এলিনর রুজভেল্ট: সার্বজনীন মানবাধিকারের রূপকার

এলিনর রুজভেল্ট। একজন বিখ্যাত মার্কিন রাজনীতিবিদ, কূটনীতিক ও মানবাধিকার কর্মী। তিনি ৩২তম মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্টের স্ত্রী। যিনি ১৯৩৩-১৯৪৫ সালে চার মেয়াদে মার্কিন ফার্স্ট লেডি হিসেবে দায়িত্বপালন করেছেন। আর তিনিই ছিলেন মার্কিন ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘ সময় দায়িত্ব পালনকারী ফার্স্ট লেডি।

১৮৮৪ সালের ১১ অক্টোবর নিউইয়র্কের ম্যানহাটন সিটিতে এলিনর রুজভেল্ট জন্মগ্রহণ করেন। বাবার দিক থেকে তিনি সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্টের ভাইঝি। শৈশবেই তিনি বাবা-মাকে হারান। বাবা-মার মৃত্যুর পর তিনি নানীর কাছে বড় হয়েছেন। ১৫ বছর বয়সে তিনি ইংল্যান্ডে চলে যান। ১৮৯৯-১৯০২ পর্যন্ত তিনি সেখানে লেখাপড়া করেছেন। ১৯০২ সালে তিনি পুনরায় নিউইয়র্কে চলে আসেন।

ওই বছরই একদিন ট্রেনে ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্টের সঙ্গে তার দেখা হয়। প্রথম দেখায়ই তারা একে অপরের প্রেমে পড়ে যান। ১৯০৩ সালের নভেম্বরে তাদের বাগদান হয়ে যায়। কিন্তু ফ্রাঙ্কিলন রুজভেল্টের মা এই বিয়ের বিরোধিতা করেন। নানা ঘটনার পর ১৯০৫ সালে তাদের বিয়ে হয়। এমনকি প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্ট এই বিয়েতে উপস্থিত ছিলেন।

একে একে ছয় সন্তান এই দম্পতির ঘর আলোকিত করেছে। কিন্তু ১৯১৮ সালের সেপ্টেম্বরে এলিনর আবিষ্কার করলেন যে- তার স্বামী ফ্রাঙ্কলিনের সঙ্গে লুসি মার্কার নামে এক নারীর সম্পর্ক চলছে। ডিভোর্স না দিলেও এরপর থেকে তিনি একজন স্ত্রীর ভূমিকার পরিবর্তে একজন মানবাধিকার কর্মী হিসেবে বিভিন্ন সমাজসেবামুলক কাজে নিজেকে জড়িত রাখেন।

১৯২১ সালে ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট পোলিও রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। এসময় এলিনর রুজভেল্টের অক্লান্ত পরিশ্রম আর সেবাযত্নে সুস্থ হয়ে উঠেন ফ্রাঙ্কলিন। তবে ফ্রাঙ্কলিনের পা স্থায়ীভাবে প্যারালাইজড হয়ে যায়। তাই অনেকেই তাকে রাজনীতি থেকে অবসর নিতে বলেন। কিন্তু এলিনর তাকে রাজনীতি চালিয়ে যেতে উৎসাহ-উদ্দীপনা দেন এবং সব ধরনের সহযোগিতা দিয়ে যান। ফ্রাঙ্কলিনের প্রতি স্ত্রী এলিনরের এমন সার্থক ভূমিকার প্রশংসা করে তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক এলিনরের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন যে, “তুমি এক দুর্লভ স্ত্রী এবং তুমি অনেক বড় একটি বোঝাকে অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে বহন করেছো”। এভাবেই তিনি সামাজিক ও রাজনৈতিক কাজের পাশাপাশি একজন সার্থক স্ত্রীর ভূমিকায় ছিলেন সমান পারদর্শী।

এলিনর ১৯২০ সালের দিকে শিক্ষকতা শুরু করেন। এরপর থেকে ধীরে ধীরে রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। একপর্যায়ে ডেমোক্রেট পার্টির একজন প্রভাবশালী নেতা হয়ে যান। তার রাজনৈতিক কার্যক্রম স্বামী ফ্রাঙ্কলিনের পক্ষে জনসমর্থন আদায় করতে সাহায্য করে। বিশেষ করে নারী ও শ্রমিকদের ভোট সংগ্রহ করতে ভূমিকা রাখে।

১৯২৮ সালে ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট নিউইয়র্কের গভর্নর পদে এবং ১৯৩২ সালে প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন করেন। এসব নির্বাচনে তার পক্ষে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বক্তব্য দেয়ার পাশাপাশি জনসমর্থন আদায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন এলিনর। ১৯৩৩ সালে ফ্রাঙ্কলিন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এবং বেকারত্ব নিরসন ও অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে ‘নিউ ডিল’ নামে নতুন সংস্কার কর্মসূচি চালু করেন। মার্কিন ফার্স্ট লেডি হিসেবে এ কর্মসূচি বাস্তবায়নসহ বেকারত্ব হ্রাস করতে তিনি ব্যাপক ভূমিকা রাখেন।

চার মেয়াদের দায়িত্বকালে ফার্স্ট লেডি হিসেবে তিনি এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনিই ছিলেন প্রথম কোনো মার্কিন ফার্স্ট লেডি, যিনি নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে অংশ নিয়েছেন, দৈনিক সংবাদপত্রে ও মাসিক ম্যাগাজিনে কলাম লিখেছেন, সাপ্তাহিক রেডিও শোতে উপস্থাপনা করেছেন এবং জাতীয় সম্মেলনে অংশ নিয়েছেন। প্রয়োজনে কখনো কখনো তিনি স্বামীর বিভিন্ন নীতির বিরোধিতা করেছেন।

তিনি বেকার খনি শ্রমিকদের জন্য পরীক্ষামুলক কমিউনিটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যদিও তার এই কার্যক্রম সফল হয়নি। এছাড়া কর্মক্ষেত্রে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায়, আফ্রিকান-আমেরিকান ও এশিয়ান-আমেরিকানদের নাগরিক অধিকার আন্দোলনে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শরণার্থীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তিনি কাজ করেছেন।

১৯৪৫ সালে ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট মারা যাওয়ার পরও প্রায় ১৭ বছর তিনি রাজনৈতিক কার্যক্রম চালিয়ে গেছেন। জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠায় সমর্থন দিতে এবং জাতিসংঘে যোগ দিতে তিনি যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে চাপ প্রয়োগ করেন। তিনি ছিলেন জাতিসংঘে নিযুক্ত প্রথম মার্কিন প্রতিনিধি। যিনি জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক কমিশনের প্রথম চেয়ারম্যান ছিলেন। এই কমিশনের অধীনে ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘে সার্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণাপত্র অনুমোদিত হয়। এ ঘোষণার খসড়া প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন এলিনর রুজভেল্ট।

অবশেষে ১৯৬২ সালের ৭ নভেম্বর ৭৮ বছর বয়সে এই মহান ব্যক্তিত্ব মারা যান। মৃত্যুকালে তিনি ছিলেন বিশ্বের সবচেয়ে প্রশংসিত ব্যক্তিদের একজন। দ্য নিউইয়র্ক টাইমস তাকে ‘দ্য অবজেক্ট অব অলমোস্ট ইউনিভার্সাল রেসপেক্ট’ বলে মন্তব্য করে। ১৯৯৯ সালে গ্যালাপস কর্তৃক বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে প্রশংসিত ব্যক্তিদের তালিকায় শীর্ষ দশে তার অবস্থান ছিল নবম।

তার জীবনীর উপর ভিত্তি করে ১৯৬৫ সালে ‘দ্য এলিনর রুজভেল্ট স্টোরি’ নামে ডকুমেন্টারি ফিল্ম তৈরি করেন রিকার্ড ক্যাপল্যান। যা ওই বছরই বেস্ট ডকুমেন্টারি বিভাগে অস্কার পুরস্কার পায়। এছাড়া আরও বেশ কিছু টিভি প্রোগ্রাম এবং সাহিত্যের উপজীব্য বিষয় ছিল এলিনর রুজভেল্ট।

 

টাইমস/ইএইচ/জিএস

Share this news on:

সর্বশেষ

ফ্রিতে কুরআন পেয়ে আনন্দিত শিক্ষার্থীরা! Oct 29, 2025
img
যমজ সন্তানের বাবা হওয়ায় দেরিতে দলের সঙ্গে যোগ দেবেন ক্যাবরেরা Oct 29, 2025
img
নভেম্বরকে টার্গেট করেছে দেশি-বিদেশি চক্র, সতর্ক না হলে সর্বনাশ: রনি Oct 29, 2025
'উনি শান্তিতে নোবেল পাইছে, ওনার দেশের শিক্ষকরা কেন রাজপথে ?' Oct 29, 2025
প্রেসক্লাবের সামনে ইবতেদায়ী শিক্ষকের আহাজারি Oct 29, 2025
img

রয়টার্সকে সাক্ষাৎকার

ক্ষমা চাইতে রাজি নন শেখ হাসিনা থাকতে চান ভারতেই Oct 29, 2025
img
ঐকমত্য কমিশনের প্রতিবেদন সহজবোধ্য করে উন্মুক্ত করুন: প্রধান উপদেষ্টা Oct 29, 2025
img
অক্টোবরের ২৮ দিনে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ২৩৪ কোটি ডলার Oct 29, 2025
img
দুদকের সংশোধন অধ্যাদেশ অনুমোদনে টিআইবির উদ্বেগ Oct 29, 2025
img
স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হয়নি : রেজাউল করীম Oct 29, 2025
img
নিজ জেলা বা শ্বশুরবাড়ি এলাকায় ডিসি-এসপিদের পদায়ন নয় : প্রেসসচিব Oct 29, 2025
img
বিশ্ব ব্যাংকে সালিশি মামলা করেছেন এস আলম Oct 29, 2025
img
একাত্তরের অপরাধের জন্য জামায়াতের বিচার চলমান রাখা জরুরি: রনি Oct 29, 2025
img
জুলাই সনদ বাস্তবায়ন না হলে নির্বাচন হওয়ার কোনো সুযোগ নেই: নাহিদ ইসলাম Oct 29, 2025
img
অপপ্রচার নিয়ন্ত্রণে টিকটক প্রতিনিধিদের সঙ্গে ইসির বৈঠক Oct 29, 2025
img
পারমাণবিকসমৃদ্ধ আন্ডারওয়াটার ড্রোনের সফল পরীক্ষা রাশিয়ার Oct 29, 2025
img
দিল্লিতে দূষণ কমাতে কৃত্রিম বৃষ্টির চেষ্টা ব্যর্থ Oct 29, 2025
img
ড. ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাতে যে আলোচনা করলেন সালাউদ্দিন পুত্র সৈয়দ ইব্রাহিম Oct 29, 2025
img
ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে জাতীয় নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা Oct 29, 2025
img
সিরিজ বাঁচানোর ম্যাচে বাংলাদেশকে ১৫০ রানের টার্গেট দিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ Oct 29, 2025