নোবেল জয়ী নাদিয়া মুরাদের গল্প

নাদিয়া মুরাদ জার্মানভিত্তিক ইয়াজিদি-ইরাকি মানবাধিকার কর্মী। স্কুলে পড়ার সময় বিউটি পার্লার খোলার স্বপ্ন দেখতেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস নাদিয়া ইসলামিক স্টেট (আইএস) কর্তৃক অপহরণ ও ধর্ষণের শিকার হন।

তিন মাস আটক থাকার পর আশ্রয় পান জার্মানির একটি শরণার্থী শিবিরে। আইএস কর্তৃক যৌন নির্যাতনের শিকার হাজার হাজার নারীর মুক্তির লক্ষ্যে নতুন করে লড়াই শুরু করেন। গণহত্যা এবং মানব পাচারের মাধ্যমে নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুদের সহায়তার লক্ষ্যে তিনি ‘‘নাদিয়াস ইনিশিয়েটিভ’’ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন।

যৌন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তার এই অদম্য লড়াইয়ের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি এ বছর শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান। একজন ইরাকি হিসেবে তিনিই প্রথম বিশ্বের সর্বোচ্চ এ পুরস্কার পেলেন।

নাদিয়ার উত্থান যেভাবে:

নাদিয়া মুরাদ ১৯৯৩ সালে ইরাকের সিঞ্জারের কজো গ্রামে ইয়াজিদি (জাতিগত ধর্মীয় সংখ্যালঘু) একটি কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯ বছর বয়সে তিনি যখন স্কুলে পড়তেন তখন ইসলামিক স্টেটের যোদ্ধারা কজো গ্রামে আক্রমণ চালায়। ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের ৬শ জনকে হত্যা করে যাদের ছয়জনই ছিলেন নাদিয়ার ভাই। এ সময় আইএস নাদিয়াসহ ছয় হাজার ৭শ ইয়াজিদি নারীকে বন্দি করে নিয়ে যায়।

আইএস যোদ্ধারা অন্যান্য নারীর সাথে নাদিয়াকে যৌনদাসী হিসেবে বন্দি করে রাখে। এ সময় নানাভাবে তাকে শারীরিক নির্যাতন করা হয়। তাকে পেটানো হত। এমন কি সিগারেটের আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। পালাতে গিয়ে বেশ কয়েকবার ধরা পড়েন এবং ধর্ষণের শিকার হন।

তিন মাস বন্দি থাকাকালে বেশ কয়েকবার তাকে যৌনদাসী হিসেবে বিক্রি করা হয়। এ সময় আইএস জঙ্গিরা অসংখ্যবার তাকে ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়ন করে। নানা হাত ঘুরে একসময় তিনি যৌনদাসী হিসেবে ইসলামিক খেলাফতের ইরাক অংশের রাজধানী মসুলে পৌঁছে যান।

বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে নাদিয়া জানান, এক পর্যায়ে তিনি পালিয়ে যেতে সক্ষম হন এবং একটি সুন্নি মুসলিম পরিবারে আশ্রয় নেন। এ সময় ওই পরিবারের নাসির নামের একজন স্ত্রী পরিচয় দিয়ে নাদিয়াকে মসুল সীমান্ত দিয়ে পালাতে সাহায্য করেন।

মসুল থেকে পালানোর পর উত্তর ইরাকে একটি শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় পান নাদিয়া। ওই সময় ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে রোয়াঙ্গা ক্যাম্পে তিনি বেলজিয়ামের দৈনিক পত্রিকা ‘লা লিবার বেলিজিক’কে সর্বপ্রথম আইএস জঙ্গিদের বীভৎস নির্যাতনের বর্ণনা তুলে ধরেন।

একই বছর এক হাজার শরণার্থীর সাথে নাদিয়া জার্মানির একটি শিবিরে আশ্রয় পান।

নাদিয়ার আন্দোলন-সংগ্রাম:

আইএসের নির্যাতন দমাতে পারেনি নাদিয়াকে। বরং এটা অদম্য নাদিয়ার বিপ্লবী চেতনাকে জাগিয়ে দিয়েছে। তাই জার্মানির শরণার্থী শিবির থেকেই নাদিয়া যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে যৌন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেন।

২০১৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর তিনি প্রথমবারের মতো জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে আইএস জঙ্গি কর্তৃক মানবপাচার এবং যৌন নির্যাতনের বীভৎস বর্ণনা তুলে ধরেন। অতঃপর নির্যাতিতদের দূত হিসেবে মানবপাচার ও উদ্বাস্তুদের সচেতনতা সৃষ্টির জন্য বিশ্বব্যাপী অ্যাডভোকেসি কার্যক্রমে অংশ নেন। শরণার্থী ও বেঁচে থাকা সম্প্রদায়ের কাছে পৌঁছেছেন। পাচার ও গণহত্যার শিকারদের সাক্ষ্য শুনেছেন।

নিজের ও শরণার্থীদের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা বিশ্ববাসীকে জানাতে ২০১৭ সালে ‘‘The Last Girl: My Story of Captivity, and My Fight Against the Islamic State’’ নামে বই লিখেন। এ সময় কয়েকদফা আইএস কর্তৃক হত্যার হুমকি দেয়া হলেও তা দমাতে পারেনি অদম্য নাদিয়াকে।

গণহত্যা, ধর্ষণ ও পাচারের অপরাধে আইএসআইএল কমান্ডারদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিতে ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি অ্যাটর্নি আমল ক্লুনির সহায়তায় জাতিসংঘের কাছে আহবান জানান। একই বছর গণহত্যার শিকারদের পক্ষে সমর্থন ও সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে টিনা ব্রাউনের উদ্যোগে নিউইয়র্কে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে অংশ নেন।

একই মাসে জাতিসংঘ তাকে মানবপাচারের শিকার সংগ্রামী লোকদের দায়িত্বের জন্য প্রথম ‘গুডউইল অ্যাম্বাসেডর’ হিসেবে ঘোষণা করে।

২০১৭ সালের ৩ মে, নাদিয়া ভ্যাটিকান সিটিতে পোপ ফ্রান্সিস এবং আর্চবিশপ গালাঘেরের সাথে দেখা করেন। বৈঠককালে তিনি ইরাকের নির্যাতিত সংখ্যালঘু ইয়াজিদি এবং উদ্বাস্তু শরণার্থীদেরর সাহায্যের জন্য আহবান জানান।

পুরস্কার এবং সম্মাননা:

• ২০১৬: মানবাধিকারের জন্য ‘‘কাউন্সিল অব ইউরোপ ভ্যাক্লেভ হাভেল অ্যাওয়ার্ড’’।
• ২০১৬: মুক্ত চিন্তার জন্য ‘‘সাখরভ পুরস্কার’’ (লামিয়া আজি বাশারের সাথে যৌথভাবে)।
• ২০১৮: নোবেল শান্তি পুরস্কার (ডেনিস মুকওয়েজের সাথে যৌথভাবে)।

Share this news on:

সর্বশেষ

img
হাবিবুর রহমানসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে তৃতীয় দিনের সাক্ষ্যগ্রহণ আজ Nov 03, 2025
img
৫২তে পা রাখলেন অভিনেত্রী মৌসুমী মৌসুমী,ফেরা হয়নি দেশে Nov 03, 2025
img
জেনে নিন আজ দেশে কত দামে বিক্রি হচ্ছে স্বর্ণ Nov 03, 2025
img
আজ দুপুর ১২টায় সংবাদ সম্মেলন ডাকলেন প্রধান উপদেষ্টা Nov 03, 2025
img
রাজধানীতে পুলিশের বিশেষ অভিযানে গ্রেপ্তার ১৪ Nov 03, 2025
img
গোপনে মাস্ককে ২০০ কোটি ডলারের প্রতিরক্ষা প্রকল্প দিলেন ট্রাম্প Nov 03, 2025
img
আফগানিস্তানে ফের ভূমিকম্প Nov 03, 2025
হাসিনাকে আশ্রয় দিয়ে জুলাই গণ/হত্যাকে সমর্থন করছে ভারত: এনসিপি Nov 03, 2025
অবশেষে শাপলা কলিতেই রাজি এনসিপি Nov 03, 2025
বিএনপিকে নিয়ে যে মন্তব্য করলেন মাসুদ কামাল Nov 03, 2025
ড. মোহাম্মদ ইউনুস কে আদেশ জারি করতে হবে: হাসনাত। Nov 03, 2025
কেন সালমান শাহর মৃত্যুর তিন দিন পর আসেন ডন ? Nov 03, 2025
মায়ের আশীর্বাদ ছাড়া এই জায়গায় আসতে পারতাম না: কাজল Nov 03, 2025
এবার ১৯ বছরের ছোট, হীরা ব্যবসায়ীর প্রেমে মজলেন মালাইকা Nov 03, 2025
img
প্রবাসীদের ভোটাধিকার দেওয়ায় ইসিকে তারেক রহমানের ধন্যবাদ Nov 03, 2025
img
ট্রাম্পের সামরিক পদক্ষেপের জবাব দিলো নাইজেরিয়া Nov 03, 2025
img
যখন সাংবাদিকদের চুপ করানো হয়, তখন সবার কণ্ঠ থেমে যায় : জাতিসংঘ মহাসচিব Nov 03, 2025
img
শীতের আগমন নিয়ে আবহাওয়া অফিসের পূর্বাভাস Nov 03, 2025
img
আজ শোকাবহ জেলহত্যা দিবস Nov 03, 2025
img
১০০ টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে ৩৯ বছর আদালতে হাজিরা! Nov 03, 2025