ঘূর্ণিঝড়কে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে চীন

ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়ের (টাইফুন) মাঝে টিকে থাকার পাশাপাশি তার শক্তিকেও কাজে লাগাতে নতুন প্রজন্মের উইন্ড ফার্ম নির্মাণে পুরোদমে কাজ করে যাচ্ছে চীন। পরিকল্পনা অনুযায়ী ইতিমধ্যে সাফল্যও পেতে শুরু করেছে তারা।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, দক্ষিণ চীনের গুয়াংদং প্রদেশের উপকূলে সমুদ্রের বুকে ইতিমধ্যে শত শত বিশাল উইন্ড টারবাইন দাঁড়িয়ে গেছে। যেগুলোর ঘূর্ণায়মান ব্লেড থেকে বাড়ি, কারখানা ও অফিসে প্রবাহিত হচ্ছে বিদ্যুৎ।

যার মধ্যে কিছু উইন্ড টারবাইন প্রায় ৩০ তলা ভবনের সমান উঁচু। এই বিশাল টাওয়ারগুলো চীনের সবুজ ভবিষ্যতের প্রতীক। বর্তমানে বিশ্বের মোট অফশোর (সমুদ্রে স্থাপিত) টারবাইনের প্রায় ১৫ শতাংশ রয়েছে শুধু গুয়াংদং উপকূলে। আগামী পাঁচ বছরে এই সংখ্যা দ্বিগুণ করার পরিকল্পনা নিয়েছে স্থানীয় সরকার।

কিন্তু এখানেই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ—প্রতি বছর চীনের উপকূলে আঘাত হানা টাইফুন। এই ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়গুলো ঘণ্টায় ১১৯ কিলোমিটার বা তার বেশি বেগে ছুটে আসে, ভেঙে দেয় ঘরবাড়ি, ডুবিয়ে দেয় শহর। গত সেপ্টেম্বরে আঘাত হানা টাইফুন ‘রাগাসা’ ছিল এ বছরের সবচেয়ে শক্তিশালী ঝড়—যার বেগ পৌঁছেছিল ঘণ্টায় ২৪১ কিলোমিটারে।

তবুও এই ঘূর্ণিঝড়প্রবণ উপকূলেই সবচেয়ে শক্তিশালী বায়ু প্রবাহ পাওয়া যায়।

তাই চ্যালেঞ্জ হলো—এমন টারবাইন বানানো, যা শুধু টাইফুনে বাঁচবে না, বরং এই ঝড়ের শক্তিকেও কাজে লাগাবে।

গুয়াংদং সরকারের সহায়তায় ইয়াংজিয়াং অফশোর উইন্ড এনার্জি ল্যাবরেটরির পরিচালক ঝু রংহুয়া বলেন, ‘টাইফুনের মুখে টিকে থাকা এবং আগত ঝড়ের শক্তি কাজে লাগানো—এই দুই-ই এখন অত্যন্ত জরুরি।’

চীন এখন টাইফুন-প্রতিরোধী টারবাইন প্রযুক্তিতে বিশ্বের শীর্ষে। গ্লোবাল উইন্ড এনার্জি কাউন্সিলের এশিয়া বিভাগের সাবেক কৌশলপ্রধান কিয়াও লিমিং বলেন, সমুদ্রের বায়ু শক্তিকেই চীন তার ‘ডুয়াল কার্বন’ লক্ষ্যের মূলভিত্তি করেছে।

এর মানে—২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছানো এবং ২০৬০ সালের মধ্যে কার্বন নিরপেক্ষ হওয়া।

চীনে জাতীয়ভাবে টাইফুনরোধী টার্বাইন তৈরির মানদণ্ড রয়েছে। মানদণ্ড অনুযায়ী, টারবাইনগুলো ১০ মিনিটের জন্য ১৯৮ কিমি/ঘণ্টা পর্যন্ত গতিবেগ সহ্য করতে পারবে। আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী (আইইসি) এই সীমা আরও বেশি—১০ মিনিটের জন্য গড় ২০৫ কিমি/ঘণ্টা এবং তাৎক্ষণিক ঝড়ো বেগ (৩ সেকেন্ড) ২৯০ কিমি/ঘণ্টা পর্যন্ত টার্বাইনগুলোর বাতাস সহ্য করতে হবে।

চীনের উইন্ড ফার্মগুলোকে টার্বাইনের ২৫ বছরের আয়ুষ্কালের মধ্যে গড়ে ১০০টির বেশি টাইফুন মোকাবেলা করতে হয়। ২০০৬ সালের সুপার টাইফুন ‘সাওমেই’ একাই ২৭টি টারবাইন ধ্বংস করে দিয়েছিল, যাতে ক্ষতি হয়েছিল প্রায় ৭০ মিলিয়ন ডলার।

টাইফুনের প্রভাবে টারবাইনের ব্লেড, টাওয়ার ও বেসসহ সবকিছুতেই ভয়াবহ চাপে পড়ে। তাই ঝড়ের আগে টারবাইনগুলো সাধারণত রিমোট কন্ট্রোলে বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে এখন অনেক টারবাইন স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজেই দিক বদলাতে বা ব্লেডের কোণ পরিবর্তন করতে পারে, যাতে ক্ষয়ক্ষতি কম হয়।

চীনা কম্পানি মিংইয়াং স্মার্ট এনার্জির তৈরি নতুন টারবাইন মডেল ‘ওশেনএক্স’ এখন আলোচনায়।

এই মডেলে ভাসমান ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা এক প্ল্যাটফর্মে একসঙ্গে দুটি টারবাইন ঘোরে। একটির ব্লেড ঘড়ির কাঁটার দিকে, অন্যটি উল্টো দিকে। এতে বায়ুর চাপ বেড়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন ৪ দশমিক ২৯ শতাংশ বেশি হয়।

টারবাইনের ভিত্তি সমুদ্রতলের সঙ্গে দড়ির মাধ্যমে যুক্ত, যা ঝড়ের দিক অনুযায়ী টারবাইনের অবস্থান সহজে বদলাতে সাহায্য করে। প্রকৌশলী ওয়াং চাও বলেন, ‘টারবাইন যদি সরাসরি টাইফুনের মুখোমুখি থাকে, তাহলে এর ওপর চাপ সবচেয়ে কম পড়ে এবং সেটি সবচেয়ে নিরাপদ থাকে।’

ওসিয়ানএক্সের ভিত্তি তৈরি হয়েছে ‘আল্ট্রা-হাই পারফরম্যান্স’ কংক্রিটে, যা সাধারণ কংক্রিটের চেয়ে চারগুণ শক্ত—প্রতি বর্গইঞ্চিতে ৭ হাজার ৫৩০ কেজি পর্যন্ত চাপ সহ্য করতে পারে।

২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে ইয়াংজিয়াং উপকূলে এটি স্থাপন করা হয়। কয়েক সপ্তাহ পরেই আঘাত হানে চীনের এক দশকের সবচেয়ে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় সুপার টাইফুন ‘ইয়াগি’। এই ঝড়ের মুখে ঘণ্টায় ১৩৩ কিমি বেগের বাতাসে স্থির থেকেছে ওশেনএক্স।

অন্যদিকে, গোল্ডউইন্ড কোম্পানির ৪৭টি টারবাইন ঘণ্টায় ১৬১ কিমি বেগের ঝড় সহ্য করে নয় ঘণ্টায় উৎপাদন করেছে ২ দশমিক ১ গিগাওয়াট/ঘণ্টা পরিমাণ বিদ্যুৎ। যা দিয়ে ২ হাজার ১০০ চীনা নাগরিকের এক বছরের বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণ করা সম্ভব।

বিশ্বজুড়ে বড় টারবাইন তৈরি যত বাড়ছে, ততই ঝুঁকি বাড়ছে। এদিকে, এ সমস্যা মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্রের কিছু গবেষক ‘পাম ট্রি’ বা খেজুর গাছ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ব্লেডের ডিজাইন করছেন—যেগুলো ঝড়ে ভাঁজ হয়ে চাপ কমাতে পারে। 

আইকে/টিকে

Share this news on:

সর্বশেষ

img
বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার বিএনপির ২ নেতার Nov 25, 2025
img
ঢাকায় ৬.৯ মাত্রার ভূমিকম্পে ৪০ শতাংশ ভবন ধসে পড়তে পারে : রাজউক Nov 25, 2025
img
কক্সবাজারে ৪০ হাজার ইয়াবাসহ নৌবাহিনীর ভুয়া সদস্য আটক Nov 25, 2025
img
২৩ মাস পর যমুনা সার কারখানায় গ্যাস সংযোগ Nov 25, 2025
img
রপ্তানি সহজ করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন নীতিমালা Nov 25, 2025
img
সালাহকে নিয়ে কঠিন সিদ্ধান্তের পরামর্শ ওয়েন রুনির Nov 25, 2025
সিন্ধু ভারতের অংশ হবে রাজনাথের এমন মন্তব্যে তীব্র নিন্দা পাকিস্তানে/র Nov 25, 2025
দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা ১৭ এনবিআর কর্মকর্তার Nov 25, 2025
ইউরোপের সবচেয়ে শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়ে তুলতে চায় জার্মানি Nov 25, 2025
img
১০ মাসে সাড়ে ২৮ লাখ কনটেইনার হ্যান্ডলিং করেছে চট্টগ্রাম বন্দর Nov 25, 2025
গণমাধ্যমকে অনেকভাবে চেপে ধরার চেষ্টা করা হয় Nov 25, 2025
চিকেনস নেক ঘিরে ভারতের উচ্চপর্যায়ের নিরাপত্তা বৈঠক Nov 25, 2025
সাংবাদিকদের একটি ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকা প্রয়োজন: মিলটন আনোয়ার Nov 25, 2025
পদত্যাগী বিচারকের মুখে মিস ইউনিভার্স বিতর্ক তুঙ্গে Nov 25, 2025
‘অ্যানিমেল’ সাফল্যের পর তৃপ্তি দিমরির নতুন চ্যালেঞ্জ Nov 25, 2025
সালাহকে বেঞ্চে বসানোর পরামর্শ রুনির Nov 25, 2025
img
‘এ’ ক্যাটাগরিতে স্থান পেল ৮১ সরকারি কলেজ Nov 25, 2025
img
শরীয়তপুরে নিরাপদ খাদ্য আইনে মামলা, দুই ব্যবসায়ীকে ৫ লাখ টাকা জরিমানা Nov 25, 2025
img
অ্যামাজন প্রাইমে রাজের ‘ওমর’ Nov 25, 2025
img
১৮ পদে বেতন কাঠামো পরিবর্তনের উদ্যোগ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের Nov 25, 2025