জামায়াতে ইসলামীকে বার বার ‘ফান্দে পড়া বগা’র অবস্থায় পড়তে হয়েছে। ডিসেম্বর মাসের ‘আনলাকি থারটিন’ এ এবং হিন্দু ধর্মমতে যে শনিবারকে অশুভ বিবেচনা করে ‘শনির ভর’ থেকে বাঁচার জন্য যে দিন শনিদেবের আরাধনা করা হয়, তেমনি একটি দিনে মুক্তিযোদ্ধা মেজর (অব:) আখতারুজ্জামানের জামায়াতে যোগদান কোনোমতে কোমর সোজা করে দাঁড়ানো জামায়াতকে নতুন কোনো ফান্দে ফেলার চাল কিনা; অথবা ‘আল্লাহর আইন’ দাবিকারী ‘সৎ মানুষের’ দল জামায়াত এমন ভেবে বগল বাজাচ্ছে কিনা যে, তারাই মেজর আখতারকে ফান্দে ফেলতে সক্ষম হয়েছে, তা নিয়ে আমার এবং অনেকের সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। কারণ আমার কাছে তার জামায়াতে যোগদানের মুখ্য উদ্দেশ্য কিশোরগঞ্জ-২ আসনে জামায়াতের মনোনয়ন লাভ।
একজন সাংবাদিক হিসেবে মেজর আখতারের রাজনীতি ও চলন-বলন সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতা বলে যে, তিনি গ্রামে প্রচলিত “দু’দেল বান্দা কলেমা চোর, না পায় বেহেশত, না পায় গোর” প্রবাদের মতো। বিএনপি কী তাকে বিনা কারণে দল থেকে বহিস্কার করেছে এবং তিনি কী বিনা কারণে জামায়াতে যোগ দিয়েছেন? কবিগুরু বলেছেন: “দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে, যাবে না ফিরে ---।” মেজর আখতার তো রাসুল সা: এর যুগের উমর আ: নন, যে বোনকে খুন করার উদ্দেশ্যে গিয়ে বোনের মুখে কুরআনের তিলাওয়াত শুনে ইসলাম কবুলের মিছালের মতো জামায়াতকে কবুল করেছেন!
এখন ঘোর কলিযুগ এবং শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, “কলিযুগে সৎ কর্ম বলে কিছু থাকবে না, মানুষ হবে মিথ্যাবাদী ও স্বার্থপর। মানুষের দেওয়া প্রতিশ্রুতি আর কাজের মধ্যে কোন মিল থাকবে না এবং কলিযুগে মানুষের ভালোবাসা হবে স্বার্থ ও অর্থকেন্দ্রিক।”
এ ঘটনায় আবারও আমার মনে হয়েছে, ৮৫ বছর বয়সেও জামায়াতে ইসলামী রাজনৈতিক বালেগ হতে পারেনি। আমার লেখালেখির সঙ্গে যাদের যৎকিঞ্চিত পরিচয় আছে, তারা সবাই কমবেশি জানেন, একজন রাজনৈতিক দর্শক বা পর্যবেক্ষক হিসেবে জামায়াতের অনেক সিদ্ধান্তের যথার্থতা নিয়ে আমি সংশয় ব্যক্ত করি। কারণ, দলটির ‘জীবনের পাতায় পাতায় যা লেখা’ তা ভুলে ভুলে ভরা।
তবে হ্যাঁ, খুলনা-১ আসনে হিন্দু ধর্মাবলম্বী কৃষ্ণ নন্দীকে মনোনয়ন দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে জামায়াত প্রথমবারের মতো বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছে। আমি বরাবর বিশ্বাস করি, যেকোনো ধর্মে বিশ্বাসী ব্যক্তি যদি ব্যক্তিগতভাবে সৎ হন, তার নিজের ধর্মের প্রতি নিষ্ঠাবান হন, তাহলে অন্যের ধর্মের প্রতিও তিনি শ্রদ্ধাশীল হবেন, তিনি কখনও অসৎ হতে পারবেন না এবং সবার ভালো ছাড়া কারও অকল্যাণ চিন্তা করবেন না।
মেজর আখতারুজ্জামান অতীতে জামায়াতের কঠোর সমালোচনা করেছেন। সহসা তিনি জামায়াতের “নীতি ও আদর্শের ওপর আস্থা স্থাপন, দলটির দেশপ্রেম এবং দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় অবিচল অবস্থানের” কারণে সন্তুষ্ট হয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে দলের প্রাথমিক সহযোগী সদস্য ফরম পূরণ করেছেন। তিনি এসময় তার সিদ্ধান্তও ঘোষণা করেছেন যে, জীবনের বাকি দিনগুলো তিনি ইসলাম ও ইসলামী মূল্যবোধ, দেশের স্বার্থ এবং স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় নিবেদিতপ্রাণ থাকবেন। জামায়াতের আদর্শ, নিয়মরীতি, দলীয় শৃঙ্খলা পালন এবং আনুগত্য প্রদর্শনের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন। মাশাআল্লাহ!
মানুষের এ ধরনের প্রতিশ্রুতির ওপর আমার আদৌ কোনো বিশ্বাস নেই। মানবচিত্ত বড়ই অস্থির, চঞ্চল ও সদা-পরিবর্তরশীল। আমি দেখার অপেক্ষায় থাকবো যে, মেজর আখতারের চিত্ত পরিবর্তন কী প্রকৃত, নাকি মনোনয়নজনিত? এ জীবনে দেখা তো আর কম হলো না।
বিদ্রোহী কবির “দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি, তাই যাহা আসে কই মুখে,” লাইনটি দিয়ে শেষ করছি। আমিন! ‘সব্বে সত্তা সুখিতা ভবন্তু!’ জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক।