শীতকালীন এফেকটিভ ডিসঅর্ডার: কেন এ বছর বেশি মানুষ আক্রান্ত হবে?

শীতল আবহাওয়া ও রঙ্গিন পত্রপল্লব নিয়ে যখন শরৎ উপস্থিত হয় তখন সিজনাল এফেকটিভ ডিসঅর্ডারও ঘটে থাকে। সিজনাল এফেকটিভ ডিসঅর্ডার হলো শীতল বা ঠাণ্ডা ঋতুগুলোতে বার বার ঘটা এক ধরণের বিষণ্ণতা।

এই বিষণ্ণতাকে সংক্ষেপে এসএডি (SAD) বলা হলেও এসএডি (SAD) সাধারণ দুঃখবোধ থেকে বেশি কিছু। এটিকে ঋতুগত বিষণ্ণতা কিংবা শীতকালীন বিষণ্ণতাও বলা হয়। এসএডি (SAD) সাধারণত শরতের শেষে এবং শীতের শুরুতে শুরু হয় এবং সাধারণত বসন্ত ও গ্রীষ্মের সময়ে আস্তে আস্তে চলে যায়।

আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন (APA) এর বিশ্লেষণে দেখা যায়, দিনের কয়েক ঘণ্টা দিনের আলো ও সূর্যালোক কম হওয়ার কারণে মস্তিষ্কে জৈব-রাসায়নিক ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয় যেখান থেকে এসএডি'র সৃষ্টি হয় যেটি কিনা আমাদের প্রাত্যহিক/দৈনন্দিন সময়সূচীর ব্যত্যয় ঘটিয়ে দেহের অভ্যন্তরীণ ঘড়িটি বদলে দেয়।

অ্যাডভ্যান্ট হেলথস সেন্টার অব বিহেভিওরাল হেলথের পরিচালক সাইক্রিয়াটিস্ট ডাক্তার লুইস এলেন বলেন, ''অল্প মাত্রার সূর্যের আলো সেরোটোনিন নামক একটি নিউরোট্রান্সমিটারকে প্রভাবিত করে যেটি আমাদের মেজাজের উপর প্রভাব রাখে এবং একই সাথে এটি বিষণ্ণতার সাথেও সংযুক্ত। যদি আপনি এ অবস্থায় থাকেন তবে সেটি এসএডির ঝুঁকির অন্যতম কারণ হবে।''

নিরক্ষরেখা থেকে অবস্থান যত দূরে হবে, সিজনাল এফেকটিভ ডিস-অর্ডারের সম্ভাবনাও তত বেশি হবে। কানাডায় অবস্থিত কোন ব্যক্তির এই অবস্থায় পড়ার সম্ভাবনা ফ্লোরিডায় অবস্থিত কোন ব্যক্তি থেকে অধিকতর বেশি।

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটস অব হেলথ এর তথ্যানুসারে নিম্নোক্ত কারণগুলো এসএডি এর ঝুঁকি বাড়াতে পারে-

  • নারীদের ঝুঁকি বেশি থাকে।
  • তরুণ বা যুবকদের ঝুঁকি বেশি।
  • পারিবারিক বিষণ্ণতার ইতিহাস থাকলে।
  • নিজের ব্যক্তিগত বিষণ্ণতা কিংবা বাইপোলার ডিসঅর্ডার এর ইতিহাস থাকলে।

এসএডি’র উপর মহামারির প্রভাব

সাধারণ ঝুঁকির কারণগুলোর পাশাপাশি মহামারিও এবছর এসএডি  (SAD) ঘটাতে বড় ভূমিকা রাখবে।

ভিস্তা পাইনস হেলথ এর প্রাইমারি থেরাপিস্ট ডেইরি হাল্কো বলেন, "করোনা ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত মানুষ ছাড়াও কোভিড-১৯ ব্যাপক সংখ্যক মানুষের জীবনে পরিবর্তন, মানসিক আঘাত ও মানসিক চাপ নিয়ে এসেছে। এটি সেসকল ব্যক্তির উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে যারা মহামারি আক্রান্ত অঞ্চলে অবস্থান করছেন, এছাড়া যাদের আগে থেকে এসএডি’র(SAD) ইতিহাসও আছে।"

যেহেতু সামাজিক একাকীত্ব এসএডি'র(SAD) অন্যতম কারণ, হাল্কোর মতে আগত মাসগুলোতে শারীরিক দূরত্ব এটির ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে।

থেরাপিস্ট শার্নেড জর্জ এ বিষয়ে একমত হয়ে বলেন যে, "অবসর এবং বহির্গমন সুবিধার মধ্যে বিধিনিষেধ, বাড়ির বাইরে কোন অনুষ্ঠান না থাকায়, মানুষ ঘরে থেকে কাজ করছে ও বাড়ি থেকে কম বের হচ্ছে এবং সরকারও বলছে ঘরে থাকুন, নিরাপদ থাকুন। এক্ষেত্রে কেউ যদি এসএডিতে ভুগেন তাহলে তাঁর কাছে নিজের বাড়িও অনিরাপদ মনে হয়।"

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটস অব হেলথ সামাজিক একাকীত্বের পাশাপাশি এসএডির সাধারণ লক্ষণ ও উপসর্গ হিসেবে নিম্নোক্ত কারণ সমূহকেও অবহিত করেছে-

  • ক্লান্তি।
  • অতিরিক্ত ঘুম ঘুম ভাব।
  • অতি পরিমাণে খাদ্যগ্রহণ।
  • ওজন বৃদ্ধি।
  • শর্করা জাতীয় খাদ্য গ্রহণের ইচ্ছা।

এসএডির লক্ষণ ও উপসর্গগুলো বিষণ্ণতার লক্ষণ-উপসর্গের মতোই কারণ এসএডিও হচ্ছে বিষণ্ণতার একটি ধরণ।

এলেন বলেছিল, "খাদ্যগ্রহণ এবং ঘুমের ধরণের পরিবর্তন, শারীরিক শক্তির নিন্মগামিতা ও সেই সাথে স্বাভাবিক কাজকর্ম, লক্ষ্য ও মনোযোগ হ্রাস পাওয়া একজন ব্যক্তিকে উল্লেখযোগ্য ভাবে প্রভাবিত করে। একটি বড় ধরণের ভিন্নতা হল এটি (SAD) বছরের নির্দিষ্ট সময়ে ঘটে বলে এর ক্ষমতাকে আগে থেকে অনুমান করা যায়।”

প্রতিরোধ এবং চিকিৎসা

হাল্কো বলেন, আপনি যদি আগে থেকে এসএডি অনুভব করে থাকেন, আপনার যদি পূর্বে বিষণ্ণতা জনিত সমস্যা থেকে থাকে, আপনি যদি অতিরিক্ত মানসিক চাপে ভুগে থাকেন এবং মহামারির কারণে যদি আপনার জীবন যাত্রায় কোন গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে তাহলে এই বসন্তে নিজের যত্নের প্রতি বেশি অগ্রাধিকার দিতে হবে।

তিনি বলেন, "আবেগজনিত সমস্যা হয়তোবা সবসময় প্রতিরোধ করা যায় না। তবে প্রতিরোধের কিছু উপায় রয়েছে যেগুলো আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের সুরক্ষা দিয়ে সাহায্য করতে পারে। কিছু বিষয় যেমন নিয়মিত ব্যায়াম, স্বাস্থ্যকর খাদ্যগ্রহণ, পর্যাপ্ত ঘুম এগুলো হলো আমাদের নিজের প্রতি যত্নশীল হওয়ার গুরুত্বপূর্ণ দিক।"

হাল্কো আরও বলেন, পরিবার ও বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ ও সুন্দর সম্পর্ক বজায় রাখাও এসএডি'র(SAD) প্রাদুর্ভাব কমিয়ে আনতে কিংবা প্রতিরোধ করতে সহায়তা করে। একইসাথে অন্যান্য মানসিক অবস্থার জন্যও ভালো হয়।

মেন্টাল হেলথ আমেরিকা বলছে, ঘরে আলোর পরিমাণ বাড়ানো, বাইরে বেশি সময় কাটানো, রৌদ্রজ্জ্বল স্থানে বেড়ানো এগুলোও এসএডি প্রতিরোধের কিছু উপায়।।

এ বিষয়ে জর্জ বলেন, যেভাবে আপনি ফ্লু সিজনের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে থাকেন সেভাবে চিন্তা করুন। তিনি বলেন,"শীতকালের পূর্বে আমরা সাধারণত পূর্ব প্রস্তুতিমূলক কিছু ঔষধপত্র কিনে থাকি এবং আমাদের রোগ প্রতিরোধের প্রতি যত্নশীল হয়ে নিজেদেরকে সেভাবে প্রস্তুত রাখি যাতে শীত আসলে আমাদের ঠাণ্ডা কিংবা ফ্লু না হয়। যারা এসএডি'তে(SAD)  আক্রান্ত তাদের লক্ষণ ও উপসর্গ পরীক্ষা করে তাদের উপরেও এ পদ্ধতিটি কার্যকর করা যেতে পারে।"

সবচেয়ে ভালো প্রস্তুতি হল এমন কারো সাথে যোগাযোগ করা যিনি একজন দক্ষ মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং আপনাকে এ ব্যাপারে সঠিক চিকিৎসা দেওয়ার জন্য নিয়োজিত।

চিকিৎসার মধ্যে রয়েছে ভিটামিন ডি'র সাপ্লিমেন্ট প্রয়োগ, কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি, এন্টিডিপ্রেসেন্ট সিলেকটিভ সেরোটোনিন রিউপটেক ইনহিবিটর (এসএসআরআই)  প্রভৃতি।

কিছু ব্যক্তির জন্য লাইট থেরাপিও কার্যকর। এর মধ্যে রয়েছে একটি লাইট থেরাপি বক্সের সামনে বসে থাকা যেটি থেকে আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি পরিস্রুত হয়ে আলোক রশ্মি নির্গত  হয়। আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন (APA)  এর মতে, লাইট থেরাপি হলো শীত ও শরতের সময়গুলোতে একটি লাইট বক্সের সামনে প্রতিদিন সকালে কমপক্ষে ২০ মিনিট ধরে বসে থাকা।

এলেন বলেন, "এই সমন্বিত চিকিৎসার একত্রিত প্রয়োগ  এসএডি'র (SAD) চিকিৎসার ক্ষেত্রে আরো কার্যকর ভূমিকা রাখবে। তিনি বলেন, "প্রাথমিক পর্যায়ের যে মধ্যস্থতা সেটি ভালো কারণ এটি একজন ব্যক্তির শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার উপর এসএডি'র(SAD) প্রভাব কমিয়ে আনতে সাহায্য করে করে।"

তথ্যসূত্র -হেলথলাইন

 

টাইমস/নওশাদ/এনজে

Share this news on: