ব্ল্যাকওয়েল: মেডিক্যাল ডিগ্রিধারী প্রথম মার্কিন নারী

এলিজাবেথ ব্ল্যাকওয়েল। একজন বিখ্যাত ব্রিটিশ নারী চিকিৎসক ও সমাজ সংস্কারক, যিনি তার জীবনের অধিকাংশ সময়ই মানুষের স্বাস্থ্য সেবায় ব্যয় করেছেন। তিনি ছিলেন মার্কিন ইতিহাসের প্রথম নারী, যিনি মেডিক্যাল কলেজ থেকে স্নাতক পাশ করেছেন।

একই সঙ্গে তিনি প্রথম নারী, যিনি যুক্তরাজ্যের জেনারেল মেডিক্যাল কাউন্সিলের রেজিস্টার ছিলেন। তিনি ছিলেন মেডিক্যাল শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণের এক অন্যতম পথপ্রদর্শক। তার এই অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ প্রতি বছর চিকিৎসা বিদ্যায় অবদানকারী একজন নারীকে এলিজাবেথ ব্ল্যাকওয়েল পদক দেয়া হয়।

এলিজাবেথ ব্ল্যাকওয়েল ১৮২১ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি ইংল্যান্ডের ব্রিস্টলে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বড় হয়েছেন একটি উদার মানসিকতার পরিবারে, যেখানে ছেলে-মেয়ে সবার প্রতিই পড়ালেখার জন্য সমান গুরুত্ব দেয়া হত।

১৮৩২ সালে তিনি তার পরিবারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে চলে যান। পরে সেখান থেকে তার পরিবার অহিও রাজ্যে স্থানান্তর হয়ে যায়। ১৮৩৮ সালে ব্ল্যাকওয়েলের বাবা মারা যান। এ সময় পরিবারে অভাব অনটন দেখা দেয়। তার পরিবারের সবাই শিক্ষিত ছিলেন। ব্ল্যাকওয়েল নিজেও ইংরেজির পাশাপাশি ফ্রান্স ও জার্মান ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। তাই পরিবারের প্রয়োজন মিটাতে তিনিসহ তার মা ও দুই ভাই সবাই শিক্ষকতা করতেন।

তার বয়স যখন ২০ বছরের কাছাকাছি, তখন তার এক মেয়ে বন্ধু এক মরণব্যাধি রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু সে লজ্জায় চিকিৎসার জন্য কোনোভাবেই পুরুষ ডাক্তারের কাছে যেতে চায় না। বরং সে বিলাপ করতে থাকে যে, একজন নারী ডাক্তার থাকলে তার খুব ভালো হত। কিন্তু সে সময় আমেরিকায় ডিগ্রিধারী কোন নারী ডাক্তার ছিল না।

এই ঘটনাটি ব্ল্যাকওয়েলের জীবনকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করে। তিনি একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হবার প্রতিজ্ঞা করেন। কিন্তু তার এই স্বপ্ন পূরণের যাত্রাটা সুখকর হয়নি। কারণ সে সময় মার্কিন সমাজে বিভিন্ন ধরণের কুসংস্কার প্রচলিত ছিল। সেখানে নারীদের জন্য মেডিক্যালে অধ্যয়ন করা সামাজিকভাবে স্বীকৃত ছিল না। তার আগেও অনেক মার্কিন নারী এ রকম মেডিক্যালে পড়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন।

কিন্তু এসব সামাজিক প্রতিবন্ধকতা তার স্বপ্নের পথে বাঁধা হতে পারে নি। প্রথম দিকে তিনি ব্যক্তিগতভাবে বিভিন্ন ডাক্তারের কাছে পড়াশোনা করেন। পরে ১৮৪৭ সালে তিনি নিউইয়র্কের জেনেভা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হবার সুযোগ পান। কিন্তু সেখানকার ছাত্রসমাজ তার এই ভর্তিকে এক প্রকার প্রশাসনিক কৌতুক বলে মন্তব্য করে।

তারপরও ব্ল্যাকওয়েল তার এই সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। ফলে তার এ সিদ্ধান্তে মার্কিন নারীদের প্রতি বিদ্যমান বিভিন্ন সামাজিক কুসংস্কার নিয়ে চারদিকে ব্যাপক হইচই পড়ে যায়। অবশেষে, ১৮৪৯ সালে তিনি স্নাতক পাশ করেন এবং তিনি তার ব্যাচে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। আর এটা ছিল মার্কিন ইতিহাসে প্রথম ঘটনা, যেখানে একজন নারী মেডিক্যাল থেকে স্নাতক শেষ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

লেখাপড়া শেষ করে তিনি লন্ডনে চলে যান এবং ইউরোপের বিভিন্ন শহরে চিকিৎসা সেবা দিতে থাকেন। কিন্তু এ সময় একটি রোগে আক্রান্ত হয়ে তার বাম চোখ অন্ধ হয়ে যায়। পরে তিনি আবার নিউইয়র্কে চলে যান। সেখানে প্রথম দিকে তিনি ব্যক্তিগতভাবে চিকিৎসা সেবা দিতেন। কিন্তু সামাজিক কুসংস্কারের কারণে তিনি বাঁধাগ্রস্ত হন এবং আর্থিক সংকটে পড়ে যান।

পরে ১৮৫০ সালে তিনি নিউইয়র্কে দরিদ্র নারী ও শিশুদের জন্য একটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৫৭ সালে তিনি দুঃস্থ নারী ও শিশুদের চিকিৎসা সেবার জন্য আরেকটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেন। এর একদশক পর প্রথম নারী হিসেবে তিনি ব্রিটিশ মেডিক্যাল রেজিস্টারে তালিকাভুক্ত হন।

১৮৬১ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি ইউএস স্যানিটারি কমিশন প্রতিষ্ঠা করতে ভূমিকা রাখেন। ১৮৬০ সালের শেষ দিকে তিনি নিউইয়র্কে নারীদের জন্য একটি মেডিক্যাল স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। এই স্কুলেরই একজন ছাত্রী পরে নারীদের জন্য লন্ডনে আরেকটি মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

পরবর্তীতে তিনি আবারও লন্ডনে চলে আসেন। এখানে তিনি প্রাইভেট প্র্যাকটিশনার হিসেবে চিকিৎসা সেবা দেন। পাশাপাশি লন্ডন স্কুল অব মেডিসিন ফর উইমেনের একজন লেকচারার হিসেবে শিক্ষকতা করেন।

তিনি ছিলেন চিকিৎসা সেবায় নারীর অংশগ্রহণ প্রতিষ্ঠার একজন মহান স্বপ্নদ্রষ্টা। ক্যারিয়ার জীবনের নানা অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি অসংখ্য বই লিখেছেন, যা চিকিৎসা সেবায় নারীর অংশগ্রহণ প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

অবশেষে ১৯১০ সালের ৩১ মে এই মহান সমাজসংস্কারক এলিজাবেথ ব্ল্যাকওয়েল না ফেরার দেশে চলে যান।

 

টাইমস/এএইচ/জিএস

Share this news on:

সর্বশেষ

img
লালনের গানে বিপ্লব এনেছিলেন ফরিদা পারভীন Sep 14, 2025
img
সাদাপাথর লুটকাণ্ডে গ্রেপ্তার সাহাব উদ্দিন কারাগারে Sep 14, 2025
img
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বাবর, আলোচনায় তারেক রহমানের নিরাপত্তা Sep 14, 2025
img
প্রকৌশল খাতে লেনদেন শীর্ষে, জীবনবিমায় পতন Sep 14, 2025
img
গণতন্ত্র ও ধর্মীয় স্বাধীনতার জন্য বিপজ্জনক শক্তির উত্থান ঘটছে : রিজভী Sep 14, 2025
img
ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ নিয়ে ড্রেসিংরুমে উত্তাপ! Sep 14, 2025
img
ভারত-রাশিয়া সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে মস্কোর বার্তা Sep 14, 2025
img
তারেক রহমান শিগগিরই দেশে ফিরবেন : বাবর Sep 14, 2025
img
নির্ধারিত টাইমলাইনে নির্বাচন হতেই হবে : সালাহউদ্দিন আহমেদ Sep 14, 2025
img
তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন করতে সহযোগিতা করবেন এনবিআর চেয়ারম্যান Sep 14, 2025
img
রাজস্ব আয়ে রেকর্ড শাহ আমানত বিমানবন্দরে Sep 14, 2025
img
জুলাই সনদ নিয়ে সমঝোতায় আসতেই হবে : প্রধান উপদেষ্টা Sep 14, 2025
img
'লোকাহ' চ্যাপ্টার ১ -এ চন্দ্রা-র সাফল্যের কারণে কান্তা মুক্তির তারিখ পিছিয়ে Sep 14, 2025
img
অভিনয় ছেড়ে এবার প্রযোজনায় স্বীকৃতি মজুমদার Sep 14, 2025
img

যুক্তরাষ্ট্রের বাজার নিয়ে বাণিজ্য উপদেষ্টা

বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে পারলে শুল্কহ্রাসের আরো সম্ভাবনা রয়েছে Sep 14, 2025
img
কোহলি না থাকায় স্বস্তিতে পাকিস্তানের বোলাররা: গাভাস্কার Sep 14, 2025
img
স্বরা-ফাহাদের প্রেমে কিউপিড হয়ে এল এক বিড়ালছানা Sep 14, 2025
img
২ গান বাদ দিয়ে গল্পের কেন্দ্রবিন্দু অক্ষুণ্ণ রাখল মিরাই Sep 14, 2025
img
আওয়ামী আমলে শিক্ষাকে ক্লাসরুম থেকে উঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল : প্রিন্স Sep 14, 2025
img
বেটিং কাণ্ডে ইডির তলব, জেরার মুখে মিমি ও উর্বশী Sep 14, 2025