দেশবাসীর প্রত্যাশা অনেকাংশেই পূরণ করতে সক্ষম হয়েছি : প্রধানমন্ত্রী

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, স্বাধীনতার ৫৩তম বার্ষিকীতে আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে চাই, আমরা দেশবাসীর প্রত্যাশা অনেকাংশেই পূরণ করতে সক্ষম হয়েছি। এটা কোনো অসার বাগাড়ম্বর দাবি নয়। বাংলাদেশ আজ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে উন্নয়নশীল বিশ্বে একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আমরা প্রমাণ করেছি রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে সীমিত সম্পদ দিয়েও একটি দেশকে এগিয়ে নেওয়া যায়।

মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষ্যে সোমবার (২৫ মার্চ) সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে হত্যার পর অস্ত্রের মুখে সামরিক শাসকেরা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে।
জনগণের মৌলিক অধিকার হরণ করে কায়েম করে একনায়কতন্ত্র। স্থবির হয়ে পড়ে যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের জাতির পিতার নেওয়া সব কার্যক্রম।

জনগণের ভাগ্যোন্নয়নের পরিবর্তে ক্ষমতাসীনরা তাদের নিজেদের ভাগ্য বদলাতে বিভোর হয়ে থাকে।

ভাষণের শুরুতেই সরকারপ্রধান দেশে ও দেশের বাইরে বসবাসকারী বাংলাদেশের সব নাগরিককে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও রমজানের মোবারকবাদ জানান।

তিনি বলেন, স্বাধীনতা দিবসের এই মাহেন্দ্রক্ষণে আমি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে। যার অবিসংবাদিত নেতৃত্ব এবং অপরিসীম আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা অর্জন করেছি মহান স্বাধীনতা। স্মরণ করছি জাতীয় চার নেতা- সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এএইচএম কামারুজ্জামানকে। শ্রদ্ধা জানাচ্ছি মুক্তিযুদ্ধের ত্রিশ লাখ শহীদ এবং দুই লাখ নির্যাতিত মা-বোনকে। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও সালাম।

শেখ হাসিনা বলেন, আমি গভীর বেদনার সঙ্গে আরও স্মরণ করছি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকদের বুলেটে নিহত আমার মা বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিব, তিন ভাই- বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ক্যাপ্টেন শেখ কামাল, বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ লে. শেখ জামাল, ১০ বছরের শিশু শেখ রাসেল, কামাল ও জামালের নবপরিণীতা বধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল, আমার চাচা বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবু নাসের, বীর মুক্তিযোদ্ধা যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মণি, বীর মুক্তিযোদ্ধা কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, ব্রিগেডিয়ার জামিল এবং পুলিশের এএসআই সিদ্দিকুর রহমানসহ সেই রাতের সব শহীদকে। আমি সবার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। ১৯৭৫ পরবর্তী গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং ভোট ও ভাতের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নিহত সব শহীদকে আমি স্মরণ করছি।

‘প্রিয় দেশবাসী, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের মাধ্যমে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ টানা চতুর্থবার এবং ১৯৭৫-এর পর পঞ্চমবারের মত সরকার গঠন করেছে। একই সঙ্গে আমার দল আমাকে পঞ্চমবারের মত প্রধানমন্ত্রীর গুরুদায়িত্ব অর্পণ করেছে।’

‘দেশবাসীর প্রতি আমার কর্তব্য হিসেবে এবং আমার পিতা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ার কাজ আরও এগিয়ে নেওয়ার জন্য আমি বারবার এ দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছি। আমি চেষ্টা করেছি সবার সমর্থন এবং সহযোগিতা নিয়ে এদেশের সাধারণ মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের মাধ্যমে তাদের মুখে হাসি ফোটাবার।’

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পর অস্ত্রের মুখে সামরিক শাসকেরা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে। জনগণের মৌলিক অধিকার হরণ করে কায়েম করে একনায়কতন্ত্র। স্থবির হয়ে পড়ে যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে জাতির পিতার নেওয়া সব কার্যক্রম। জনগণের ভাগ্যোন্নয়নের পরিবর্তে ক্ষমতাসীনরা নিজেদের ভাগ্য বদলাতে বিভোর হয়ে থাকে।

১৯৯৬ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ একুশ বছরের ইতিহাস এদেশের মানুষের নিপীড়ন আর বঞ্চনার ইতিহাস। এসময় লুটপাট, দুর্নীতি, ইতিহাস বিকৃতি, মৌলবাদ এবং জঙ্গিবাদ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের মৌল চেতনাকে ধূলিস্যাৎ করে বাংলাদেশকে একটি অকার্যকর এবং পশ্চাদপদ দেশের তকমা পড়িয়ে দেওয়া হয়।

‘নিদারুণ দারিদ্র্য, ক্ষুধা, অকাল মৃত্যু এবং শিক্ষা, বাসস্থান, চিকিৎসার অভাব ছিল এদেশের মানুষের নিত্যদিনের সঙ্গী। সাধারণ মানুষ এসব বঞ্চনাকে ভাগ্যের লিখন হিসেবে মেনে নিতো। তখন মানুষকে বুঝতেই দেওয়া হয়নি যে, তাদের প্রতি সরকারের দায়িত্ব ও কর্তব্য বলে কিছু আছে।’

‘১৯৯৬ সালে জনগণের ভোটে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে জনবান্ধব নীতি গ্রহণ করা শুরু করে। ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে কৃষকদের জন্য বিভিন্ন কল্যাণমূলক কর্মসূচি এবং ভূমিহীন, দুস্থ মানুষের জন্য বয়স্ক ভাতা, দুস্থ নারী ও বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, আশ্রয়হীনদের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্প, আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্প, কমিউনিটি ক্লিনিক, নিরক্ষরতা দূর করা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষার বিস্তার, যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু সেতুসহ ব্যাপক অবকাঠামো উন্নয়ন বাস্তবায়নের মাধ্যমে সরকারি সেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করি আমরা। এই সর্বপ্রথম সাধারণ মানুষ বুঝতে পারেন তাদেরও সরকারি সেবা পাওয়ার অধিকার রয়েছে।’

‘প্রিয় দেশবাসী, আপনাদের ম্যান্ডেট নিয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বিগত পনের বছরের অধিক সময় ধরে সরকার পরিচালনা করছে। এই পনের বছরের অভিযাত্রা একেবারেই কুসমাস্তীর্ণ ছিল না। প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগ, মহামারি, যুদ্ধ, আন্তর্জাতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতি এবং সর্বোপরি দেশি-বিদেশি শক্তির নানা ষড়যন্ত্র আমাদের চলার পথকে বাধাগ্রস্ত করেছে বারবার। ঘূর্ণিঝড় আইলা ও সিডর এবং কয়েক দফা প্রলয়ঙ্করী বন্যা উপকূলীয় এবং নিম্নাঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকায় ব্যাপক প্রভাব ফেলে।’

শেখ হাসিনা বলেন, করোনাভাইরাস মহামারির কারণে শুধু আমাদের দেশের নয়, গোটা বিশ্বের অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়েছিল। সে ধকল কাটতে না কাটতেই ২০২২ সালের গোড়ার দিকে শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এই যুদ্ধকে কেন্দ্র করে অর্থনৈতিক অবরোধ-পাল্টা অবরোধ আরোপের ফলে আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশগুলো চরম সঙ্কটের মুখে পড়েছে। নিত্যপণ্যের উৎপাদন ও বিপণন যেমন ব্যাহত হচ্ছে, তেমনই এসব পণ্যের স্বাভাবিক চলাচলও বাধাগ্রস্ত হওয়ায় পণ্যের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর সঙ্গে গত বছরের শেষে যুক্ত হয়েছে গাজায় ফিলিস্তিনের ওপর ইসরায়েলি বাহিনীর গণহত্যা।

‘প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগও জনজীবনে কম দুর্ভোগের কারণ হয়নি। ২০১৩-১৪ সময়ে এবং ২০১৬ সালে বিএনপি-জামাতের দেশব্যাপী হরতাল-অবরোধ, অগ্নিসন্ত্রাস, অগণিত মানুষ হত্যার মত নৃশংসতা এখনো জনমনে গভীর দাগ কেটে আছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপি এবং তার মিত্ররা এবারও হরতাল-অবরোধ, অগ্নিসংযোগের মত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সূচনা করেছিল। কিন্তু জনগণের প্রতিরোধের মুখে এবার তাদের পিছু হটতে বাধ্য হতে হয়। তবুও তাদের হাতে বেশ কয়েকজন নিরীহ মানুষ প্রাণ হারান এবং কয়েকশো কোটি টাকার সম্পদ বিনষ্ট হয়।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, এসব অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করে আমরা দেশের অগ্রযাত্রাকে আরও বেগবান করার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বিগত দেড় দশকে আর্থ-সামাজিক খাতে বাংলাদেশের অভূতপূর্ব রূপান্তর ঘটেছে। অভ্যন্তরীণ এবং বাইরের অভিঘাত মোকাবিলা করে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। কৃষি, শিল্প, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিশু ও মাতৃমৃত্যু হার, দারিদ্র্য বিমোচন, অবকাঠামো উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়নসহ সব খাতে আজকে দৃশ্যমান পরিবর্তন লক্ষ্যণীয়। এক সময়ের দারিদ্র্য-জ্বরাক্লিষ্ট বাংলাদেশ আজ সক্ষম উদীয়মান অর্থনীতির দেশ।

Share this news on:

সর্বশেষ

img
ইলিশ রক্ষা অভিযানে পিরোজপুরে ২০টি অবৈধ জাল জব্দ Oct 09, 2025
img
বিশ্ব দৃষ্টি দিবস আজ Oct 09, 2025
img
অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদের মৃত্যুতে প্রধান উপদেষ্টার শোক প্রকাশ Oct 09, 2025
img
না ফেরার দেশে আর্জেন্টিনার সাবেক ফুটবলার ও বোকা জুনিয়র্সের কোচ Oct 09, 2025
img
ভোলায় নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ইলিশ শিকার, আটক ৮ জেলে Oct 09, 2025
img
মৌসুমি বায়ুর প্রভাব কমায় কমছে বৃষ্টির প্রবণতা Oct 09, 2025
img
খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে নিয়ে লালুর বক্তব্য ব্যক্তিগত: বিএনপি Oct 09, 2025
img
এশিয়ান কাপ বাছাইয়ে আজ হংকংয়ের মুখোমুখি হবে বাংলাদেশ Oct 09, 2025
img
জেনে নিন, দেশে কত দামে স্বর্ণ বিক্রি হচ্ছে আজ? Oct 09, 2025
img
আজ আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেবেন আসিফ মাহমুদ Oct 09, 2025
img
বিমানবন্দরের তার চুরি করতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে প্রাণ গেল যুবকের Oct 09, 2025
img
ইতিহাস গড়তে সৌদি ক্লাবের দায়িত্বে সাবেক পর্তুগিজ উইঙ্গার কন্সেইসাও Oct 09, 2025
img
খুব দ্রুত ভিসা জটিলতা দূর করার নির্দেশ প্রধান উপদেষ্টার Oct 09, 2025
img
রাজধানীতে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের ৭ নেতাসহ গ্রেপ্তার ১১ Oct 09, 2025
img
বিশ্বকাপ বাছাই থেকে ছিটকে গেলেন ডিফেন্ডার ডিন হাউসেন Oct 09, 2025
খালেদা জিয়াকে দেখে নেতা বললেন - আজ ঈদের চেয়েও খুশি Oct 09, 2025
১০ মিনিটে গোটা বিশ্বের সারাদিনের সর্বশেষ আলোচিত সব খবর Oct 09, 2025
‘আমি এক্সিট খুঁজছি না, বাকিটা জীবনও বাংলাদেশেই কাটাব’ Oct 09, 2025
হাসনাত আব্দুল্লাহ ও আসিফ মাহমুদের মাঝে শেখ হাসিনার প্রতিচ্ছবি Oct 09, 2025
ডিজিএফআইয়ের সাবেক পাঁচ ডিজির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা Oct 09, 2025