ভারতের জাতীয় সঙ্গীত 'বন্দে মাতারম'-এর ১৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে দেশটির পার্লামেন্টে আলোচনায় কংগ্রেসের জেষ্ঠ নেতা প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ভদ্রা সরকারের তীব্র সমালোচনা করেছেন। তিনি অভিযোগ করেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী পশ্চিমবঙ্গের আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় থেকে মনোযোগ সরানোর জন্য এই বিতর্কটিকে সামনে আনছেন।
ওয়েনাডে থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য প্রিয়াঙ্কা গান্ধী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে ভারতের প্রথম প্রধানমন্তী জওহরলাল নেহেরুকে অকারণে সমালোচনার অভিযোগ তোলেন। তিনি পরামর্শ দেন, বিজেপি নেহেরুর প্রতি করা তাদের সব অপমান ও অভিযোগের একটি তালিকা তৈরি করুক এবং একটি নির্দিষ্ট সময় বরাদ্দ করে সেই বিষয়ে বিতর্ক শেষ করুক। তিনি বলেন, যে কাজের জন্য জনগণ আমাদের নির্বাচিত করেছেন, আসুন আমরা এই সংসদের মূল্যবান সময় সেই কাজের জন্য ব্যবহার করি।
তিনি প্রশ্ন তোলেন, কেন সংসদে 'বন্দে মাতারম' নিয়ে বিতর্কের প্রয়োজন রয়েছে, যখন এই গানটি দেশের প্রতিটি অংশে জীবন্ত।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী লোকসভায় তার ভাষণে অভিযোগ করেন, মুসলিম লীগের চাপের কাছে নতি স্বীকার করে কংগ্রেস 'বন্দে মাতরম'-এর সংস্করণকে কাটছাঁট করেছিল। মোদী বলেন, নেহেরু ১৯৩৭ সালে জিন্নাহর অবস্থান অনুসরণ করেছিলেন এবং দাবি করেছিলেন, এই স্তবকটি মুসলমানদের বিরক্ত করতে পারে।
মোদী মন্তব্য করেন, মুসলিম লীগের স্লোগানকে নিন্দা করার পরিবর্তে এবং বন্দে মাতারমের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের পরিবর্তে, তিনি (নেহেরু) জিন্নাহর সাথে একমত হয়ে নেতাজি সুভাষ বোসকে লিখেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন যে, আনন্দমঠ উপন্যাসের প্রেক্ষাপট মুসলমানদের বিরক্ত করতে পারে।
তিনি একে কংগ্রেসের ‘তোষণনীতির রাজনীতি’-র অংশ হিসেবে অভিহিত করে বলেন, এই মানসিকতাই দেশকে বিভাজনের দিকে নিয়ে গিয়েছিল।
প্রিয়াঙ্কা গান্ধী প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে ভুল ব্যাখ্যা হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেন, তার প্রপিতামহ নেহেরু 'বন্দে মাতারম' নিয়ে বিতর্ককে সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের দ্বারা সৃষ্ট বলে অভিহিত করেছিলেন।
নিজের যুক্তির সমর্থনে তিনি নেহেরু এবং বোসের চিঠি এবং পরে নেহেরু ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মধ্যে হওয়া চিঠিপত্রের প্রাসঙ্গিক অংশগুলো পড়ে শোনান। তিনি বলেন, জাতীয় সঙ্গীত নির্বাচনের ক্ষেত্রে যে ঘটনাগুলোর পরম্পরা ঘটেছিল, তা বোঝা জরুরি।
প্রিয়াঙ্কা বলেন, আমাকে সেই চিঠির একটি অংশ শেয়ার করতে দিন যেখানে গুরুদেব (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) বলছেন, যে দুটি স্তবক সব সময় গাওয়া হতো, সে দুটি এতই তাৎপর্যপূর্ণ ছিল যে তিনি সেগুলোকে কবিতা ও উপন্যাসের বাকি অংশ থেকে আলাদা করতে কোনো অসুবিধা বোধ করেননি। তিনি বলেছিলেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় সব সময় এই দুটি স্তবকই গাওয়া হতো এবং শত শত শহীদের আত্মত্যাগকে সম্মান জানাতে সেগুলোকে সেভাবেই গাওয়া উচিত। তিনি আরও বলেছিলেন, রে যুক্ত হওয়া স্তবকগুলোর সাম্প্রদায়িক ব্যাখ্যা হতে পারে এবং সেই সময়ের পরিবেশে তাদের ব্যবহার অনুপযুক্ত হবে। এরপরেই, ১৯৩৭ সালের ২৮ অক্টোবর কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি তাদের প্রস্তাবে 'বন্দে মাতরম'-কে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে ঘোষণা করে।
কংগ্রেস এবং তাদের কিছু মিত্র দলও অভিযোগ করেছে যে বিজেপি নেহেরুর মতামতকে বিকৃত করছে। ডিএমকে-র এ রাজা এই বিষয়ে একমত হন, নেহেরু সুভাষ বোসকে লেখা চিঠিতে বলেছিলেন যে 'বন্দে মাতরম'-এর বিরুদ্ধে জনগণের সাম্প্রদায়িক অংশের দ্বারা সৃষ্ট। তবে, একই সাথে নেহেরু মেনে নিয়েছিলেন, মানুষের কিছু অংশের অভিযোগে কিছু সারবত্তা ছিল।
ভারতের জাতীয় সঙ্গীত 'বন্দে মাতারম'-এর ১৫০ বছর পূর্তি পালিত হয় সাত নভেম্বর। 'বন্দে মাতারম' কথাটির অর্থ হলো ‘মা, আমি তোমাকে প্রণাম করি’।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত 'বন্দে মাতারম' প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সাহিত্য পত্রিকা বঙ্গদর্শন-এ। পরে ১৮৮২ সালে বঙ্কিমচন্দ্র এটি তাঁর কালজয়ী উপন্যাস ‘আনন্দমঠ’-এ অন্তর্ভুক্ত করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সুরে এই গানটি স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় জাতীয়তাবাদীদের যুদ্ধধ্বনিতে পরিণত হয় এবং পরে দেশের সাংস্কৃতিক চেতনার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে।
টিজে/টিকে