‘বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক চীন, রাশিয়া দিয়ে নির্ধারিত হয় না’

রাশিয়া, চীন কিংবা অন্য কোনো দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বিবেচনায় নিয়ে ওয়াশিংটন ঢাকার সঙ্গে সম্পর্ক নির্ধারণ করে না বলে জানিয়েছেন মার্কিন উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আফরিন আখতার।

চলতি সপ্তাহে ঢাকায় বাসসকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা জানান।

আফরিন আখতার বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্ক চীন, রাশিয়া ও অন্য কোনো দেশ দ্বারা নির্ধারিত হয় না।’ তিনি বলেন, বহুমুখী ও বহুমাত্রিক সম্পর্কে আবদ্ধ ঢাকা ও ওয়াশিংটনের মধ্যে অনেক মিল রয়েছে। যেমন ঢাকা সম্প্রতি ইন্দো-প্যাসিফিক আউটলুক (আইপিও) প্রকাশ করেছে, যার অনেক কিছুর সঙ্গে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগর কৌশলের (আইপিএস) অভিন্নতা রয়েছে।

মার্কিন উপসহাকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা ব্যাপকভাবে দুই দেশের নথিপত্র, আমাদের কৌশল ও আপনাদের (বাংলাদেশের) দৃষ্টিভঙ্গির মাঝে অনেক মিল পেয়েছি। আমরা উভয়ে অবকাঠামো ও উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে এ অঞ্চলে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি গড়ে তোলার দিকে মনোনিবেশ করেছি।’

বাংলাদেশ অবাধ, উন্মুক্ত, শান্তিপূর্ণ, নিরাপদ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের স্বপ্ন নিয়ে গত মাসে আইপিও প্রকাশ করেছে, সেখানে ঢাকার যে মনোভাব ফুটে উঠেছে, তার সঙ্গে আইপিএসের মিল রয়েছে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রও আইপিএসের মাধ্যমে এ অঞ্চলের জন্য একই মনোভাব পোষণ করছে।

আফরিন আখতারের মন্তব্যটি এসেছে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের বক্তব্যের কয়েক মাস পর। পিটার হাস বলেছিলেন, ওয়াশিংটন কোনো দেশকে অন্যান্য দেশের সঙ্গে, বিশেষ করে বেইজিংয়ের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে পক্ষ বেছে নিতে বাধ্য করে না। কারণ ‘আমরা আশা করি না যে প্রতিটি দেশ আমাদের মতো চীনের একইভাবে মূল্যায়ন করবে।’

হাস অবশ্য বলেছিলেন, ইউক্রেনে রাশিয়ার পদক্ষেপ ‘উন্মুক্ত, আন্তঃসংযুক্ত সমৃদ্ধি, নিরাপদ ও স্থিতিশীল ইন্দো-প্যাসিফিক’–এর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনা বর্তমানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।

আফরিন আখতার জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদার সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যৌথ বিবৃতির কথা উল্লেখ করে ধন্যবাদ জানান। যেই যৌথ বিবৃতিতে আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘ সনদ লঙ্ঘন করে ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের নিন্দা জানানো হয়।

তিনি বলেন, ‘আমি শুধু রাশিয়া সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক বক্তব্যের কথা বলতে চাই...আমরা সত্যিকার অর্থে ইতিবাচকভাবে একে স্বাগত জানাই।’

ইন্দো-প্যাসিফিক আউটলুক
ইন্দো-প্যাসিফিক আউটলুক (আইপিও) বিষয়ে ঢাকা ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়ে আফরিন আখতার বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের আইপিএস এবং বাংলাদেশের আইপিও- এই দুই নথিতে প্রচুর মিল রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও জাপানের অনানুষ্ঠানিক কৌশলগত ফোরাম কোয়াডের অন্যান্য সদস্য বাংলাদেশের আইপিওকে স্বাগত জানিয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর চলতি সপ্তাহে বলেছেন, বাংলাদেশের দৃষ্টিভঙ্গিতে ‘আমরা সন্তুষ্ট’।

আফরিন আখতার বলেন, বাংলাদেশের আইপিওতে ‘সমুদ্র নিরাপত্তা’ বিষয়ে জোর দেওয়া হয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্র ও অন্য কোয়াড সদস্যদের কাছেও গুরুত্বপূর্ণ। তাই আমরা এ বিষয়ে সহযোগিতা অব্যাহত রাখার সুযোগ তৈরির চেষ্টা করব।

তিনি বলেন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশ আইপিওর গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, যেখানে বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্র শীর্ষ রপ্তানি গন্তব্য এবং বাংলাদেশে শীর্ষ বিনিয়োগকারী। সুতরাং আমরা আবারো আগামী বছরগুলোতে এটিই তৈরি করতে চাই।

নিরাপত্তা সহযোগিতা
মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এই উপসহকারী মন্ত্রী বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে জেনারেল সিকিউরিটি অব মিলিটারি ইনফরমেশন অ্যাগ্রিমেন্টের (জিএসওএমআইএ) অবশিষ্ট বিষয় নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করছে, যা সরকার থেকে সরকারের মধ্যকার একটি মৌলিক চুক্তি। এটি ব্যাপক সহযোগিতার সুযোগ তৈরি করবে।তিনি বলেন, ‘আমরা আশা করছি, (জিএসওএমআইএ) আগামী কয়েক মাসের মধ্যে স্বাক্ষরিত হবে।’ জিএসওএমআইএ হলো যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য সরকারের মধ্যে তাদের নিরাপত্তা সহযোগিতাসংক্রান্ত গোপন সামরিক তথ্য সুরক্ষার একটি পারস্পরিক আইনগত বাধ্যতামূলক চুক্তি।

আফরিন আখতার বলেন, ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের প্রতিরক্ষা অ্যাটাশে নিরাপত্তা সহযোগিতা নিয়ে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে নিয়মিতভাবে আলোচনা করেন। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র তার ইন্দো-প্যাসিফিক মেরিটাইম ডোমেইন অ্যাওয়ারনেস ইনিশিয়েটিভের (আইপিএমডিএ) অধীনে সমুদ্র এলাকায় একটি অভিন্ন পরিচালনা কার্যক্রম উন্নয়নে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলোতে রাডার প্রযুক্তি সরবরাহের পরিকল্পনা করেছে।

র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের উপসহকারী মন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের অপরাধবিরোধী এলিট বাহিনী র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) ওপর নিষেধাজ্ঞার পর ‘বিচারবহির্ভূত হত্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে’ যাওয়া দেখে ওয়াশিংটন সন্তুষ্ট।

তিনি বলেন, ‘আমরা বিচারবহির্ভূত হত্যা কমে যাওয়াকে স্বাগত জানাই...তবে আমাদের দীর্ঘ মেয়াদে এই প্রবণতার স্থায়িত্ব, র‌্যাবের আচরণের ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা দরকার।’ তিনি আরও বলেন, আমি বলব যে র‌্যাবের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার ক্ষেত্রে, নিষেধাজ্ঞা অপসারণের জন্য আমাদের দীর্ঘমেয়াদি পদ্ধতিগত পরিবর্তন দেখতে হবে।’

আফরিন আখতার বলেন, বাংলাদেশের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং বিশেষ করে ‘কোথায় আইনটি প্রয়োগ করা হচ্ছে’- তা নিয়ে ওয়াশিংটন উদ্বিগ্ন।

রোহিঙ্গা ইস্যু
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এই উপসহকারী মন্ত্রী বলেন, তার দেশ সঠিক পরিস্থিতিতে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের মাধ্যমে সংকটের দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই সমাধানের উপায় খুঁজতে কাজ করে যাচ্ছে। তিনি এ কাজকে কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং বলে বর্ণনা করেন।

তিনি বলেন, ‘আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতি স্বেচ্ছায় নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের নিশ্চয়তা দিচ্ছে না এবং আমরা মিয়ানমারে লোকজনকে জোর করে যেকোনো প্রত্যাবাসন প্রচেষ্টার বিরোধিতা করব।’

আফরিন আখতার বলেন, গত ডিসেম্বরে শুরু হওয়া তৃতীয় কোনো দেশে পুনর্বাসন উদ্যোগের আওতায় যুক্তরাষ্ট্র নিজ দেশে ভবিষ্যতে আরও বেশি রোহিঙ্গাকে নিতে পারে।

বিনিয়োগ পরিকল্পনা
মার্কিন সরকার বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশের পরিচ্ছন্ন জ্বালানি খাতের ওপর জোর দিচ্ছে উল্লেখ করে আফরিন আখতার বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশের সঙ্গে সহযোগিতার সুযোগ খুঁজব এবং (জ্বালানি খাতে সহায়তার জন্য) অপেক্ষা করব।’

তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারি খাতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক অবিশ্বাস্যভাবে শক্তিশালী, যদিও মার্কিন ব্যবসায়ীদের আকৃষ্ট করতে বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রক পরিবেশ আরও উন্নত করা দরকার।

মার্কিন উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘এখানে আমাদের বাণিজ্য অ্যাটাশে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে আরও স্বচ্ছ এবং যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারি খাতের বিনিয়োগকারীদের জন্য আরও আকর্ষণীয় করতে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কাজ করছেন।’

তিনি বলেন, এখানকার মার্কিন দূতাবাসের শ্রম অ্যাটাশেও ইউনিয়ন নিবন্ধন এবং শ্রম আইনের অভিন্ন প্রয়োগের ক্ষেত্রে শ্রম পরিস্থিতির উন্নতিতে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে যাচ্ছে।

উল্লেখ্য, ঢাকায় ১২ থেকে ১৩ মে অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ ভারত মহাসাগরীয় সম্মেলনে মার্কিন প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন আফরিন আখতার।

Share this news on:

সর্বশেষ

img
‘ঘনিষ্ঠ দৃশ্যের আগে দাঁতও মাজেনি!’, সহ-অভিনেতার অপরিচ্ছন্নতায় বিদ্যার অস্বস্তি Jul 24, 2025
img
শোকের রাতে রাজনৈতিক নাটক, মানবিকতা কোথায়? : মাসুদ কামাল Jul 24, 2025
img
নির্বাচন পেছাতে একটি শ্রেণিকে মাঠে রাখা হয়েছে : জাহেদ উর রহমান Jul 24, 2025
img
প্রথম বিদেশ সফরে কুয়ালালামপুর গেলেন পররাষ্ট্রসচিব Jul 24, 2025
img
রাষ্ট্রের অর্থের অভাব পড়ল কোথায়, জানতে হবে : রনি Jul 24, 2025
img
দুধ দিয়ে গোসল করে রাজনীতি ছাড়লেন নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতা Jul 24, 2025
img
কারাগারের ভেতরে ধর্ম উপদেষ্টার সঙ্গে আ.লীগ এমপিদের ছবি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে Jul 24, 2025
img
‘ওয়ার ২’ তে চমক হিসাবে শেষে থাকছে ‘আলফা’র আলিয়া-শারভারি Jul 24, 2025
img
স্বাস্থ্য পরীক্ষা শেষে গুলশানের বাসায় ফিরলেন খালেদা জিয়া Jul 24, 2025
img
শাহিদ কাপুরকে নিয়ে ‘ছত্রপতি শিবাজি’ হচ্ছেনা, ক্ষুব্ধ পরিচালক অমিত রাই Jul 24, 2025
পরাজিত শক্তির নানা ষড়যন্ত্রের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, জানালেন প্রধান উপদেষ্টা Jul 24, 2025
যেভাবে পরকীয়া প্রেমিকের কাহিনী শুনিয়েছিলেন টুনি নিজেই Jul 24, 2025
পুলিশ কর্মকর্তার গাড়িতে সেনা তল্লাশি Jul 24, 2025
প্রিজন ভ্যানে অঝোরে কাঁদলেন পলক, দোয়ার আকুতি Jul 24, 2025
ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে সিপিবি, বাসদ ও বাংলাদেশ জাসদের ‘ওয়াকআউট Jul 24, 2025
জনবহুল শহরে উড়ছে সামরিক বিমান, খালি পরে আছে ছয়টিরও বেশি এয়ারফিল্ড Jul 24, 2025
১০ মিনিটে গোটা বিশ্বের সারাদিনের সর্বশেষ আলোচিত সব খবর Jul 24, 2025
img
এনসিপির নিবন্ধনই নাই, বড় দল হিসেবে কীভাবে তাদের সরকার ডাকে : নুরুল হক নুর Jul 24, 2025
img
‘আমার পরিণতি সুশান্তের মতো’, আশঙ্কায় অভিনেত্রী তনুশ্রী দত্ত Jul 24, 2025
img
হামলার এক দিন আগেও পহেলগাঁওয়ে ছিলেন দীপিকা-শোয়েব Jul 24, 2025