পাকিস্তানে বিতর্কিত ২৭তম সংবিধান সংশোধনীতে প্রেসিডেন্টের স্বাক্ষর

পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি বৃহস্পতিবার বিতর্কিত ২৭তম সাংবিধানিক সংশোধনীতে স্বাক্ষর করে তা আইনে পরিণত করেছেন। ডন পত্রিকার হাতে থাকা স্বাক্ষরিত সারাংশে বলা হয়েছে, ‘সংবিধান (সাতাশতম সংশোধনী) বিল, ২০২৫–এ প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক প্রদত্ত পরামর্শ অনুযায়ী সম্মতি প্রদান করা হলো।’

এদিকে ডনকে সূত্র জানিয়েছে, ২৭তম সংশোধনী বিল কার্যকর হওয়ার পর যে ফেডারেল সাংবিধানিক আদালত প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, তার প্রধান বিচারপতিকে আগামীকাল প্রেসিডেন্সিতে শপথ পড়াবেন বলে আশা করা হচ্ছে।

সিনেটের অনুমোদন

সিনেট দ্বিতীয়বার ভোটাভুটির মাধ্যমে সংশোধনীটি অনুমোদন করে, এর কয়েক ঘণ্টা পরেই বিলটিতে প্রেসিডেন্ট স্বাক্ষর করেন, যদিও বিরোধীরা তীব্র প্রতিবাদ জানায়।
ফলাফল ঘোষণা করে সিনেট চেয়ারম্যান ইউসুফ রেজা গিলানি জানান, বিলের পক্ষে ৬৪টি এবং বিপক্ষে ৪টি ভোট পড়েছে। 

তিনি বলেন, ‘সিনেটের মোট সদস্যসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশের কম নয় এমন ভোটে প্রস্তাবটি গৃহীত হয়েছে। ফলে বিলটি পাস হয়েছে।’ প্রথমে ধারাভিত্তিক ভোট হয়, এরপর বিভাজিত ভোটে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

ধারাভিত্তিক ভোট চলাকালে বিরোধীরা ‘আইনের ধ্বংস, নামঞ্জুর’ ইত্যাদি স্লোগান দিতে শুরু করলে গিলানি এক পর্যায়ে বলেন, ‘কোনো স্লোগান নয়।’

বিলটি প্রথম গত সোমবার সিনেটে উপস্থাপন ও পাস হয়। পরে এটি জাতীয় পরিষদে পাঠানো হয়। যেখানে কিছু সংশোধনীসহ তা অনুমোদিত হয়।
তাই সংশোধিত বিলটি পুনরায় সিনেটে পাঠানো হয় আজকের অধিবেশনে। আইনমন্ত্রী আজম নাজির তারার আবারও বিলটি সিনেটে উপস্থাপন করেন।

বিলের পরিবর্তনসমূহ ও প্রধান দিকগুলো ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘বর্তমান পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি (সিজেপি) তার মেয়াদকাল পর্যন্ত একই পদে থাকবেন। তিনি অবসর নিলে সুপ্রিম কোর্ট এবং নবগঠিত ফেডারেল সাংবিধানিক আদালতের সর্বোচ্চ পর্যায়ের বিচারকদের মধ্যে সিনিয়র ব্যক্তি সিজেপির দায়িত্ব পালন করবেন।’ তিনি আরো বলেন, ‘প্রস্তাবিত সংশোধন অনুযায়ী, সিজেপিই পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অডিটর জেনারেলকে শপথ পড়াবেন।’

রাষ্ট্রদ্রোহ সম্পর্কিত সংবিধানের ৬ অনুচ্ছেদে পরিবর্তনের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘সংশোধিত পাঠ অনুযায়ী পাকিস্তানের কোনো আদালত—ফেডারেল সাংবিধানিক আদালত, সুপ্রিম কোর্ট বা হাইকোর্ট—সংবিধান বাতিলের কোনো কর্মকে বৈধতা দিতে পারবে না।’ মন্ত্রী যুক্তি দেন, এটি কার্যত সামরিক শাসনের পথ রুদ্ধ করার এবং গণতন্ত্র রক্ষার ব্যবস্থা।

প্রস্তাবিত সংশোধনীর বিরোধিতা করে পিটিআই সিনেটর আলি জাফর সরকারের এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেন। তার অভিযোগ, ‘তারা দ্রুত নিজেদের সাংবিধানিক আদালত প্রতিষ্ঠা করতে চায়, যাতে সেটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। আর এই তাড়াহুড়োর কারণ হলো একজনকে ভয় করা, যিনি এখান থেকে কয়েক মাইল দূরের কারাগারে আছেন।’

তিনি আরো বলেন, ‘২৭তম সংশোধনী ‘প্রতারণা ও ছলনার’ ওপর ভিত্তি করে তৈরি এবং জনগণের সমর্থন নেই। এই সংশোধনীর ভিত্তিই ভুয়া, এই কাঠামো একসময় ভেঙে পড়বে।’

এই বিলের মাধ্যমে একটি ফেডারেল কনস্টিটিউশনাল কোর্ট গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে, পাশাপাশি সামরিক নেতৃত্ব কাঠামোয় পরিবর্তন আনার কথাও বলা হয়েছে। গতকাল জাতীয় সংসদে পাস হওয়ার পর পিটিআই চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার গোহর আলি খান তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, সংশোধনী দ্রুত পাস করানোর মাধ্যমে ‘আপনারা গণতন্ত্র ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতার নৌকা ডুবিয়ে দিয়েছেন।’

বিরোধী জোট তেহরিক তাহাফুজ আইনি-এ-পাকিস্তান প্রস্তাবিত এই সংশোধনীর বিরুদ্ধে সারাদেশে আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছে। তারা জনগণকে আহ্বান জানিয়েছে সংবিধানে এই ‘অত্যন্ত অন্ধকারাচ্ছন্ন ও বিপজ্জনক’ পরিবর্তনের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে। সাবেক ও বর্তমান বিচারপতি এবং আইনজীবীরাও সংশোধনীটির বিরোধিতা করেছেন, বিশেষ করে এটি সুপ্রিম কোর্টের ওপর যে প্রভাব ফেলবে তা উল্লেখ করে।

 বিতর্কিত বিল

২৬তম সংশোধনী পাস হওয়ার প্রায় এক বছর পর সরকার আবারও ২৭তম সংশোধনী আনতে এগোচ্ছে। ২০২৪ সালের অক্টোবরে মধ্যরাতের অধিবেশনে ২৬তম সংশোধনী সংসদে পাস হয়। 

পিটিআই অভিযোগ করে, তাদের সাতজন এমপিকে জোর করে তুলে নেওয়া হয়েছিল যাতে বিলের পক্ষে ভোট পাওয়া যায়। বিএনপি-মেংগলও অভিযোগ তোলে, তাদের দুইজন সিনেটরকে চাপ দেওয়া হয়েছিল যারা শেষ পর্যন্ত দলীয় নির্দেশ অমান্য করে সংশোধনীর পক্ষে ভোট দেন। এরপর কয়েক মাস ধরে ২৬তম সংশোধনী আদালতে বিতর্ক ও চ্যালেঞ্জের মুখে থাকলেও রাজধানীতে ২৭তম সংশোধনী আনার আলোচনা জোরালো হতে থাকে।

সরকার সত্যিই সংবিধানে নতুন পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে কি না—এই জল্পনা শেষ হয় নভেম্বর ৩ তারিখে, যখন বিলাওয়াল একটি পোস্টে জানান, প্রধানমন্ত্রী শাহবাজের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল তাদের দলের সমর্থন চেয়েছে। পরে প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ অন্য জোটসঙ্গীদের সঙ্গেও আলোচনা করেন সমর্থন নিশ্চিত করতে।

১১ নভেম্বর ফেডারেল মন্ত্রিসভার ভিডিও বৈঠকে বিল অনুমোদনের কয়েক ঘণ্টা পরই এটি সেনেটে তোলা হয়। এরপর এটি আইন ও বিচারবিষয়ক সংসদীয় কমিটির কাছে পাঠানো হয়, যারা পরদিনই খসড়ায় কিছু ক্ষুদ্র পরিবর্তন এনে অনুমোদন দেয়।

আইনমন্ত্রী ১০ নভেম্বর সেনেটে বিলটি ভোটের জন্য উপস্থাপন করেন। ৬৪ ভোটে এটি পাস হয়—দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। বিরোধীরা শোরগোল তুলে ওয়াকআউট করে। আশ্চর্যজনকভাবে বিরোধী শিবিরের দুই সদস্য দলীয় সিদ্ধান্ত ভেঙে এর পক্ষে ভোট দেন। ১২ নভেম্বর জাতীয় সংসদেও বিলটি পাস হয়, যেখানে মূলত পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতিকে কেন্দ্র করে কিছু সংশোধন যোগ করা হয়।

৩৩৬ সদস্যের জাতীয় সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ নিশ্চিত করতে ২২৪ ভোট প্রয়োজন ছিল। সরকার পেয়েছে ২৩৪ ভোট। জেইউআই-এফের চার সদস্য বিলের বিপক্ষে ভোট দেন। যদিও তাদের ১০ জন এমএনএ রয়েছে, উপস্থিত ছিলেন চারজন। পিটিআই সদস্যরা ওয়াকআউট করে পুরো প্রক্রিয়া বর্জন করেন। তবে নতুন পরিবর্তন যুক্ত হওয়ায় বিলটি আবার সেনেটে পাঠানো হয় এবং আজ সেটি চূড়ান্তভাবে অনুমোদিত হয়েছে।

সূত্র : ডন

আরপি/এসএন

Share this news on:

সর্বশেষ

img
নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা স্থিতিশীল রাখতে হবে: আইজিপি Dec 30, 2025
img
বুড়িগঙ্গার পানি নিয়ে আক্ষেপ মোশাররফ করিমের Dec 30, 2025
img
জকসু নির্বাচন আজ, ক্যাম্পাসে উৎসবের আমেজ Dec 30, 2025
img
ঢাকায় ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনে ১৬৪২ মামলা Dec 30, 2025
img
ইউটিউব ভিউয়ে শীর্ষে জোভান-তটিনীর নাটক Dec 30, 2025
img
সুষ্ঠু ভোট হলে ধানের শীষের বিজয় সুনিশ্চিত : শহিদুল ইসলাম বাবুল Dec 30, 2025
img
খালেদা জিয়া অত্যন্ত সংকটময় সময় অতিক্রম করছেন: ডা. জাহিদ Dec 30, 2025
img
তেলেঙ্গানায় ১০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগে সালমান খান ! Dec 30, 2025
img
খালেদা জিয়াকে দেখে হাসপাতাল ছাড়লেন তারেক রহমান Dec 30, 2025
img
২৩ পরিচালকের সঙ্গে ২৩ হিট, বলিউডে সালমানের অনন্য রেকর্ড Dec 30, 2025
img
১৪ ঘণ্টা পর ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটে ট্রেন চলাচল শুরু Dec 30, 2025
img
মনোনয়ন বঞ্চিত হয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হলেন ব্যারিস্টার মওদুদের স্ত্রী হাসনা Dec 30, 2025
img
অপারেশন ডেভিল হান্টে গ্রেপ্তার ৫৯১ জন Dec 30, 2025
img
‘দাদা গুলি করে দেই?’ বলে চালানো গুলিতে প্রাণ গেল আনসার সদস্যের Dec 30, 2025
img
নড়াইলের দুটি আসনে মনোনয়ন জমা দিলেন ২৪ প্রার্থী, স্বতন্ত্র ১১ জন Dec 30, 2025
img
দিনাজপুরের ৬টি আসনে মনোনয়ন দাখিল করলেন ৪৮ প্রার্থী Dec 30, 2025
img
প্রকৃতি ও মানুষের জন্য কাজ করা প্রতিষ্ঠানই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন Dec 30, 2025
img
হাদি হত্যার বিচারের দাবিতে মাদারীপুরে মহাসড়কে বিক্ষোভ Dec 30, 2025
img
জনগণের সেবা করাই এখন প্রধান কাজ, মনোনয়ন জমা দেয়ার পর বাবর Dec 30, 2025
img
এবার এনসিপির আরেক নেতার পদত্যাগ Dec 30, 2025