

জাকের ব্যর্থতায় ক্ষুব্ধ ইরফান সাজ্জাদের ভাইরাল পোস্ট Nov 01, 2025
রোহিতকে ছাড়িয়ে টি-টোয়েন্টির নতুন রাজা বাবর আজম Nov 01, 2025
img
রবি তেজার অ্যাকশন ও শ্রীলীলার গ্ল্যামারে উড়বে ‘মাস যাত্রা’ Nov 01, 2025
ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে আমরা ভালো ব্যাটিং করতে পারিনি : নাজমুল আবেদীন ফাহিম Nov 01, 2025
তারেক রহমানের জন্য দোয়া কামনা তামিম ইকবালের Nov 01, 2025
বিয়ের পর ভাইরাল রাসেল-ঐশীর প্রেমগাথা Nov 01, 2025
img
বিচারকদের বদলি-পদোন্নতির সুস্পষ্ট নীতিমালা করেছে অন্তর্বর্তী সরকার: আইন উপদেষ্টা Nov 01, 2025
বারান্দায় দাঁড়ালেই ছবি! ক্যাটরিনার প্রাইভেসিতে বড় আঘাত Nov 01, 2025
img
জাকির নায়েকের সম্ভাব্য সফর নিয়ে দিল্লির বক্তব্যে ঢাকার বার্তা Nov 01, 2025
জামায়াতকে নিষিদ্ধের দাবি বিএনপির আলালের Nov 01, 2025
কারাগার থেকে ক্যাম্পাস রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তন খাদিজার Nov 01, 2025
বাংলাদেশের নির্বাচনে আ.লীগকে রাখার প্রস্তাব দেবে ভারত? Nov 01, 2025
রকার একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে হেয় করার চেষ্টা করছে : মেজর হাফিজ Nov 01, 2025
সালমান শাহর আসামীরা কেন গ্রেফতার হচ্ছে না? Nov 01, 2025
img
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে যমুনায় বৈঠক করলেন তিন বাহিনীর প্রধান Nov 01, 2025
img
সম্পর্ক আরও মজবুত করতে ইরান-তুরস্কের নতুন উদ্যোগ Nov 01, 2025
রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে মন্তব্য করলেন গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক Nov 01, 2025
ইলিশের ভবিষ্যৎ বাঁচাতে এবার দীর্ঘ ৮ মাসের নিষেধাজ্ঞা Nov 01, 2025
ওমরাহ মৌসুমে কড়া বিধি; কমল ভিসা ব্যবহারের সময়সীমা Nov 01, 2025
img
সুুষ্ঠু নির্বাচন না হলে আন্দোলনের পর আন্দোলন, বিপ্লবের পর বিপ্লব হবে: শামীম হায়দার Nov 01, 2025