এ বছর ভারতের নতুন পাঠ্যপুস্তকে মোগল সম্রাট আকবর এবং মহীশূরের শাসক টিপু সুলতানের নাম থেকে ‘গ্রেট’ শব্দটি অপসারণ নিয়ে কংগ্রেস এবং বিজেপির মধ্যে বিরোধ থামেনি। কংগ্রেস নেতারা অভিযোগ করছেন, সরকার তাদের রাজনৈতিক স্বার্থে ইতিহাসকে সংকুচিত করে উপস্থাপনের চেষ্টা করছে।
জানা গেছে, পুরো দেশটিতে ২৪ হাজারের বেশি সিবিএসই স্কুলে এনসিইআরটি বই পৌঁছেছে। জাতীয় শিক্ষাবিষয়ক গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কাউন্সিল (এনসিইআরটি) যে পাঠ্যপুস্তক ছাপিয়েছে, সেখানে মোগল সম্রাট আকবর ও মহিশূরের শাসক টিপু সুলতানের নাম থেকে ‘গ্রেট’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়েছে।
কংগ্রেস বলছে, কিছু নির্দিষ্ট শাসককে বিজেপির অপছন্দ, বিশেষ করে মুঘল যুগের শাসকদের। কিন্তু বিজেপি এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) বলেছে, এই পরিবর্তনগুলো দীর্ঘদিনের প্রয়োজনীয় সংশোধনের অংশ।
কংগ্রেস সংসদ সদস্য ইমরান মাসুদ সরকারকে মনে করিয়ে দেন, আকবর এবং টিপু সুলতান ‘৭০০ বছর ধরে দেশ শাসন করেছিলেন। তারা মাত্র এক বা দুই দিন শাসন করেননি।
’ তিনি প্রশ্ন তোলেন, পদবি অপসারণ বা সংযোজনের অর্জন কী হবে?
তিনি তাদের সময়ে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘তাদের শাসনামলে জিডিপি ছিল ২৭ শতাংশ। ভারতকে সোনার পাখিও বলা হতো।’
মাসুদ ব্রিটিশদের (ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি) হাতে শেষ মোগল সম্রাটকে ফাঁসির সাজা দেওয়ার এবং তার সন্তানদের কঠোর শাস্তি পেতে দেখার অপমানের কথাও স্মরণ করিয়ে দেন। মাসুদ বলেন, ‘সেই (মোগল) শাসকদের বংশধরেরা এখন কলকাতার রাস্তায় বাসন ধুয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
আর যারা ব্রিটিশদের সেবা করেছেন, তারা বর্তমান সরকারের ক্ষমতায় বসে আছেন।’
বিদ্রূপের সুরে মাসুদ প্রশ্ন তোলেন, ‘কে রানি লক্ষ্মী বাঈয়ের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন? কেন তার বংশধরেরা বর্তমান সরকারের মন্ত্রীর পদে বসে আছেন? এটা নিয়ে কেন প্রশ্ন তোলা হয়নি?’
কংগ্রেস নেতা কে. মুরলীধরনও সংশোধনীর সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেন, ‘আকবর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির রাজা ছিলেন। তিনি হিন্দু ধর্মও গ্রহণ করেছিলেন।’ তিনি আরো বলেন, ‘টিপু সুলতান ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন।
এ কারণেই তাকে হত্যা করা হয়েছিল।’ তিনি যুক্তি দেন, উভয়ই মহান প্রশাসক ছিলেন। তাই কেন্দ্রীয় সরকারের এই মনোভাব ঠিক নয়।
উত্তরাখণ্ড কংগ্রেসের জ্যেষ্ঠ নেতা হরিশ রাওয়াত বলেন, (পাঠ্যপুস্তক থেকে) এসব বিষয় বাদ দেওয়া বৃহত্তর এক পরিকল্পনার অংশ। রাওয়াত সাংবাদিকদের আরো বলেন, ‘আমাদের এখন খেয়াল রাখতে হবে, বিজেপি আর কী কী বাদ দেয়।’ তিনি সতর্ক করে বলেন, ‘যদি তারা (বিজেপি) সুযোগ পায়, তারা অনেক কিছু সরিয়ে ফেলবে।’ তিনি ২০২৯ সালের জাতীয় নির্বাচনকে একটি টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে উপস্থাপন করে বলেন, পরিবর্তন ‘২০২৭ সাল থেকে শুরু হবে।’
শনিবার উগ্র হিন্দুত্ববাদী আরএসএস নেতা সুনীল আম্বেকর বলেন, ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তকে ‘অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে’। নাগপুরে অরেঞ্জ সিটি সাহিত্য উৎসবে বক্তৃতা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, তাদের পদবি সরানো হলেও, বই থেকে কাউকে সরানো হয়নি।’ তিনি বলেন, ‘ছাত্রদের তাদের নিষ্ঠুর কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানা উচিত।’
আরএসএসের আম্বেকর বলেন, ভারতের প্রাচীন জ্ঞান ও ঐতিহ্য আধুনিক জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ।
তিনি বলেন, ‘এনসিইআরটি ১৫টি শ্রেণির মধ্যে ১১টির পাঠ্যপুস্তক সংশোধন করেছে এবং আগামী বছর নবম, দশম ও দ্বাদশ শ্রেণির জন্য আরো পরিবর্তন আনা হবে। অনেক ভালো পরিবর্তন আনা হয়েছে, আরো অনেক কিছু করা যেতে পারে।’ এরপর তিনি বিতর্কের সূত্রপাতকারী লাইনটি উল্লেখ করেন, “এখন তাদের কাছে ‘আকবর দ্য গ্রেট’ থাকছে না এবং ‘টিপু সুলতান দ্য গ্রেট’ থাকছে না।” তিনি বলেন, সংশোধনগুলো প্রয়োজনীয়।
ভারতে পাঠ্যপুস্তকে মোগল আমল, স্বাধীনতাসংগ্রাম, সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদের ইতিহাস এবং বৈজ্ঞানিক অবদানসহ বিভিন্ন বিষয় বারবার পুনর্বিবেচনা ও সংশোধন করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে এনসিইআরটি বলেছে, কভিড-১৯-এর পর শিক্ষার্থীদের ওপর থেকে চাপ কমাতে ‘অতিরিক্ত’ এবং ‘অপ্রাসঙ্গিক’ বিষয়গুলো বাদ দিয়ে এসব পরিবর্তন আনা হয়েছে। এর সঙ্গে পাঠ্যপুস্তকের বা শিক্ষার মান কমে যাওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই।
কিন্তু ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গা এবং ১৯৯২ সালের বাবরি মসজিদ ধ্বংস পাঠ্যপুস্তক থেকে উধাও হয়ে গেছে, যা শাসক দলের জন্য রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল। গান্ধী হত্যা, উপজাতি বিদ্রোহ, দলিত ও মুসলিম সাহিত্য, এমনকি ডারউইনের বিবর্তনতত্ত্ব সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য অপসারণও পণ্ডিত এবং বিরোধীদের মধ্যে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
সূত্র : টেলিগ্রাফ ইন্ডিয়া
এবি/টিকে