স্কুলছাত্রী অপহরণ মামলার আসামি বহিষ্কৃত ছাত্রদল নেতার কাণ্ড!

স্কুলছাত্রী অপহরণ ও ধর্ষণচেষ্টার মামলায় অভিযুক্ত ও বহিষ্কৃত ছাত্রদল নেতা জাহাঙ্গীর আলম রতন (২৫) নিজেকে নির্দোষ প্রমাণে নতুন কৌশল নিতে শুরু করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক তরুণীর সঙ্গে নিজের কথোপকথনের স্ক্রিনশট শেয়ার করে তিনি দাবি করছেন, ঘটনাটি সাজানো এবং ভুক্তভোগী পরিবারের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন তিনি।

অন্যদিকে, অভিযোগ উঠেছে—স্থানীয় বিএনপি নেতা সিরাজুল ইসলাম অভিযুক্ত রতনকে বাঁচাতে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করছেন।

এদিকে, অভিযুক্তের বাবা তোজাম্মেল হোসেন তজু নিজ বাড়িতে সংবাদ সম্মেলনের ঘোষণা দিলেও উপস্থিত না হয়ে গা ঢাকা দিয়েছেন। এতে এলাকাজুড়ে আরও বিতর্ক ও প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে রতনের পরিবারের ভূমিকা।

অভিযুক্ত রতন পাবনার চাটমোহর উপজেলার হরিপুর ইউনিয়ন ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। সদ্য তিনি বহিষ্কৃত হয়েছেন। তিনি ওই ইউনিয়নের তেবাড়িয়া মোল্লাপাড়া গ্রামের তোজাম্মেল হোসেন তজুর ছেলে। তার সহযোগী একই গ্রামের মহসিন হোসেনের ছেলে মামুন হোসেন (১৮)।মামলা দায়েরের পর থেকে তারা পলাতক রয়েছেন।

মামলা থেকে জানা গেছে, পাবনার চাটমোহর উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের এক স্কুলছাত্রীকে দীর্ঘদিন ধরে স্কুলে যাতায়াতের পথে রতন ও মামুন সহ বখাটেরা বিরক্ত করতো। রতন মেয়েটিকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে নানাভাবে উত্যক্ত করতেন। বাড়ির মোবাইল ফোন নম্বর সংগ্রহ করে দিনে রাতে ফোন করে উত্যক্ত করতেন।

কিন্তু মেয়েটি রাজী না হওয়ায় গত ১১ মার্চ রাত সাড়ে ৮টার দিকে কয়েকজনকে নিয়ে স্কুলছাত্রীর বাড়িতে যান বখাটে রতন ও মামুন।

তারা দরজা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে স্কুলছাত্রীকে মুখ চেপে ধরে বাহিরে নিয়ে ধর্ষণের চেষ্টা করেন। এ সময় তার চিৎকারে প্রতিবেশীরা উপস্থিত হলে অভিযুক্তরা দ্রুত ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যাযন। পরে এলাকাবাসীর সহযোগিতায় চাটমোহর থানায় গিয়ে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন মেয়েটির বাবা।

এদিকে ঘটনার চারদিন অতিবাহিত হলেও অভিযুক্ত দুইজনকে এখনও গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।

অপরদিকে, গত বৃহস্পতিবার (১৩ মার্চ) রাতে চাটমোহরের অন্তত ১০ জন সাংবাদিককে ফোন করে অভিযুক্ত ছাত্রদল নেতা রতনের বাবা জানান, শুক্রবার (১৪ মার্চ) সকাল দশটায় তার বাড়িতে সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। সবাইকে উপস্থিত হওয়ার আহ্বান জানান তিনি। কিন্তু ওইদিন তার বাড়িতে গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। বাড়িতে তালা ঝুলছে। তজুর মোবাইলে কল দেওয়া হলে তার নম্বরটিও বন্ধ পাওয়া যায়।

রতনের মা বাছিরন বেগম বলেন, ‘সকালে উঠেই ছাওয়ালের বাপ কোনে জিনি গ্যাছে। কয়া গেল আমি ঝামেলায় আছি, পরে সুম্বাদ সম্মেলন হবি। ভাইস্তে শুভক কইছিলেম সকালেই যে সুম্বাদিকগোরে মানা কইরে দে। এহন ও কি করছে জানি না। মেয়ের বাপের কাছে ছেলের জন্য বিয়ের প্রস্তাব পাঠানো হয়েছিল, কিন্তু মেয়ের বাপ রাজী হয় নাই।’

প্রতিবেশি শুভর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাকে বলেছিল নিষেধ করতে। কিন্তু আমি ফোন করে সবাইকে নিষেধ করতে পারিনি।

পরে প্রতিবেশি ও এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, তিন বোন আর এক ভাইয়ের মধ্যে অভিযুক্ত রতন সবার ছোট। রতন ছেলে হিসেবে ভাল নয়, খুবই বেয়ারা বলেই বেশিরভাগ মানুষ জানায়। মেয়েটিকে তুলে আনতে যাওয়ার বিষয়টি সত্য বলে জানান স্থানীয়রা। অভিযোগ রয়েছে, রতনের বাবা তজু মাদক বিক্রির সাথে জড়িত। এর আগে পুলিশ কয়েকবার তাকে ধরার জন্য তাড়িয়েছে। রতন নিজেও মাদকসেবী।

ভুক্তভোগী স্কুলছাত্রীর বাবা বলেন, ৫ আগস্টের পর থেকে আমার মেয়েকে উত্যক্ত করতো। মেয়ে ঘটনাটা আমাকে জানানোর পর আমি বিভিন্নজনকে দিয়ে ছেলেটিকে নিষেধ করাই এরকম না করার জন্য। রতনের চাচাতো ভাই হরিপুর ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি প্রার্থী পিয়াস তাকে দিয়েও নিষেধ করাই যাতে মেয়েকে উত্যক্ত না করে। তারপর রতন হুমকি দিয়েছিল মেয়েকে যেন আটকে রাখি, মেয়েকে উঠিয়ে নিয়ে যাবে, আমাকে রাস্তাঘাটে দেখে নেওয়ার হুমকি দিয়েছিল।

তিনি আরো বলেন, গত জানুয়ারি মাসে ছেলের বাবা বিভিন্ন মাধ্যমে আমার কাছে মেয়ের সাথে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। পরে আমি রতন নেশাগ্রস্ত হওয়ায় প্রস্তাব ফিরিয়ে দেই। মেয়েকে আরো লেখাপড়া করাতে চাই।

তিনি বলেন, স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা পিয়াসের মামা হলেন বিএনপি নেতা সিরাজ। তিনি তাদের পক্ষে মামলা ডিল করছেন। যেকারণে পুলিশ এখনও আসামি ধরছে না। এখন উল্টো আমাদের উপর হুমকি আসছে। নানারকম চাপ আসছে আপোষ করার। আর রতন যে মোবাইলের স্কিনশট দেখাচ্ছে ওটা মিথ্যা। ওই মোবাইল নম্বরও আমার কখনও ছিল না। সে বাঁচার জন্য আমার মেয়ের ঘাড়ে দোষ চাপানোর ফন্দি আঁটছে।

ভুক্তভোগী স্কুলছাত্রী জানায়, ‌‌৩/৪ মাস আগে থেকে আমাদের বাড়ির মোবাইলে কল দিতো রতন। তার বন্ধু মামুন আমার ক্লাসমেট ছিল। মামুনের কাছে আমার নম্বর ছিল। সেই নম্বরটা তাকে দিয়েছিল। তারপর কল করতো। ফোনে প্রস্তাব দিতো। স্কুলে যাওযা আসার পথে প্রস্তাব দিতো। রাজী হইনি। কারণ আমার বান্ধবীরা বলেছিল ছেলেটা ভালো না, নেশা করে। আর আমারও ইচ্ছা লেখাপড়া করার। তারপর অতিরিক্ত জ্বালানোর পর আমি বাবা মাকে জানাই।

মেয়েটি আরো জানায়, রতন এখন যে মেসেজের স্কিনশট দেখাচ্ছে সেরকম কখনই তার সাথে আমার মেসেজ আদান প্রদান হয় নাই। আর যে নম্বরে মেসেজ আদান প্রদান দেখাচ্ছে সেটা আমার সাথে নয়। ওই মোবাইল নম্বরও আমাদের নয়। অন্য কোনো মেয়ের সাথে তার মেসেজ এখন আমার উপর চাপিয়ে নিজে বাঁচার চেষ্টা করছে।

এ বিষয়ে হরিপুর ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা সম্পূর্ন বাজে বানোয়াট কথা। আমি বরং ছেলেকে স্যারেন্ডার করানোর জন্য তার বাবাকে দুইবার বলেছি। ছেলের বাবা আবার মামলাবাজ লোক। তার বিরুদ্ধে এর আগে ৫টা মার্ডার মামলা ছিল। আমার কথা তিনি আমলে নিচ্ছেন না। আমি মামলার কোনো তদবির করছি না। যেদিন মামলা হয় সেদিনও ওসি সাহেবকে বলেছি আপনি যেকোনো ভাবে ব্যবস্থা নেন। কারণ মেয়ের বাবা আওয়ামীলীগ করে। আমি করি বিএনপি। সে কি বললো না বললো তাতে আমার কিছু যায় আসে না।

চাটমোহর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মঞ্জুরুল আলম বলেন, ‘আসামি পলাতক রয়েছে। এলাকার বাইরে গা ঢাকা দিয়েছেন। তার মোবাইল নম্বরও বন্ধ। কতদিন পালিয়ে থাকবেন, ধরা পড়তেই হবে। আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। দুই আসামিকে ধরতে পুলিশের অভিযান অব্যাহত আছে। মামলার বিষয়ে পুলিশের উপর কারো কোনো চাপ নেই।’


এসএস

Share this news on:

সর্বশেষ