‘যে প্রেমে জাত যায় না’

‘জাত গেল, জাত গেল বলে, একি আজব কারখানা। সত্য কাজে কেউ নয় রাজি, সবই দেখি তানা না না।’ সাধক লালন ফকিরের এই গানের কলি আমরা তো অনেক শুনেছি। কিন্তু কেউ কি এর মর্মার্থ বুঝার চেষ্টা করেছি কোনো কালে? আচ্ছা বাদ দেন লালন ফকির।

নজরুলে আসি। ‘গাহি সাম্যের গান, যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান, যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রীশ্চান। গাহি সাম্যের গান! বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলের সাম্যবাদী কবিতাটি আমরা মুখস্থ করে কতই না গলা উঁচু করি। কতই না ঢেঁকুর তুলি কৃতিত্বের। কিন্তু কোনো দিন কি ভেবেছি এই নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, লালন ফকিররা কি বলতে চেয়েছেন?

হয়তো আমরা শুনেছি গান, পড়েছি কবিতা-উপন্যাস। কিন্তু সেই গান, কবিতার বার্তা কি করেছি জীবনের দর্শন? আচ্ছা, গান কবিতা বাদ দিলাম।

কোন ধর্মেই কি বৈধ হয়েছে সহিংসতা, হিংসা বা খুনের উৎসব? তবুও কেন এত ভেদাভেদ, কেন এত বোরখা-শাঁখা সিঁদুরে বিভেদ?

আমরা কি এমন হতে পারি না? যেমনটি ঘটেছে লিয়াকত হোসেন লেলিন নামে ব্যক্তির সামনে, এক চলন্ত ট্রেনে? যা তিনি লিখেছেন তার ফেসবুক ওয়ালে। চলুন দেখি কি ঘটেছিল সেই রাতে ...

‘ঘড়িতে তখন রাত ৩টা। চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা তুর্ণানিশি ট্রেন ততক্ষণে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পেরিয়ে ঢাকার পথে। কিন্তু চলন্ত ট্রেনের এই দীর্ঘ যাত্রায় আমার ঘুমাতুর চোখে হঠাৎ ঘুমের ঘোর কেটে গিয়ে আনন্দ অশ্রু। বুকের ভেতরটা আনন্দের জলে চুপচুপে হয়ে আছে। সামনে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি তাই মনের ভেতরে জমিয়ে রাখার সঙ্গে সঙ্গে মোবাইলের ক্যামেরাতেও বন্দি করলাম। লোভ সামলাতে না পেরে ফোন ক্যামেরায় ধারণ করি এই স্থির চিত্রটা।

ছবিতে জায়গা পাওয়া কয়েকজনের সঙ্গে চলুন পরিচিত হই আগে। আলতো গোলাপি রঙের ছোঁয়া সম্বরিত শার্ট পরিহিত একজন মধ্যবয়স্ক পুরুষ ঘুমিয়ে আছেন। তার পাশেই ঘুমে ঢুলুঢুলু আপাদমস্তক বোরখা পরিহিতা এক নারী। এই নারীর কোলে পরম মমতায় ঘুমিয়ে আছে ২/৩ বছরের এক শিশু।

এই শিশুটি কার জানেন? হাতে শাঁখা ও কপালে সিঁদুর পরিহিতা এক নারী ওই শিশুর মা। হিন্দু ওই নারী ট্রেনে সিট না পেয়ে পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন।

হিন্দু মহিলাটি তার পরিবারসহ কুমিল্লায় উঠেছেন। ট্রেনের সিট না পেয়ে তিনি নিজের শিশু সন্তানকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। কিন্তু একটা বাচ্চাকে নিয়ে মায়ের এভাবে দাঁড়িয়ে থাকা দেখে বোরখা পরিহিতা মহিলাটি থেমে থাকতে পারেননি। তিনি দুহাত বাড়িয়ে শিশুটিকে তার মায়ের কোল থেকে নিয়ে নিজের কোলে রেখে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন। মাতৃত্বের পরম আদরে শিশুকে তিনি আগলে রাখলেন নিজের কোলে।

হিন্দু বাবা-মা তখন দাঁড়িয়ে ঘুমে বিভোর সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন। আর বোরখা পরা মহিলাটি ওই বাচ্চাকে কোলে নিয়ে বসে থাকলেন।

এর কিছু পরেই ঘটলো আরেক ঘটনা। হিন্দু পরিবারটির ১০/১১ বছরের একটি মেয়েকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বোরখা পরিহিতা মহিলাটি তার ব্যাগ সরিয়ে সামনে টেবিল ফাঁকা করে দিলেন। এরপর ইশারায় ওই শিশুকে টেবিলের ওপর বসার অনুমতি দিলেন। শিশুদের বাবা-মা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। সন্তানদের একটু সুখ বা আরাম বাবা মায়ের জন্য তো পরম আনন্দেরই। তাই নয় কি?

ওপরের ঘটনাটির হয়তো কোন বিশেষত্ব নেই। হয়তো এটা নতুন কিছু না। কিন্তু তারপরও এটাই মানবতা। কারণ এখানে হিন্দুর সন্তান মুসলিমের কোলে ঘুমোলেও কারো জাত যায়নি। শাঁখা সিঁদুর পরা মহিলার হাত স্পর্শ করেও মুসলিম মহিলার কোন পাপ হয়নি।

কারণ এটাই মানবধর্ম। এই আচার, এই সংস্কারই আমাদের গর্ব। এই যে মানবতা, এই যে ছোট ছোট সম্প্রীতি সমাজে ছড়িয়ে আছে, তাতেই টিকে আছে ধর্ম। এই সংস্কারেই বেঁচে আছে মানবতা। আর এভাবেই যুগে যুগে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ। কারণ ‘এই প্রেমে কারো জাত যায় না’।

 

টাইমস/এসএন/এইচইউ

Share this news on: