কেমন চলছে হারুনের ‘ভাতের হোটেল’?

ডিবি কার্যালয়ের আলোচিত সেই ভাতের হোটেল আর ফিরবে না। সাবেক ডিবি প্রধান হারুনও আছেন পলাতক। এরপর থেকেই বন্ধ আছে তার সেই ভাতের হোটেল। কাজেই ডিবি অফিসের ভাতের হোটেল নিয়ে কথা বলতেও এখন বিব্রত বোধ করেন কর্মকর্তারা।

ভাতের হোটেল আলোচনায় আসে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদের মাধ্যমে। ডিবি অভিযোগ নিয়ে আসা বিভিন্ন ব্যক্তিকে ভাত খাওয়ানোর ভিডিও করে প্রচার করে ব্যাপক আলোচিত হয়েছিলেন তিনি। সেলিব্রেটি থেকে সাধারণ মানুষ বেশিরভাগই পেয়েছেন হারুনের সেই বিশেষ আতিথেয়তা। ডিবি কার্যালয়ে তার এমন কর্মকাণ্ডকে অনেকে ‘দুষ্টুমি’ করে বলতেন ‘হারুনের ভাতের হোটেল’।

অভিযোগকারীদের ভাত খাইয়ে এমন তকমা পাওয়া অবশ্য বেশ উপভোগই করতেন সাবেক ডিবি প্রধান। একাধিক সাক্ষাৎকারেও জানিয়েছিলেন নামকরণে ভালো লাগার সে কথা। যেকোনো ইস্যুতে সেলিব্রেটি ও সাধারন মানুষের ভরসার জায়গা দখল করতে পারার কৃতিত্বও নিয়েছিলেন তিনি। জানিয়েছিলেন, ‘হাউন আংকেল’ ব্যাঙ্গাত্মক নামটিতেও তার আপত্তি নেই।

তবে ছাত্র-জনতার জুলাই অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মুখ থুবড়ে পরে সেই ‘ভাতের হোটেল’ খ্যাত ডিবি কার্যালয়। পালিয়ে যান হারুন অর রশীদ। তার উত্তরসূরি হিসেবে এখন ডিবিপ্রধানের দায়িত্বে আছেন রেজাউল করিম মল্লিক। তিনি জানান, ডিবির কর্মকর্তারা ‘হারুনের ভাতের হোটেল’ নিয়ে কথা বলতে বিব্রত বোধ করেন।

বর্তমান ডিবিপ্রধান বলেন, “ডিবি কার্যালয়ে ‘ভাতের হোটেল’ আর ফিরবে না। হারুন এবং তার ভাতের হোটেলের কারণে ডিবির ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছিল। মানুষ এটি নিয়ে হাসি-তামাশা করেছে। নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ডিবির মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানকে হারুন হাস্যরসে পরিণত করেছিলেন।”

হারুন যে কক্ষটিকে ভাতের হোটেল বানিয়েছিলেন ওই কক্ষটির অবস্থান ডিবির পুরোনো ভবনের দোতলায়। সে কক্ষ এখন দাপ্তরিক কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে বলেও জানান রেজাউল করিম। ডিবি কর্মকর্তারা বলছেন, কক্ষটিতে এখন ছোট সভা করা হয়। আবার কখনও এই কক্ষেই আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।

হারুনের ভাতের হোটেলের ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, ২০২৩ সালে বিএনপি নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে ডিবি কার্যালয়ে হেফাজতে নেন তৎকালীন ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদ। সে সময় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সরকার বিরোধী আন্দোলন করছিল বিএনপি। তখন গয়েশ্বরকে নিজ হাতে খাবার বেড়ে আপ্যায়ন করেন হারুন। প্লেটে খাবার তুলে দেয়ার সে মুহূর্ত ভিডিও করে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেন তিনি। এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনায় ডিবি কার্যালয় পায় ‘হারুনের ভাতের হোটেল’ তকমা।

গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের ভিডিও প্রচারের পর ডিবি কার্যালয়ে আসা বিভিন্ন ব্যক্তিকে ওই কক্ষে আপ্যায়ন করে তার ভিডিও ধারণ ও সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করতে থাকেন হারুন অর রশীদ। অভিনেত্রী অপু বিশ্বাস এবং গান বাংলা টিভির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কৌশিক হোসেন তাপস পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিতে আসার পর তাদেরও ডিবি কার্যালয়ে আপ্যায়ন করা হয়।

এর বাইরে বিভিন্ন অভিযোগ নিয়ে আসা তারকা, টিকটকার ও ব্লগারদের খাইয়ে সেটির ভিডিও প্রচার করেন তিনি। এভাবে ডিবি কার্যালয় ‘হারুনের ভাতের হোটেল’ নামে আরও পরিচিত পায়। সে সময় এক সাক্ষাৎকারে হারুন বলেছিলেন, ‘কেউ হয়তো মনে করতে পারে, ডিবি একটা ভাতের হোটেল, বলতে পারেন। এতে আমাদের ডিবি ডিমোরালাইজড হবে না। বরং এটা আমাদের একটি মানবিক সাইড।

তবে তিলে তিলে গড়ে তোলা সে ভাতের হোটেলের বিরোধিতা করে তীব্র পতিক্রিয়া শুরু হয় হাসিনা সরকার বিরোধী আন্দোলনে। গেল জুলাইয়ের শেষ দিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ককে ডিবি কার্যালয়ে তুলে আনা হয়। আইন অনুযায়ী তাদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির না করে নেয়া হয় ডিবি হেফাজতে। তখন তাদের সঙ্গেও খাওয়াদাওয়ার ছবি ফেসবুকে প্রচার করেছেন হারুন।

এ ঘটনায় তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি। জনতোপের মুখে ৩০ জুলাই ‘কথিত আটক’ ছয়জন সমন্বয়ককে অবিলম্বে মুক্তি দিতে সুপ্রিম কোর্টের দুই আইনজীবী হাইকোর্টে রিট করেন। রিটের শুনানিতে বিচারক বলেছিলেন, ‘টিভিতে দেখেছি, এই ছয়জন কাঁটাচামচ দিয়ে খাচ্ছে। এগুলো করতে আপনাকে কে বলেছে? কেন করলেন এগুলো? জাতিকে নিয়ে মশকরা কইরেন না। যাকেই ধরে নেন, তাকেই খাবার টেবিলে বসিয়ে দেন।’

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ডিবি কার্যালয় পরিদর্শনে যান। সে সময় তিনি বলেন, ‘ডিবিতে কোনো ভাতের হোটেল থাকবে না’। পুলিশের গোয়েন্দা সংস্থার বর্তমান প্রধানও একই মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, ‘ডিবির ক্ষুণ্ন হওয়া ভাবমূর্তি পেশাদার কাজের মধ্য দিয়ে ফিরতে শুরু করেছে। এখনকার ডিবি হারুনের ডিবি নয়, সাধারণ মানুষের আস্থা ও ভরসার ডিবি হয়ে উঠেছে।’
টিএ/

Share this news on: