নেহরু: ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের পথিকৃৎ

জওহরলাল নেহরু, ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রবাদ পুরুষ। তিনি ছিলেন স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। ১৯৪৭ থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত (১৯৬৪ সাল) তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন।

১৮৮৯ সালে বৃটিশ ভারতের এলাহাবাদে জন্মগ্রহণ করেন নেহরু। তবে লেখাপড়া করেছেন ইংল্যান্ডে।

ক্যামব্রিজের ট্রিনিটি কলেজ থেকে আইন বিষয়ে পড়া শেষ করে ১৯১২ সালে ভারতে ফিরে আসেন নেহরু।

ভারতে ফিরেই আইন পেশায় নিযুক্ত হন এবং ১৯১৬ সালে কমলা কাউলকে বিয়ে করেন। তার একমাত্র মেয়ে ইন্দিরা গান্ধী, যিনি পরে পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন।

১৯১৯ সালে অমৃতসার হত্যাকাণ্ডের পর ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে। তখন নেহরু ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দেন। তিনি ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেন।

স্বাধীনতার দাবিতে অহিংস আন্দোলন সহিংসতায় রূপ নিলে অভিমানী মহাত্মা গান্ধী আন্দোলন থেকে কিছুটা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছিলেন। ঠিক তখনই ভারতের স্বাধীনতা আন্দলনের হাল ধরেন নেহরু।

নেহরু ১৯২৭ সালে ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা দাবি জানান বৃটিশ সরকারের কাছে। কিন্তু বৃটিশ সরকার তার এ দাবি প্রত্যাখ্যান করে।

এর ফলে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রধান নেতা হিসেবে নেহরু ১৯২৯ সালে ভারতের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।

নেহরু ঘোষণা করেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, স্বাধীনতা, ভারতের জনগণের অবিচ্ছেদ্য দাবি....যেকোন সরকার ভারতীয় জনগণকে তাদের এ অধিকার থেকে বঞ্চিত করলে জনগণ তা যেকোনো মূল্যে প্রতিহত করবে।’

ভারতের স্বাধীনতার প্রশ্নে তিনি মহাত্মা গান্ধীর পদাঙ্ক অনুসরণ করেছিলেন এবং ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের এক উদীয়মান তারকা হিসেবে আবির্ভূত হন।

১৯২০-৩০ সাল পর্যন্ত চলমান অসহযোগ আন্দোলনগুলোতে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন। এ সময় বেশ কয়েকবার কারাগারে যেতে হয়েছিল তাকে।

এ সময় আন্দোলনের নেতৃত্বে গান্ধী থাকলেও কার্যত নেতা ছিলেন নেহরু।

ত্রিশের দশকে তিনি নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর সাথে আন্দোলন করেছিলেন। কিন্তু আন্দোলনের ধরন নিয়ে মতভেদ দেখা দিলে তিনি আলাদা হয়ে যান।

১৯৪২ সালে গান্ধীর “ভারত ছাড় আন্দোলনে” যোগ দেন নেহরু।

এ সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান নাৎসি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রথমে বৃটিশদের সহযোগিতার পক্ষে ছিলেন তিনি। কিন্তু বৃটিশরা আদৌ ভারত ছাড়বে কি না এ নিয়ে তার সন্দেহ হলে তিনি বৃটিশদের প্রতি সমর্থন প্রত্যাখ্যান করেন।

এতে বৃটিশরা ক্ষেপে গিয়ে ১৯৪২ সালে তাকে গ্রেপ্তার করে এবং ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত তিনি কারাগারে ছিলেন।

জেল থেকে মুক্ত হয়ে নেহরু দেখলেন যে, তার অনুপস্থিতিতে জিন্নাহর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ অত্যন্ত শক্তিশালী অবস্থানে চলে গেছে।

তখন মুসলিম লীগের দাবি অনুযায়ী ব্রিটিশ গভর্নর লর্ড মাউন্টবেটেন ভারত ভাগ করে দুটি রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা করেন।

নেহরু ভারত ভাগের কঠোর বিরোধিতা করেন। একপর্যায়ে লর্ড মাউন্টবেটেনের চাপের মুখে তিনি ভারত ভাগ প্রশ্নে সায় দেন।

অবশেষে ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ করে “ভারত” ও “পাকিস্থান” নামে দুটি পৃথক রাষ্ট্রের জন্ম হয়।

এ সময় ১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতার দিনে জাতির উদ্দেশ্যে “ট্রিস্ট উইথ ডেসটিনি” শীর্ষক ভাষণ দেন নেহরু।

একটি অসাম্প্রদায়িক ভারতের স্বপ্ন দেখেছিলেন নেহরু। কিন্তু কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক হত্যাকাণ্ড তার সেই স্বপ্নকে ম্লান করে দিয়েছিল, যা আজও অব্যাহত রয়েছে।

স্বাধীনতার পর পরই ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন নেহরু। তিনি একটি উদার গণতান্ত্রিক ভারত প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করেন।

১৯৫০ সালে তিনি সর্বজনীন অধিকার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে প্রণীত ভারতের সংবিধানে সই করেন।

তবে ব্যক্তিগতভাবে তিনি ফেবিয়ান সমাজতন্ত্রের সমর্থক ছিলেন। তিনি সমাজের সর্বস্তরে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করার স্বপ্ন দেখতেন। তাছাড়া মার্কসবাদের প্রতিও তার অনুরাগ ছিল।

তিনি শিশুদের জন্য সার্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন।

একজন ধর্মপ্রাণ হিন্দু হলেও তিনি ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী ছিলেন। জাত প্রথার অবসান ও নারীর উন্নয়নে তিনি কাজ করেছেন।

বিদেশ নীতির ক্ষেত্রে তিনি সবসময় জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনে সমর্থন করেছিলেন। তিনি ভারতকে স্নায়ুযুদ্ধে জড়ানো থেকে বিরত রেখেছিলেন।

রাষ্ট্রনেতা হিসেবে বিরোধীদলের প্রতি ছিলেন সংবেদনশীল। তিনি প্রতিপক্ষের কথা শুনতেন এবং তাদের দাবিগুলো বোঝার চেষ্টা করতেন।

১৯৪৯ সালে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ভাষণে তিনি বলেন, “কেবল ভারতের জন্যই নয়, বিশ্বের সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের জন্য ভারতে শান্তি প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য”।

১৯৬৪ সালে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের এই প্রবাদ পুরুষ মারা যান।

 

Share this news on:

সর্বশেষ

img
বরেণ্য শিল্পী ফরিদা পারভীনের মৃত্যুতে প্রধান উপদেষ্টার শোক Sep 14, 2025
img
ভোট বর্জন করেও জাকসুর ভিপি-জিএস পদে কত ভোট পেল ছাত্রদল? Sep 14, 2025
img
সংগীতশিল্পী ফরিদা পারভীনের মৃত্যুতে সংস্কৃতি উপদেষ্টার শোক Sep 14, 2025
img
২৫ বছরের জন্য বাফুফেকে ৮ জেলা স্টেডিয়াম বরাদ্দ Sep 14, 2025
img
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে হারে সুপার ফোর স্বপ্নে বড় ধাক্কা টাইগারদের Sep 14, 2025
img
জাকসুর ভিপি জিতুর ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগের কারণ কী? Sep 14, 2025
img
সেই ফাইয়াজের ভাই এবার জাকসুর জিএস Sep 13, 2025
img
ফজলুর রহমানকে গালি দিয়ে স্লোগান দেওয়া ফারজানা চাঁদাবাজি মামলায় গ্রেপ্তার Sep 13, 2025
img
জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী ফরিদা পারভীন আর নেই Sep 13, 2025
হাইকমিশনের খালি গাড়িতে ডিম নিক্ষেপ, নিরাপদেই ছিলেন মাহফুজ আলম Sep 13, 2025
‘ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন না হলে জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে’ Sep 13, 2025
img
লিটমাস টেস্টের ফল কী বার্তা দিচ্ছে? Sep 13, 2025
img
চীনা বাণিজ্য সম্মেলনে যোগ দিল বাংলাদেশি প্রতিনিধি দল Sep 13, 2025
img
পিআর পদ্ধতি সাধারণ মানুষ বোঝে না: মাহমুদুর রহমান মান্না Sep 13, 2025
img
পাকিস্তানে সংঘর্ষে প্রাণ গেল অন্তত ১৯ সৈন্যের Sep 13, 2025
img
দেড় কোটি টাকা কানাডায় মেয়ের কাছে পাচার, অভিযোগে ও আলোচনায় সাবেক প্রধান শাহীনুল Sep 13, 2025
img
ফের শক্তিশালী বৃষ্টিবলয়ে প্রবেশ করছে দেশ Sep 13, 2025
img
জাকসুর ফলাফল ঘোষণায় এত সময় লাগার কারণ Sep 13, 2025
img
জাকের ও শামিমের ব্যাটে লড়াইয়ের পুঁজি পেল বাংলাদেশ Sep 13, 2025
‘আমাদের জন্য কি অপেক্ষা করছে আমরা জানি, গোপালগঞ্জে দেখে এসেছি’ Sep 13, 2025