জেনে নিন, করোনাভাইরাস নিয়ে প্রচলিত কিছু দাবি

করোনাভাইরাস বিশ্বজুড়ে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে বাজারেও বেড়ে গেছে ফেসমাস্কের দাম। প্রথম থেকে ডাক্তার ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা দাবি করে আসছেন যে, করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা হিসেবে ব্যাপক জনসমাগম হয় এমন স্থানে মাস্ক ব্যবহার করা উচিত।

তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভাইরাস নিয়ে বিভিন্ন গুজব ছড়িয়ে পড়ছে। নানা বিষয়ে কথা বলা হচ্ছে, যার অনেকগুলি সত্য নয়। যেমন অনেকে বলছেন- ফেসমাস্ক কাজের নয়, এটি ব্যবহারের প্রয়োজন নেই। আবার কেউ কেউ বলছেন, ফেসমাস্ক ব্যবহার করলে সংক্রামিত হবার ঝুঁকি কম। এতে স্বভাবতই মানুষের মনে নানা প্রশ্ন জাগে।

চলুন করোনাভাইরাস সম্পর্কে প্রচলিত কিছু দাবি সম্পর্কে জেনে নিই-

প্রচলিত দাবি : ফেসমাস্ক কোনো কাজের নয়
ফেসমাস্ক পরিধান করলেই আপনি কোভিড-১৯’এ আক্রান্ত হবেন না এমন কোনো নিশ্চিত গ্যারান্টি নেই। ভাইরাসটি চোখ দিয়েও দেহে প্রবেশ করতে পারে। অ্যারোসোল হিসেবে পরিচিত ক্ষুদ্রতম ভাইরাসকণা অনেক সময় ফেসমাস্কের বাঁধা পেরিয়েও সঞ্চারিত হতে পারে।

যাইহোক, ফেসমাস্ক ভাইরাসটি সঞ্চারণের প্রধান মাধ্যম ‘সংক্রামিত ক্ষুদ্র জলকণা’ ভালোভাবেই আটকাতে সক্ষম। তাই অনুমান করা হচ্ছে যে, মাস্ক ব্যবহার করলে অন্তত পাঁচগুণ বেশি সুরক্ষা পাওয়া যাবে। তবে, অনেকেই বলছেন মাস্ক ব্যবহারে এতো বেশি সুরক্ষা পাওয়া যাবে না।

আপনার যদি সংক্রামিত কারো সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তবে ফেসমাস্ক ভাইরাস সংক্রামিত হওয়ার সম্ভাবনা হ্রাস করে। আপনার যদি করোনাভাইরাস সম্পর্কিত লক্ষণ দেখা দেয়, তবে মুখোশ পরলে তা অন্যদেরও সুরক্ষা দেবে। সুতরাং রোগীদের দেখাশোনা করা স্বাস্থ্য ও সমাজসেবা কর্মীদের জন্য ফেসমাস্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরিবারের যেসব সদস্য সংক্রামিত ব্যক্তির দেখাশুনা করছেন, তাদেরকেও মাস্ক পরিধানের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।

তবে, যদি আপনি কেবল শহরে ঘুরে বেড়ান বা বাসে যাতায়াত করেন সেক্ষেত্রে মাস্ক খুব একটা কাজে লাগবে না। সুতরাং মাস্ক কিনে স্টক গড়ার প্রয়োজন নেই।

প্রচলিত দাবি : ভাইরাসটি আরও মারাত্মক স্ট্রেনে রূপান্তরিত হচ্ছে
সব ভাইরাস সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে বদলে নেয়, পরিবর্তিত করে বা মিউটেশন ঘটায়, নোভেল করোনাভাইরাসটির ক্ষেত্রেও কথাটি সত্যি। ভাইরাসের বিভিন্ন স্ট্রেন কীভাবে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পরে তা মূলত প্রকৃতির উপর নির্ভর করে। ভাইরাসের যেসব সংস্করণ শরীরে দ্রুততম সময়ে বিস্তার ঘটাতে ও কার্যকরভাবে প্রতিরূপ তৈরি করতে পারে সেগুলি সবচেয়ে বেশি সফল হয়। এর অর্থ এটা নয় যে ভাইরাসটি নিজেকে দ্রুত ছড়িয়ে দিতে পারলেই সেটি বেশি মারাত্মক হবে। কারণ, এমন অনেক ভাইরাস আছে যেগুলি মানুষকে দ্রুত হত্যা করে বা খুব বেশি অসুস্থ করে তোলে সেগুলির সংক্রামণের ক্ষমতা তুলনামূলক কম।

চীনা বিজ্ঞানীরা উহানসহ অন্যান্য শহরের রোগীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা ভাইরাসের ১০৩ টি নমুনার জিনগত বিশ্লেষণ করেছেন। এ থেকে জানা যায় যে, প্রাথমিকভাবে দুটি প্রধান স্ট্রেন উদ্ভূত হয়েছিল, এগুলিকে ‌‘এল’ ও ‘এস’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যদিও ‘এল’ স্ট্রেনটি ‘এস’ স্ট্রেনের চেয়ে বেশি বিস্তার লাভ করছে (নমুনাগুলির প্রায় ৭০ শতাংশ ‘এল’ স্টেন), তবে ভাইরাসের ‘এস’ স্টেনটিকে আদি সংস্করণ হিসেবে মনে করা হচ্ছে।

এই গবেষণা দলটির মতে, ‘এল’ স্ট্রেনটি আরও আক্রমণাত্মক হতে পারে, এটি সহজেই সংক্রমণ করে বা দেহের অভ্যন্তরে দ্রুত প্রতিলিপি তৈরি করে। যাইহোক, তত্ত্বটি এই পর্যায়ে অনুমানমূলক।

প্রচলিত দাবি : এটি শীতের ফ্লু’র থেকে বেশি মারাত্মক নয়
করোনাভাইরাস আক্রান্ত অনেকেই মৌসুমি ফ্লু’র লক্ষণগুলির চেয়ে বেশি কিছু অনুভব করেন না, তবে রোগটিতে মৃত্যুর হার এবং এর সামগ্রিক প্রোফাইল গুরুতর। প্রাদুর্ভাবের শুরুতে যদি মৃদু সংক্রামিত ঘটনাগুলি বাদ পরে থাকে তবে অকালে মৃত্যুর হার অতিমাত্রায় বিবেচনা করা হয়ে থাকতে পারে।

তবে চলতি সপ্তাহে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একজন বিশেষজ্ঞ বলেছেন, কোভিড-১৯ এর ক্ষেত্রে এমনটি ঘটেনি। ব্রুস আয়েলওয়ার্ড, যিনি এই আন্তর্জাতিক ভাইরাস এবং চীনের প্রতিক্রিয়া জানতে সেদেশে একটি আন্তর্জাতিক মিশনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তিনি বলেছেন যে, প্রাপ্ত প্রমাণ সমূহ থেকে বোঝা যায়, আমরা কেবল আইসবার্গের চূড়া দেখছি ব্যাপারটি এরকম নয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষার দ্বারা নিশ্চিত করে বলা যেতে পারে যে ১% মৃত্যু হারের হিসাবটি সঠিক। এটি সঠিক হলে কোভিড-১৯ মৌসুমি ফ্লুর চেয়ে প্রায় ১০ গুণ বেশি মারাত্মক হিসেবে বিবেচিত হবে। অর্থাৎ এই ভাইরাসটির সংক্রামণে বিশ্বব্যাপী এক বছরে ২৯০,০০০ থেকে ৬,৫০,০০০ মানুষ মারা যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

প্রচলিত দাবি : এটি কেবল বয়স্কদের সংক্রামিত করে, তাই অল্প বয়স্ক লোকেরা নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন
বলা হচ্ছে, যারা বেশি বয়স্ক নয় এবং অন্তর্নিহিত স্বাস্থ্য জটিলতায় ভুগছেন না তারা ভাইরাসটিতে গুরুতর অসুস্থ হবেন না। তবে এই রোগটিতে এখনো মৌসুমি ফ্লুর চেয়েও গুরুতর শ্বাসকষ্টের লক্ষণ দেখা দেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়াও অন্যান্য ঝুঁকিও বেশি, উদাহরণস্বরূপ, স্বাস্থ্য কর্মীরা আরও মারাত্মক ঝুঁকিতে আছেন। কারণ তাদেরও উচ্চহারে ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। শিশু থেকে বৃদ্ধ যে কেউ ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হতে পারেন। তাই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ মেনে চললে তা সবাইকে নিরাপদ থাকতে সহায়তা করবে।

প্রচলিত দাবি : আপনি চাইলে ১০ মিনিট পর্যন্ত সংক্রামিত ব্যক্তির কাছে থাকতে পারেন
ফ্লু’র ক্ষেত্রে কিছু কিছু হাসপাতালের গাইডলাইন অনুযায়ী সংক্রামিত ব্যক্তির ছয় ফুটের মধ্যে থাকলে ভাইরাসে আক্রান্ত হবার ঝুঁকি থাকে বলে মনে করা হয়। তবে, সংক্ষিপ্ত সংস্পর্শে বা সরাসরি রোগীর সংস্পর্শে না এসেও দূষিত পৃষ্ঠ থেকে নতুন করোনাভাইরাসে সংক্রামিত হবার সম্ভাবনা রয়েছে।

প্রচলিত দাবি : কয়েক মাসের মধ্যে একটি ভ্যাকসিন প্রস্তুত হতে পারে
বিজ্ঞানীরা নতুন করোনাভাইরাসটির বিরুদ্ধে কার্যকর একটি ভ্যাকসিন তৈরির প্রাথমিক ধাপ পেরিয়ে গেছেন। চীনা গবেষকদের প্রকাশিত ভাইরাসটির জেনেটিক সিকোয়েন্স এক্ষেত্রে সহায়তা করেছে। একটি টেকসই ভ্যাকসিনের বিকাশ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। গবেষকরা এখন প্রাণীদেহে তাদের ভ্যাকসিন পরীক্ষা করে দেখছেন। তবে, বাণিজ্যিকভাবে ভ্যাকসিনটি উৎপাদনের আগে এখনো আরও অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা দরকার, যা একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। বাণিজ্যিকভাবে ভ্যাকসিনটি উপলব্ধ হতে কম করে হলেও এক বছরের মতো লেগে যেতে পারে। তথ্যসূত্র: দ্যা গার্ডিয়ান (ইউকে)

 

টাইমস/এনজে/জিএস

Share this news on:

সর্বশেষ

img
নির্বাচনে অনিয়ম নিয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিচ্ছেন নুরুল হুদা Jul 01, 2025
img
একদিনে আরও ১৩ জনের করোনা শনাক্ত Jul 01, 2025
img
জুলাই বিক্রি হয়ে গেছে : আবু ত্ব-হা আদনান Jul 01, 2025
img
একদিনে দেশে আরও ৩৮৬ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত Jul 01, 2025
img
‘আমার ব্যক্তিগত জায়গায় অনুপ্রবেশ করতে দিতে চাই না’ Jul 01, 2025
img
এবার আমরা নতুন দেশ গড়ার আন্দোলনে নেমেছি : নাহিদ ইসলাম Jul 01, 2025
img
'ইরানের শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কর্মসূচি জাতীয় মর্যাদার অংশে পরিণত হয়েছে' Jul 01, 2025
img
দুঃখ প্রকাশ না করা পর্যন্ত আওয়ামী লীগ শান্তি পাবে না: প্রেস সচিব Jul 01, 2025
img
‘কেউ আমাকে অভিনয়ের জন্য ডাকছেন না’ Jul 01, 2025
img
ফের আলোচনায় শহীদ আবু সাঈদের সেই ফেসবুক পোস্ট Jul 01, 2025
img
মুজিববাদী সংবিধান ফেলে নতুন এক সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে : আখতার Jul 01, 2025
img
ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক করতে ওয়াশিংটন যাচ্ছেন নেতানিয়াহু Jul 01, 2025
img
গত অর্থবছরে অনলাইনে রিটার্ন দাখিল করেছেন ১৭ লাখের বেশি করদাতা Jul 01, 2025
img
অস্ট্রেলিয়ায় চার-দলীয় সিরিজে অংশ নিবে বাংলাদেশ Jul 01, 2025
img
এনবিআরের আরও ৫ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান শুরু Jul 01, 2025
img
নির্বাচনে অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রে কোনো কার্পণ্য করা হবে না : অর্থ উপদেষ্টা Jul 01, 2025
img
সরাসরি নগর স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম পরিচালনা করবে ডিএনসিসি Jul 01, 2025
img
উপদেষ্টা পরিষদ পুনর্গঠনের দাবি জানালেন নুর Jul 01, 2025
img
সেই একান্ত বৈঠকে কী বলেছিলেন প্রধান উপদেষ্টা, প্রকাশ করলেন সিইসি Jul 01, 2025
img
জুলাই নিয়ে আওয়ামী লীগের লোকজনের জ্বালা শুরু হয়েছে: ইলিয়াস হোসাইন Jul 01, 2025