সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনের সিংহ পুরুষ

যুগে যুগে যারা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে গেছেন তিনি তাদের একজন। তিনি দক্ষিণ আমেরিকার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রবাদ পুরুষ। আরেক অবিসংবাদিত নেতা কাস্ত্রোর সাথে তার সম্পর্ক ছিল পিতা-পুত্রের মতো। তিনি আর কেউ নন, ভেনিজুয়েলার সাবেক প্রেসিডেন্ট হুগো শ্যাভেজ।

তিনি দক্ষিণ আমেরিকার জনগণকে সাম্রাজ্যবাদী শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখিয়েছেন।

দক্ষিণ আমেরিকার তিন কিংবদন্তি সিমন বলিভার, আর্নেস্তে চে গুয়েভারা এবং ফিদেল কাস্ত্রো। তাদের সাথে একাত্ম হয়ে দক্ষিণ আমেরিকায় সমাজতন্ত্রের সুভাষ ছড়িয়ে দিয়েছিলেন আরেক মহান নেতা হুগো শ্যাভেজ।

হুগো রাফায়েল শ্যাভেজ ১৯৫৪ সালের ২৮ জুলাই ভেনিজুয়েলার বারিনাম প্রদেশের সাবানেতা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তখন দক্ষিণ আমেরিকায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের জন্য লড়াই করছিলেন বামপন্থি বিপ্লবীরা।

অবশেষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ১৯৫৯ সালে কিউবার ডানপন্থি বাতিস্তা সরকারকে উৎখাত করে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন করেন ফিদেল কাস্ত্রো। তখন হুগো শ্যাভেজ মাত্র চার বছরের শিশু।

১৯৭১ সালে তিনি মিলিটারি একাডেমিতে ভর্তি হন। ১৯৭৬ সালে যোগ দেন সেনাবাহিনীতে।

তখন বিশ্বে চলছে স্নায়ুযুদ্ধ। চারদিকে পূঁজিবাদের জয় জয়কার। ঠিক সেই সময়ে, বিপ্লবী কাস্ত্রো ও চে গুয়েভারার সমাজতান্ত্রিক আদর্শে অনুপ্রাণিত হন শ্যাভেজ। দক্ষিণ আমেরিকায় সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের লড়াই শুরু করেন তিনি।

তিনি ১৯৯২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ভেনিজুয়েলার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আন্দ্রেস পেরেজের বিরুদ্ধে সেনা অভ্যুত্থান করে ব্যর্থ হন। এ অভিযোগে তার দুই বছরের কারাদণ্ড হয়।

মুক্তির পর ১৯৯৪ সালে তিনি “ফিফথ রিপাবলিক” নামে রাজনৈতিক দল গঠন করেন। ১৯৯৯ সালে তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েই তিনি সমাজতান্ত্রিক আদর্শের ভিত্তিতে ভেনিজুয়েলার নতুন সংবিধান প্রনয়ণ করেন।

নতুন সংবিধান অনুযায়ী তিনি ভেনিজুয়েলার সাংবিধানিক নামকরণ করেন “দ্য বলিভারিয়ান রিপাবলিক অফ ভেনিজুয়েলা”।

২০০০ সালের ৩০ জুলাই নতুন সংবিধানের আলোকে ভেনিজুয়েলায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ছয় বছরের জন্য প্রেসিডেন্ট পদে পুনঃনির্বাচিত হন শ্যাভেজ। আর তিনিই হলেন গত কয়েক দশকের মধ্যে বিশ্বে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম বামপন্থি প্রেসিডেন্ট।

প্রেসিডেন্ট থাকাকালে তিনি দেশি-বিদেশি নানা ষড়যন্ত্রের শিকার হন। তিনি ভেনিজুয়েলার রাষ্ট্রায়ত্ত তেল কোম্পানিগুলোর উপর নিয়ন্ত্রণে কঠোরতা আরোপ করেন। তাই ২০০২ সালে তাকে ক্ষমতা থেকে সরানোর জন্য ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থান করা হয়।

তিনি এ ঘটনার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করেন। ২০০৬ সালে এবং ২০১২ সালে যথাক্রমে তৃতীয় দফা ও চতুর্থ দফা নির্বাচনে তিনি পুনরায় প্রেসিডন্ট নির্বাচিত হন।

তার শাসনামলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে কিউবায় তেল রপ্তানি করে ভেনিজুয়েলা। তিনি আজীবন পশ্চিমা শাসকদের সাম্রাজ্যবাদী শোষণের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ইরাক আক্রমণের ঘোর বিরোধিতা করেছিলেন।

নব্য সাম্রাজ্যবাদী শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রামের অংশ হিসেবে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা সমালোচনা করেছিলেন। তিনি কলম্বিয়ায় মাদক সরবরাহ বন্ধে যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দিয়েছিলেন।

এমনকি সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশকে তিনি “গাধা” ও “শয়তান” বলতেও দ্বিধা করেননি।

তবে মানবিক ক্ষেত্রে উদার ছিলেন শ্যাভেজ। হারিকেন ক্যাটরিনা এবং হারিকেন রিতার আঘাতে যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কিছু তেল শোধনাগার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এ সময় ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যে তিনি আমেরিকায় তেল সহায়তা দিয়েছিলেন।

২০০৬ সালে তিনি কাস্ত্রোর নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক মুক্তবাণিজ্য সংগঠন “বলিবারিয়ান অল্টারনেটিভ ফর আমেরিকাস” প্রতিষ্ঠা করতে সহায়তা করেন।

বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করেছেন এই মহান নেতা। তিনি জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন।

২০১১ সালে তার শরীরে ক্যান্সার ধরা পড়ে। ক্যান্সারের সাথে দীর্ঘ লড়াই শেষে ২০১৩ সালের ৫ মার্চ মারা যান শ্যাভেজ। তার মরদেহ ভেনিজুয়েলার কারাকাস মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে।

শ্যাভেজ ছিলেন সাম্রাজ্যবাদী অন্যায় ও জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে এক বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। এক সাহসী বীর যোদ্ধা। তাই তার মৃত্যুতে চিরচেনা অদম্য সাহসী এক বিপ্লবীর জীবনাবসান ঘটেনি। সমাপ্তি ঘটে এক বিপ্লবী ইতিহাসের।

 

ইন্টারনেট অবলম্বনে লিখেছেন এনামুল হক

Share this news on:

সর্বশেষ

img
বাঙালি দর্শকের সিনেমা রুচির বিবর্তন: সুব্রত গুহ রায় Nov 02, 2025
img
গান বন্ধের সঠিক সময় নিয়ে পরামর্শ দিলেন কৌশিক গাঙ্গুলি Nov 02, 2025
img
চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ ১৮ নভেম্বর : ইসি সচিব Nov 02, 2025
img
ক্যান্সার নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির আহ্বান জানাল প্রধান উপদেষ্টা Nov 02, 2025
img

আইসিসি নারী বিশ্বকাপ

নারী বিশ্বকাপের ফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টসে হেরে ব্যাটিংয়ে ভারত Nov 02, 2025
img
উপহারের সেই নৌকা জমা দিলেন জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির Nov 02, 2025
img
এমবাপের জোড়া গোল, ভ্যালেন্সিয়ার বিপক্ষে দাপুটে জয় রিয়ালের Nov 02, 2025
img
ইন্ডাস্ট্রি আমাকে ইউজ করেনি, করতেই পারত : ইন্দ্রানী দত্ত Nov 02, 2025
img
নিজের মূল্যবোধে অটল অভিনেত্রী ইশা সাহা Nov 02, 2025
img
জন্মদিনে কিং খানকে শুভেচ্ছা বার্তা মমতা ব্যানার্জির Nov 02, 2025
img
সমাজে অভিনেত্রীর ভুল ধারণা বদলাতে হবে : ঋতাভরী চক্রবর্তী Nov 02, 2025
img
স্বাধীনতা-গণতন্ত্র ও দেশপ্রেমের চেতনায় উজ্জীবিত ছাত্রদল : এ্যানি Nov 02, 2025
img
নারী ওয়ানডে বিশ্বকাপ ফাইনালে বৃষ্টির হানা, আছে রিজার্ভ ডে Nov 02, 2025
img
মায়ের শিক্ষা থেকে গড়ে উঠেছে মিমি দত্তের দৃঢ় মনোভাব Nov 02, 2025
img
প্রতীক হিসেবে ‘শাপলা কলি’ নিতে সম্মত এনসিপি, জানালেন পাটওয়ারী Nov 02, 2025
img
সমালোচনার মধ্যেও অভিনয়ে অরিজিতার দৃঢ়তা Nov 02, 2025
আবারও নেতৃত্বে নাজমুল হোসেন শান্ত Nov 02, 2025
img
সিডনির হাসপাতাল থেকে ফিরলেন শ্রেয়াস আইয়ার Nov 02, 2025
দেশের বাজারে আবারও বেড়েছে পেঁয়াজের ঝাঁঝ! Nov 02, 2025
আওয়ামী লীগের বিষয়ে যে মন্তব্য করলেন মাসুদ কামাল Nov 02, 2025