করোনাভাইরাসের মহামারী ছড়িয়ে পড়ার ফলে ইতিমধ্যে গৃহবন্দী হয়ে পড়েছেন বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় দুই পঞ্চমাংশ, বুধবার পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় সাড়ে আট লাখ। এই পরিস্থিতিতে সব থেকে বেশি ঝুঁকিতে আমাদের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি; বিশ্বের আপামর শ্রমিক শ্রেণী, খেটে খাওয়া দিনমজুর আর স্বল্প আয়ের লোকজন।
দেশে দেশে কল কারখানাগুলি বন্ধ হয়ে পড়ছে, খেটে খাওয়া মানুষের আয়ের পথ রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্র কর্তৃক ঘোষিত গৃহবন্দীর ফলে ঘরে আটকে থাকতে হচ্ছে দিন এনে দিন খাওয়া এসব লোকের। যারা দিন শেষে কষ্টার্জিত টাকা দিয়ে পরের দিনের বাজার করে বাড়ি ফেরেন, আর বাড়ি ফিরেও যাদের ভাবতে হয় একদিন পরের খাবার কিভাবে কোত্থেকে যোগার হবে, তাদের পক্ষে ঘরে বসে থাকাটা করোনার থেকে কোনো অংশেই কম ভয়ানক নয়।
পত্রিকা খুললেই আমরা দেখতে পাচ্ছি করোনা পরিস্থিতিতে ইতিমধ্যেই দেশের খেটে খাওয়া লোকেরা কতটা বিপাকে পড়েছেন। বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক সংস্থাটির ওয়েব সাইটে প্রকাশিত এক ভিডিও বার্তায় বলেছেন- বিদেশী ক্রেতাদের অর্ডার বাতিলের ফলে ইতিমধ্যে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন প্রায় ১২ লাখ পোশাক কারখানা শ্রমিক। এভাবে চলতে থাকলে পোশাক শিল্পের সঙ্গে যুক্ত প্রায় ৪১ লাখ শ্রমিককে বেকার হয়ে রাস্তায় নামতে হবে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তিনি।
সোমবার (৩০মার্চ) পর্যন্ত দেশের ৩৫০টি তৈরি পোশাক কারখানার অর্ডার বাতিল হয়েছে, স্থগিত করা হয়েছে আরও অনেক অর্ডার। শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন কারখানা মালিকরা। এতো শুধু পোশাক কারখানার হিসাব, এছাড়াও আরও বহু কারখানা শ্রমিকের বেতন-ভাতা আটকে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে। বিশ্বজুড়ে মহামারীর ফলে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে বিভিন্ন ভোগ্যপণ্যের চাহিদা ক্রমেই নিম্নমুখী। তাছাড়াও যারা রিক্সা চালায় কিংবা চানাচুর-ঝালমুড়ি-ফুচকা বিক্রি করে, পরিবহণের সঙ্গে যুক্ত অথবা দোকানে কাজ করেন, এমন বহু শ্রমিক কর্মহীন হয়ে ঘরে বসে আছেন।
বিশ্ব ব্যাংকের হিসাব বলছে, করোনার কারণে শুধু চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে গেলে পূর্ব এশিয়াতেই আরও এক কোটি দশ লাখ লোক গরীব হয়ে পড়বে। ফেডারেল রিজার্ভের হিসাব অনুযায়ী, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে পর থেকে গত কয়েক সপ্তায় শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই বেকার ভাতার জন্য আবেদন করেছেন ৩৩ লাখ মানুষ। গবেষণা বলছে, করোনার ফলে দেশটিতে কাজ হারাতে পারেন ৪ কোটি ৭০ লাখ শ্রমিক এবং বেকারত্বের হার দাঁড়াতে পারে ৩২.১ শতাংশে, যা অতীতের ‘দ্যা গ্রেট ডিপ্রেশন’ থেকেও বেশি।
ভারতের ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে এবং পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স সার্ভে বলছে, দেশটিতে ১৩ কোটি ৬০ লক্ষ অকৃষি ভিত্তিক শ্রমজীবী মানুষ কাজ হারানোর প্রাথমিক ঝুঁকিতে রয়েছেন। তবে, বিশ্বজুড়ে বেকারত্বের হার কাগজ কলমের সব হিসাব ছাড়িয়ে গেলেও এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে সেটা অস্বাভাবিক কিছু হবে না।
অর্থনীতি বিষয়ক লেখক ও গবেষক ল্যারি ইলিয়ট তার ‘প্রিপেয়ার ফর দ্যা কোভিড-১৯ গ্লোবাল রিসেসন’ প্রবন্ধে আসন্ন বৈশ্বিক মন্দা সম্পর্কে হুশিয়ারি উচ্চারণ করে মন্তব্য করেছেন যে, “ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা। খেলাধুলার সূচী বাতিল করা হয়েছে। গণ-জমায়েত নিষিদ্ধ। শেয়ার বাজার মুক্তপতনের মুখে। শপিং মলগুলি জনশূণ্য প্রান্তরে পরিণত হয়েছে। কোভিড-১৯ বৈশ্বিক মন্দার জন্য প্রস্তুত হোন।”
করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাব পরবর্তী সময়ে শ্রমিক শ্রেণীর কী অবস্থা হতে পারে সে বিষয়ে পলিটিকো ম্যাগাজিনে খোলামেলা আলোচনা করেছেন ‘ওয়্যাপন অব ম্যাথ ডেস্ট্রাকশন’ গ্রন্থের লেখক ক্যাথি ও’নীল। তার মতে, করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাব পরবর্তী সময়ে ধনী সম্প্রদায়ের লোকেরা তাদের ধন-সম্পদের কল্যাণে বেশ সুখে শান্তিতেই থাকবেন। অন্যদিকে, গরীব সম্প্রদায়ের লোকেরা হয়ে যাবে সর্বস্বান্ত। ফলে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিতে পারে এবং খেটে খাওয়া লোকেরা আরও একবার ওয়াল স্ট্রীট দখল করতে পারে বলেও তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
সত্যিই যদি কোভিড-১৯ এর ফলে বৈশ্বিক মন্দা দেখা দেয়, আর খেটে খাওয়া মানুষেরা সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েন, তাহলে রাজনৈতিক অস্থিরতা সময়ের ব্যাপার মাত্র। করোনা পরবর্তী সময়ে যখন একটা শ্রেণীর কাছে অঢেল সম্পদ থাকবে আর অন্য একটা শ্রেণীর পেটে খাবার জুটবে না, তখন স্বভাবতই ক্ষুধার্ত শ্রেণীটি প্রচণ্ড আক্রোশে ফেঁটে পড়বে।
বিশ্বজুড়ে সম্পদের অসম বণ্টনের ইতিহাস দীর্ঘ, তবে পুঁজিবাদের সফলতা এখানেই যে এর ফলে খেটে খাওয়া মানুষেরাও নামে মাত্র সুফল পেয়েছেন, তাদেরকে না খেয়ে অন্তত মরে যেতে হয়নি। কিন্তু শ্রমিদের হাতে যখন কাজ থাকবে না, পেটে খাবার থাকবে না, পকেট খালি থাকবে, তখন তারা এতদিন ধরে চলে আসা সব শোষণ-বৈষম্যের হিসাব কষতে শুরু করবে না, সেকথা জোর দিয়ে বলা যায় না।
বিভিন্ন রাষ্ট্র, সরকার ও পুঁজিপতিরা যদি করোনাভাইরাসের কারণে হঠাৎ করে কর্মহীন আর অসহায় হয়ে পড়া এই মানুষগুলির সামাজিক নিরাপত্তার যথাযথ ব্যবস্থা করতে পারে, তাহলে হয়তো শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে চূড়ান্ত অসন্তোষ দেখা দেয়ার সম্ভাবনা কমে আসবে। তবে এখন পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে যেসব উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে তা এই শ্রেণীটিকে অক্সিজেন দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার জন্যেও যথেষ্ট নয়। আবার ক্রমেই স্থবির হতে থাকা অর্থনীতি নিয়ে স্বদিচ্ছা থাকলেও পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সে রকম কার্যকর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন কতটা সম্ভব সেটাও এখন দেখার বিষয়।
পুঁজিবাদ যদি সত্যিই শ্রমিক শ্রেণীর সামাজিক নিরাপত্তা বিধানে ব্যর্থ হয়, তাহলে করোনার প্রভাব শেষ হয়ে যাওয়ার পর বিশ্বজুড়ে ঝাঁকে ঝাঁকে শ্রমিক রাস্তায় নেমে রাজপথ দখল করে নিতে পারে। তাদের দলে যোগ দিতে পারে অগনিত শিক্ষিত বেকার। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া সব হারানো এই মানুষে দল চাইলে দখল করে নিতে পারে রাষ্ট ব্যবস্থা, নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে অর্থনীতির সব নিয়ামকের উপর, অন্তত ইতিহাস সে কথাই বলছে।
আবার অন্যদিকে এটাও বলা যায়, শ্রমিক শ্রেণী যদি ওই অবস্থায় তাদের অধিকার বুঝে নিতে ব্যর্থ হয় তাহলে অনাহারে-অর্ধাহারে আর রোগে শোকে ভুগে তারা গণহারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে হয়তো অবশিষ্ট শ্রমিকের দ্বারা কিংবা রোবট দ্বারা উৎপাদন প্রক্রিয়া বহাল থাকবে, বহাল তবিয়তে থাকবে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা।
তবে বিশ্বজুড়ে খেটে খাওয়া এই বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর যখন হারানোর মতো আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না, তখন তাদের সীমাহীন ক্রোধের সামনে ভেঙ্গে পড়তে পারে একের পর এক পুঁজিবাদী রাষ্ট্র কাঠামো, বদলে যেতে পারে পৃথিবীর রাজনৈতিক চিত্র এমনকি মানচিত্রও। যেমনটা হয়েছিল ১৯১৭ সালের অক্টোবর বিপ্লবের পর, শত বছর পরে সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয় কিনা সেটা সময় বলে দেবে। যদিও এই মুহূর্তে সব থেকে কঠিন পরিস্থিতিতে দিনাতিপাত করছে খেটে খাওয়া মানুষের দল, স্বল্প আয়ের শ্রমজীবী লোকেরা, সে কথা হলফ করে বলে দেয়া যায়।
লেখক: তরুণ সাংবাদিক